প্রতিবেদন

ক্ষতিকর ই-সিগারেটের প্রতি আসক্ত তরুণরা

বাংলাদেশে ই-সিগারেট এবং ভ্যাপিং এর ব্যবহার তরুণ এবং যুব সমাজের মধ্যে উদ্বেগজনক হারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনলাইনে পণ্য বিক্রয়ের ওয়েবসাইট এবং ফেসবুকে মনকাড়া ই-সিগারেটের বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হচ্ছে তরুণ এবং যুব সমাজ। অনেক তরুণের কাছে এখন ইলেকট্রনিক সিগারেট (ই-সিগারেট) ফ্যাশন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশে ই-সিগারেট এবং ভ্যাপিং এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বা বন্ধে কোন পদক্ষেপ না থাকায় রাস্তাঘাট, ক্যাম্পাস, তরুণদের আড্ডাস্থল, বিভিন্ন মার্কেট এবং রাস্তার মোড়ে গড়ে ওঠা ভ্যাপিং ক্লাবে এসব পণ্যের ব্যবহার ব্যাপকহারে চোখে পড়ছে। এ ছাড়া অনলাইন এবং ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ই-সিগারেট সামগ্রী নিয়ে আলোচনা এবং বিক্রয় হচ্ছে। কৌশলি প্রচার-প্রচারণার কারণে এসব পণ্যের জনপ্রিয়তা এবং ব্যবহার বর্তমানে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে তরুণ-তরুণীরা ধূমপান শুরুই করছেন ই-সিগারেট দিয়ে। বিভিন্ন ফ্লেভার এবং আকর্ষনীয় ডিজাইনের কারনে অনেকে শখের বসে ই-সিগারেট ব্যবহার করছে। অথচ সিগারেটের মতই ই-সিগারেটও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

ডব্লিউএইচও এর ২০২১ সালের তথ্য মতে, বাজারে ১৬ হাজার ধরনের স্বাদ/গন্ধযুক্ত (ফ্লেভার) ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস রয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বেশ কিছু দেশে এসব পণ্যের ব্যবহার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

আমেরিকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে আমেরিকায় স্কুল পড়ুয়া তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার ৭৮% বৃদ্ধি পেয়েছে। হাই-স্কুল পড়ুয়া তরুণদের ৮৫ শতাংশই বিভিন্ন সুগন্ধিযুক্ত ই-সিগারেট ব্যবহার করে কারণ, এসব স্বাদ বা গন্ধ তাদের পছন্দ।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ জানান, ই-সিগারেট তামাকের মতোই ক্ষতিকর। ই-সিগারেটে তরল নিকোটিন থাকে, যা আমাদের যুব সমাজ বেশি ব্যবহার করছে। ক্ষতিকর বিবেচনায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আইন করে এটি বন্ধ করা হয়েছে। আমাদের দেশেও আইন করে এটিকে দ্রুত বন্ধ করতে হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত জরিপের তথ্যের বরাত দিয়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর তথ্য মতে, ই-সিগারেটের ব্যবহার কিশোর-তরুণদের ধূমপানের প্রবণতা দুই থেকে ছয় গুণ বাড়িয়ে দেয়। অধিকাংশ ই-সিগারেট ব্যবহারকারী একই সঙ্গে ধূমপানও করে থাকেন। এই দ্বিমুখী ব্যবহার ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনে। শুধু ধূমপায়ীদের তুলনায় এমন দ্বৈত ব্যবহারকারীদের হৃদরোগের ঝুঁকি ৫শ’ শতাংশ বেশি।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ই-সিগারেটে নিকোটিনের সঙ্গে প্রোপেলিন গ্লাইসল, গ্লিসারিনসহ বিভিন্ন রকম গন্ধ বা ফ্লেভার ব্যবহার করা হয়। নিকোটিনের কারণে যুবক/যুবতীরা আসক্ত হয়। যেহেতু ই-সিগারেটেও নিকোটিন ব্যবহার করা হয়, তাই এটিও আসক্তি বাড়ায়। তরুণ-তরুণীরা ই-সিগারেট গ্রহণ করায় এখন কম বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হোসেন আলী খোন্দকার বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মনে করে ই-সিগাটের বা ভ্যাপিং সিগারেটের মতোই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে বর্তমান তামাক নিযন্ত্রণ আইন অধিকতর শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সংশোধনী প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে যেখানে ই-সিগারেট, ভেপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টসহ এধরনের সকল পণ্যের উৎপাদন, আমদানি এবং ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছে। আইনের খসড়া সংশোধনীটি ইতোমধ্যে বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ করে বর্তমানে মন্ত্রিসভার চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় অতি সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সরকারগুলোকে ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণের জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছে। ইতোমধ্যে ক্ষতিকর বিবেচনায় ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ ৩২টি দেশ এসব পণ্য বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছে। যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশ এসব পণ্য নিষিদ্ধের জন্য কাজ করছে। দ্রুতই আইন সংশোধন করে তা বন্ধ করা উচিত বলে তারা মনে করেন।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *