প্রতিবেদন

‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর রূপরেখা যেমন হবে

ভূঁইয়া মোহাম্মদ ইমরাদ: আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে ইশতেহার প্রস্তুত করছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এ জন্য চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে চারটি মূল লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সোসাইটি এবং স্মার্ট ইকোনমি। আইসিটি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের জনগণ সবচেয়ে বেশি সরকারের সেবা পাবে এবং নিজেরাও আধুনিকে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

২০০৮ সালে যখন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণাটি সামনে আসে, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন এটি কোনোভাবেই অর্জন সম্ভব নয়। তবে ২০২১ সালের মধ্যেই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গঠনের যে প্রতিশ্রুতি এসেছিল; তা এখন দৃশ্যমান। বর্তমানে বহুল আলোচিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ অর্জনের যে রূপরেখা দেয়া হয়েছে; তাতে বলা হচ্ছে জীবনব্যবস্থা হবে প্রযুক্তিনির্ভর, যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের নাগরিক সেবা থেকে শুরু করে সব কিছুই স্মার্টলি করা যাবে। এতে সহজ হবে মানুষের জীবনযাত্রা, হাতের মুঠোয় থাকবে সবকিছু।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নীতি এজেন্ডার বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে। সরকার বেশিরভাগ সেবা ডিজিটালাইজড করেছে। ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১৩ কোটির একটি স্থিতিশীল ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের ১৯ কোটিরও বেশি গ্রাহক রয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন, ডিজিটালাইজেশন-সফলতা স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বাণিজ্য এবং সামাজিক সুরক্ষা নেট পেমেন্টে পরিষেবার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এখন স্মার্ট-এজেন্ডা একটি উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং জ্ঞান-প্রযুক্তি-চালিত সমাজ তৈরির আরও বেশি সুযোগের প্রতিশ্রুতি দেয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘‘আগামী ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। সেই বাংলাদেশ হবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে আমরা চলে যাব। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য ৪টা ভিত্তি ঠিক করা হয়েছে। স্মার্ট সিটিজেন অর্থাৎ আমাদের প্রত্যেকটা সিটিজেন প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবে, স্মার্ট ইকোনোমি অর্থাৎ ইকোনোমির সমস্ত কার্যক্রম আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে করবো ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট যেটা ইতোমধ্যে আমরা অনেকটা করে ফেলেছি, বাকিটাও করে ফেলব এবং আমাদের সমস্ত সমাজটাই হবে স্মার্ট সোসাইটি।’ ২০২১ থেকে ২০৪১ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা তৈরি করে দিয়ে গেলাম। অর্থাৎ ২১ থেকে ৪১ কীভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন হবে তার একটা কাঠামো প্রণয়ন করে সেটা বাংলাদেশের জনগণের জন্য আমি রেখে যাচ্ছি।’’

ইশতেহার প্রণয়ন উপকমিটির আহবায়ক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর পরিকল্পনা পূর্বের বাস্তবায়িত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর পরিকল্পিত রূপান্তর। যা হচ্ছে বিশ্বয়ানের যুগের সমস্ত আধুনিক প্রযুক্তি আর সুবিধাদির সমন্বয়ে তৈরি। ডিজিটাল বাংলাদেশ ২০০৯ সালে বাংলাদেশকে ডিজিটালাইজ করার জন্য নতুন নীতি ঘোষণা করেছিলো। বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ পাবলিক সার্ভিসকে ডিজিটালাইজ করা হয়েছে এবং দ্রুততার সঙ্গে প্রতিটি মানুষের জীবনকে ডিজিটাল টুল দিয়ে চালনার একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে, যদিও গ্রামীণ এলাকায় ডিজিটাল সেবা পৌঁছানো কঠিন। এই ডিজিটাল বাংলাদেশ ১৪ বছরের ব্যবধানে জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক পরিবর্তনে অবদান রেখেছে।’’

ইশতেহার প্রণয়ন উপকমিটির সদস্য সচিব সেলিম মাহমুদ বলেন, ‘‘অনেকের কাছে ‘ডিজিটালাইজেশন’ নীতির সুবিধা ভোগ করে তা অস্বীকার করা বর্তমানে কঠিন হয়ে গিয়েছে। টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ, ডিজিটাল পরিষেবা, ডিজিটাল ফাইন্যান্স এবং ই-কমার্সের মতো বেশ কয়েকটি সেক্টরে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। ডিজিটালাইজেশনের প্রথম ধাপের সাফল্যের ওপর ভর করে, শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশিদের স্মার্টনেসের নতুন যাত্রা শুরু করতে অনুপ্রাণিত করছেন।’’

স্মার্ট বাংলাদেশ এর মূল বৈশিষ্ট্য
‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর লক্ষ্য হলো- মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ ডলার; ৩%-এরও কম মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে; চরম দারিদ্র্য শূন্যে নামিয়ে আনা হবে। আর ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ এর চারটি মূল উপাদান রয়েছে- ১. স্মার্ট নাগরিক, ২. স্মার্ট সরকার, ৩. স্মার্ট সোসাইটি, এবং স্মার্ট ইকোনমি।

কেমন হবে স্মার্ট বাংলাদেশ
স্মার্ট বাংলাদেশ চারটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ফোকাস করবে। সেগুলো হলো- সংযোগ, ই-গভর্নেন্স, উদ্ভাবন এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন। স্মার্ট বাংলাদেশ ন্যায়সঙ্গত অগ্রগতি ঘটাবে যেখানে প্রযুক্তি মূল সক্ষমতার ভূমিকা পালন করবে। ইন্টারনেট অফ থিংস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স এবং বিগ ডেটা অ্যানালিটিক্সের ব্যবহার প্রযুক্তি ইকোসিস্টেমকে রূপান্তরিত করবে। স্মার্ট বাংলাদেশ একটি টেকসই পরিবেশ তৈরির জন্য নবায়নযোগ্য শক্তি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং দক্ষ পরিবহনের ওপরও জোর দেয়। স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য সাশ্রয়ী, সহজলভ্য, গ্রাহককেন্দ্রিক, কাগজবিহীন এবং নগদবিহীন জনসেবা প্রদান করা।

শূন্যের কাছাকাছি বৈষম্য
সব ক্ষেত্রে ডিজিটাল বিভাজন এর সেতু করে বৈষম্য দূর করতে চায় সরকার। স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় সরকার সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবে। এটি একটি প্রযুক্তি-সক্ষম স্মার্ট অর্থনীতি এবং সমাজের সুবিধা প্রদানের জন্য একটি নতুন পথরেখার সুচনা। দেশের গ্রামগুলোকে শহরের মতো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গড়ে তোলার নীতিমালা ইতিমধ্যেই চলছে।

অন্তর্ভুক্তি ক্ষমতায়ন
নতুন দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে একটি স্মার্ট জাতির জন্য স্মার্ট নাগরিক তৈরি করা এই নীতির উদ্দেশ্য। প্রযুক্তির পাশাপাশি মানবিক দক্ষতা নাগরিকদের ক্ষমতায়ন করবে। নাগরিকরা সমস্যা সমাধানকারী হিসাবে বড় হবে যারা সমাধানের জন্য কোন উচ্চতর কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভর করবে না। এটি একটি প্রগতিশীল সমাজের কল্পনা করে যেখানে সমস্ত সদস্য অন্তর্ভুক্তির সুবিধা ভোগ করবে। সোসাইটি তার সদস্যদের উদ্ভাবক হতে উৎসাহিত করবে। ‘কেউ পিছিয়ে নেই’ মন্ত্র নীতিনির্ধারণকে গাইড করবে।

তারুণ্যকে অগ্রাধিকার
বাংলাদেশে তারুণ্যের স্ফীতি আছে। আগামীতে দেশকে এগিয়ে নিতে আজকের তরুণরা স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। স্মার্ট বাংলাদেশ তরুণ প্রজন্মের চালিকাশক্তি হওয়ার সুযোগ তৈরি করবে। চতুর্থ শিল্প বিল্পব ইতিমধ্যেই চলছে যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ল্যান্ডস্কেপ পুনর্নির্মাণ শুরু করেছে। তরুণদের উন্নত দক্ষতা ও উদ্যোক্তা মানসিকতা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। বাংলাদেশের স্মার্ট-এজেন্ডা তৈরি হচ্ছে তার তরুণদের গতিশীলতার দ্বারা।

ডিজিটাল বাংলাদেশের হাত ধরে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে বাংলাদেশকে প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক উন্নত হতে হবে এবং সেই উদ্যোগ সফল করতে স্মার্ট বাংলাদেশ এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী এক কর্মপরিকল্পনা। অনেকেই হয়তো বলার চেষ্টা করবেন, দেশকে প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য স্মার্ট বাংলাদেশ নামের স্লোগানের কী প্রয়োজন? প্রয়োজন অবশ্যই আছে। স্মার্ট বাংলাদেশ তো শুধু একটি স্লোগান নয়, আগামী দুই যুগ ধরে চলবে এমন এক বিশাল কর্মযজ্ঞের নাম স্মার্ট বাংলাদেশ। আমাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *