প্রতিবেদন

মেট্রোরেল: এমআরটি এবং র‍্যাপিড পাস পাওয়ার উপায়

ভূঁইয়া মোহাম্মদ ইমরাদ: ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও এমআরটি (মাস র‍্যাপিড ট্রানজিট)-৬ চালুর মধ্য দিয়ে মেট্রোরেল এর যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। এশিয়ার মধ্যে ২২তম দেশ হিসেবে মেট্রোরেল সিস্টেম চালু হয়েছে বাংলাদেশে। বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশে শহরের ভেতরে গণপরিবহন হিসাবে মেট্রোরেলের মত সেবা চালু রয়েছে। এলাকাভেদে এগুলো মেট্রোরেল, সাবওয়ে, ইউ-বান সহ বিভিন্ন নামে পরিচিত। বিশ্বে প্রথম মেট্রোরেল সিস্টেম চালু হয় লন্ডনে, ১৮৬৩ সালে। আর এশিয়ায় প্রথম মেট্রোরেল চালু হয় জাপানের টোকিও শহরে ১৯২৭ সালে।

যানজটমুক্ত মেট্রোরেল প্রতিদিনই রক্ষা করছে লাখ লাখ কর্মঘণ্টা। উন্নত এই পরিষেবা গ্রহণকে সহজ ও সাবলীল করতে এর টিকেট পদ্ধতিতেও আনা হয়েছে আধুনিকতা। প্রথম দিকে ছিল এসজেটি (সিঙ্গেল জার্নি ট্রান্সপোর্ট) বা সিঙ্গেল পাস এবং এমআরটি পাস। ২০২৩-এর সেপ্টেম্বর থেকে এগুলোর সঙ্গে সংযোজিত হয় র‍্যাপিড পাস।

এমআরটি পাস
মাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) পাস এনএফসি প্রযুক্তিভিত্তিক ইলেক্ট্রনিক চিপ সম্বলিত একটি স্মার্ট কার্ড। এটি এমন একটি প্রযুক্তি যার মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন বা খুব কম দূরত্বের মধ্যে সংযোগ বিহীনভাবে একাধিক ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের মধ্যে তথ্য স্থানান্তর করা যায়। এটি বিশ্বব্যাপী স্মার্টকার্ড এবং কার্ড রিডার বা গ্রাহক যন্ত্রের ইন্টারফেসকে তথ্য স্থানান্তরের জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে ব্যবহার করা হয়। ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) বারবার টিকেট কাটার বিকল্প হিসেবে চালু করেছে এই স্থায়ী যাত্রা কার্ডটি। এতে টাকা রিচার্জ করে ইচ্ছে মতো মেট্রোরেল ভ্রমণ করা যাবে। এই কার্ডটির মেয়াদ থাকছে ১০ বছর।

কিভাবে পাবেন
মেট্রোরেলের যে কোনও স্টেশনের টিকেট কাটার মেশিনের কাছে অ্যাক্সেস ফেয়ার অফিস বা কাস্টমার সার্ভিস সেন্টার থেকে ক্রয় করা যাচ্ছে এমআরটি পাস কার্ড। এই স্থায়ী যাত্রা কার্ডটি করার সময় শুধুমাত্র জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি কার্ড) প্রয়োজন হবে। তবে বিকল্প হিসেবে জন্ম নিবন্ধন বা ড্রাইভিং লাইসেন্স কিংবা পাসপোর্ট; যে কোনও একটি সরবরাহ করা যেতে পারে।

অ্যাক্সেস ফেয়ার অফিস বা কাস্টমার সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে পাস কার্ড নেয়ার ব্যাপারটি জানানো হলে তারা একটি ফর্ম সরবরাহ করবে। এবার এনআইডি অনুসারে নাম, পিতা বা স্বামীর নাম, মাতার নাম, জন্ম তারিখ, নিজের জেলা, এনআইডি সংখ্যা প্রভৃতি তথ্যগুলো দিয়ে ফর্মটি পূরণ করতে হবে। অন্যান্য যে তথ্যাদির দিতে হবে সেগুলো হলো- লিঙ্গ, জাতীয়তা, এবং মোবাইল নাম্বার। সবশেষে ফর্মের নিচের শেষ প্রান্তে নির্দিষ্ট স্থানে সই ও তারিখ দিয়ে পূরণকৃত ফর্মটি কর্মকর্তার নিকট জমা দিতে হবে।

এই নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি ঘরে বসেও সম্পন্ন করা যাবে। পাস কার্ডের নিবন্ধন ফর্ম ডাউনলোড করা যাবে মেট্রোরেলের ওয়েবসাইট থেকে। অতঃপর তা পূরণ করে কাছাকাছি স্টেশনে গিয়ে জমা দিয়ে আসতে হবে। ফর্ম জমা দেয়ার ২ থেকে ৩ মিনিটের মধ্যেই কর্মকর্তা তথ্য যাচাই পূর্বক একটি সক্রিয় যাত্রা কার্ড প্রদান করবেন। চাইলে সঙ্গে সঙ্গে এটি দিয়ে এন্ট্রি গেটে পাঞ্চ করে মেট্রোরেলে প্রবেশ করা যাবে।

এমআরটি পাস ফি
ফর্ম জমা দেয়ার সময় কার্ড প্রক্রিয়াকরণ ফি বাবদ ৫০০ টাকা প্রদান করতে হবে। এই খরচের মধ্যে ২০০ টাকা হচ্ছে কার্ডের মূল্য। আর বাকি ৩০০ টাকা থাকবে নিবন্ধনকারির কার্ডে ব্যবহারযোগ্য ব্যালেন্স হিসেবে।

র‍্যাপিড পাস
এনএফসি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে ইলেক্ট্রনিক চিপযুক্ত র‍্যাপিড পাসে। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)-এর এই কার্যক্রমের লক্ষ্য একটি মাত্র কার্ডের মাধ্যমে দেশের সকল গণপরিবহনে ভাড়া আদায়ের পথ সুগম করা। ঢাকা মেট্রোরেল ও বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট সহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন বাস সার্ভিসে স্বাচ্ছন্দ্যে ভাড়া দেয়া যাবে এই পাস দিয়ে। এমনকি বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন পরিষেবা এবং বিআইডব্লিউটিসি এর নৌ-যান পরিষেবাও থাকছে এর আওতায়।

কিভাবে পাবেন
ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের (ডিবিবিএল) নির্দিষ্ট কিছু শাখা, উপ-শাখা ও বুথ থেকে নেয়া যাবে এই পাস কার্ড।

নিবন্ধন প্রক্রিয়া
এনআইডি কার্ড/জন্ম নিবন্ধন/ড্রাইভিং লাইসেন্স/পাসপোর্ট-এর যে কোন একটি সঙ্গে রাখতে হবে। ডিবিবিএল এর নির্ধারিত ব্যাংকে গিয়ে পাস নেয়ার ব্যাপারে জানালে এমআরটি পাসের ন্যায় একইভাবে একটি ফর্ম দেয়া হবে। এই ফর্মেও একই তথ্য জানতে চাওয়া হবে, যেগুলোর মধ্যে এনআইডির তথ্যগুলো অবশ্যই অবিকল হতে হবে। পূরণকৃত ফর্ম কাউন্টারে জমা দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই দায়িত্বরত কর্মকর্তা তথ্য যাচাই পূর্বক পাস কার্ডটি প্রদান করবেন। প্রদানের মুহুর্তেই কার্ডটি সক্রিয় থাকবে, অর্থাৎ সঙ্গে সঙ্গেই এটি ব্যবহার করা যাবে।

পাসের নিবন্ধন ফর্ম ডিটিসিএ-এর ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা যাবে। অতঃপর তা পূরণ করে উপরোক্ত স্থানগুলো থেকে নিবন্ধনকারীর নিকটতম স্থানে জমা দিয়ে আসা যাবে। এই পাসের জন্য সরাসরি অনলাইনে নিবন্ধন-এরও ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া ফেসবুকের মাধ্যমেও অর্ডার করা যাবে এই কার্ড।

র‍্যাপিড পাস ফি
ফর্ম জমা দানের সময় এই স্থায়ী যাত্রা কার্ডের প্রাথমিক মূল্য বাবদ ৪০০ টাকা দিতে হবে। এই খরচের অর্ধেক হলো স্মার্ট কার্ডের মূল্য, আর বাকি অর্ধেক কার্ডে রিচার্জ করে দেয়া হবে ব্যবহারের জন্য।

এমআরটি এবং র‍্যাপিড পাসের সুবিধা
ঢাকার মতো জনবহুল শহরে এই পাসগুলোর সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে- এগুলোর মাধ্যমে লাইনে দাড়ানো ছাড়াই সরাসরি যে কোনও পরিবহনে যাতায়াত করা যাবে। অবশ্য কার্ডে ব্যালেন্স নেয়ার ক্ষেত্রে দিনের যে সময়টাতে সবচেয়ে বেশি কর্মচাঞ্চল্য থাকে সে সময়ে লাইনে দাড়ানো লাগতে পারে। ব্যবহারকারীরা কার্ডগুলোতে সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা রিচার্জ করতে পারবেন। তবে একবারে রিচার্জ করা যাবে সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা।

দুটি কার্ডেই থাকছে প্রতিবার ভ্রমণে ১০ শতাংশ ছাড়। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকা ভাড়ার জন্য কার্ড থেকে কাটা হবে ৯০ টাকা। সুতরাং এভাবে ২০টি যাতায়াত থেকেই উঠে আসবে কার্ডের মূল্য। কার্ডে অপর্যাপ্ত ব্যালেন্স থাকলেও ব্যবহারকারি শুধুমাত্র একবার যাতায়াত করতে পারবেন। পরবর্তীতে রিচার্জের পর বাকি ধার্যকৃত টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বয় হয়ে যাবে। কার্ড ব্যবহারকারী কোনও দিন কার্ড ফেরত দিয়ে রিফান্ড চাইলে, প্রথমে ফেরতের সুষ্পষ্ট কারণ যাচাই করা হবে। অতঃপর রিফান্ড ফি বাবদ ২০ টাকা কেটে নিয়ে সেই দিন-ই কার্ডের মূল্য অবশিষ্ট ব্যালেন্স সহ ফেরত দেয়া হবে।

ক্ষতিগ্রস্থ কার্ড পুনরায় তোলার ক্ষেত্রে নষ্ট কার্ডটি ফেরত দিয়ে নতুন কার্ড নেয়া যাবে। সেই সঙ্গে ব্যবহারকারী নতুন প্রদানকৃত কার্ডে তার পূর্বের যাবতীয় ব্যালেন্স পেয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে কার্ড পুনঃ প্রদান ফি বাবদ ২০০ টাকা খরচ হবে। এমআরটি পাসের বেলায় কার্ড হারিয়ে গেলে ৪০০ টাকা খরচ করে পূর্বের ব্যালেন্স সহ কার্ডটি তুলতে হবে। এখানে ব্যালেন্স ও নতুন প্রাপ্ত কার্ডের মেয়াদ সীমিত; তথা ১০ বছর।

কিন্তু র‍্যাপিড পাসের ক্ষেত্রে হারানো কার্ড পুনরুদ্ধারের পদ্ধতি একটু ভিন্ন। এখানে পুনঃ প্রদান পরিষেবা বাবদ ২০০ টাকা পরিশোধের সঙ্গে নতুন কার্ডের জন্য জমা রাখতে হবে ২০০ টাকা। এই জমা মূল্য ফেরত দেয়া হবে হারানো কার্ড ফেরত পাওয়ার পর ২০ টাকা রিফান্ড ফি-এর বিনিময়ে। এ সময় হারিয়ে যাওয়া কার্ডটি নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হবে। নষ্ট ও হারানো কার্ড তোলার প্রক্রিয়াটি ১ কার্য দিবসের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে। ব্যবহারকারী এখানে স্মারক সংখ্যা সম্বলিত একটি ভাউচার পাবেন, যেটি প্রদর্শনপূর্বক পরবর্তী কার্যদিবসে তিনি নতুন কার্ড গ্রহণ করতে পারবেন। এখানে ব্যালেন্স ও নতুন কার্ডটির জন্য ব্যবহারকারী আজীবন মেয়াদ পাবেন।

তবে কার্ড ও ব্যালেন্স রিফান্ড, নষ্ট ও হারানো কার্ড পুনরুদ্ধারের জন্য র‍্যাপিড পাস কার্ডটি অবশ্যই অনলাইনে নিবন্ধিত থাকতে হবে। এক্ষেত্রে কার্ডের সংখ্যাটি মনে রাখা আবশ্যক। কেননা এই সংখ্যা দিয়ে কার্ডের অনলাইনে নিবন্ধন যাচাই করা যাবে।

২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল যাত্রার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি সৌজন্যে: পিআইডি বিডি

ঢাকা মেট্রোরেলের এমআরটি এবং র‍্যাপিড পাসকে ঘিরে ভবিষ্যতে যুক্ত হতে চলেছে আরও নানা সুবিধা। এখন স্টেশনগুলোতে কার্ড ক্রয়ের পাশাপাশি রিচার্জের ব্যবস্থাও চালু করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই এই রিচার্জিং পদ্ধতিকে নিয়ে যাওয়া হবে অনলাইনে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি যুক্ত হচ্ছে আর্থিক লেনদেনের বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম। তাই টাকা ফুরিয়ে গেলে আর স্টেশন বা অন্যান্য রিচার্জিং সেন্টারগুলোতে যেতে হবে না।
পরিকল্পনা মাফিক রেলওয়ে, এক্সপ্রেসওয়েতে টোল আদায়ে ব্যবহৃত হবে এই কার্ডগুলো। এছাড়া বাস, লঞ্চ, এবং মেট্রোরেল পরিচালিত শপিংমলগুলোরও বিল পরিশোধ করা যাবে এই পাসগুলো দিয়ে। সর্বসাকূল্যে, ঢাকা শহরের গোটা পরিবহন পরিষেবাকে আনা হবে এই ই-টিকেট ব্যবস্থাপনার আওতায়।

ঢাকায় এমআরটি লাইন ৬ এর পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে আরও পাঁচটি মেট্রোরেল তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এমআরটি লাইন-১ এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে এবং এর রুট বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত। এটি বাংলাদেশের প্রথম পাতাল রেল হওয়ার কথা। সাভারের হেমায়েতপুর থেকে গুলশানের ভাটারা পর্যন্ত উড়াল ও পাতাল মিলিয়ে ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এমআরটি লাইন-৫: নর্দার্ন রুটের নকশার শেষ পর্যায়ের কাজ চলমান রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে আফতাবনগর পর্যন্ত, গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ও কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত আরও তিনটি মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ চলছে।

মেট্রোরেল পুরোদমে চালু হলে ঢাকার মানুষ তীব্র যানজট থেকে অনেকটাই মুক্তি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে আসে, যে গত ১০ মাসে মেট্রোরেলে যারা নিয়মিত যাতায়াত করেছেন তাদের প্রায় ৬০ ভাগই এতদিন বাসে যাতায়াত করতেন। এ কারণে মেট্রোরেল চালু হলে রাস্তায় বাসের সংখ্যা কমবে এবং তা যানজট নিরসনে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *