প্রতিবেদন

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাপ ব্যবহার নিরাপদ?

একটা সময় ছিলো যখন মানুষ কল্পনাও করেনি সবার হাতে স্মার্টফোন থাকবে। অথচ, স্মার্টফোন ছাড়া এখন একটি মুহুর্তও কল্পনা করা যায় না। এখন ইন্টারনেটভিত্তিক জীবন ব্যবস্থা চলমান। প্রযুক্তি জগতে মানুষ যেখানে বহুমাত্রিক যোগাযোগের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাপস ব্যবহার করছে।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহারের ফলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কমে এসেছে ভৌগোলিক দূরত্ব। যা সমগ্র বিশ্বকে নিয়ে এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। অনলাইনে যোগাযোগের জন্য অনেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাপ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক মেসেঞ্জার, সিগন্যাল ও টেলিগ্রামের মতো কয়েকটি অ্যাপ খুব বেশি জনপ্রিয়।

তবে যে অ্যাপই ব্যবহার করা হয়না কেনো, কোনো মেসেজিং অ্যাপই শতভাগ নিরাপদ নয়। বাস্তবের দুনিয়ায় যে রকম অপরাধ হয় ভার্চুয়াল জগতেও তেমন অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। যেমন- ভার্চুয়াল প্রতারণা, ডিজিটাল ব্ল্যাকমেইলিং, ব্যক্তিগত তথ্য চুরি ও তথ্যের অপব্যবহার ইত্যাদি। আবার অ্যাপ বা অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহার করে ডিজিটাল সার্ভেইলেন্সের শিকারও হচ্ছেন অনেকেই।

তবে পছন্দ ও সুবিধা অনুযায়ী একেকজন একেক অ্যাপ ব্যবহার করেন। জনপ্রিয় এই মেসেজিং অ্যাপগুলোর সুবিধা-অসুবিধা ও নিরাপত্তা বিষয়ক ব্যাপারগুলো সম্পর্কে সবারই সম্যক ধারণা থাকা দরকার। হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, টেলিগ্রাম ও সিগন্যাল এই ম্যাসেজিং অ্যাপ এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড। এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে কথোপকথনে অংশগ্রহণকারী পক্ষ ছাড়া স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অন্য কারও অনুপ্রবেশ সম্ভব নয়। হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যাল ও মেসেঞ্জারের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার নীতি সম্পর্কে ধারণা নেয়া যাক:

হোয়াটসঅ্যাপ:
২০০ কোটির অধিক ব্যবহারকারী নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপ। হোয়াটসঅ্যাপ সম্পর্কে জানার আগে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা জানা প্রয়োজন। নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো-নিরাপত্তা হলো তথ্যে অন্য কারও অনধিকার প্রবেশ থেকে সুরক্ষা প্রদান। গোপনীয়তা হলো ব্যক্তির পরিচয় সুরক্ষিত রাখা।

নিরাপত্তার দিক থেকে হোয়াটসঅ্যাপ ও সিগন্যালের সুরক্ষা একই রকম। কারণ উভয় প্ল্যাটফর্মের একই এনক্রিপশন প্রটোকল। তবে মূল সমস্যা হলো, সিগন্যালের এনক্রিপশন প্রোটোকল সম্পূর্ণ ওপেন সোর্স; হোয়াটসঅ্যাপের ক্ষেত্রে আংশিক। ব্যবহারকারীদের বাধ্য হয়ে হোয়াটসঅ্যাপকে সিগন্যালের থেকে বেশি নির্ভর করতে হবে।

কারণ, ফেসবুকের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হোয়াটসঅ্যাপ গ্রাহকের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে সর্বদা চেষ্টা করে। তবে, টেলিগ্রামের মতো হোয়াটসঅ্যাপও বেশ কয়েকবার হ্যাকারদের কবলে পড়েছে। বছর দুয়েক আগে অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের ব্যবহৃত ফোন হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিওর মাধ্যমে হ্যাক হয়েছিলো। হোয়াটসঅ্যাপের ত্রুটির ফলে হ্যাকাররা ২০২০ সালে ১৪০০ ডিভাইস হ্যাক করতে সক্ষম হয়েছিলো। হোয়াটসঅ্যাপের ব্যাকআপ মেসেজ ও মেটাডাটাও এনক্রিপ্টেড নয়।

বিশ্লেষকদের মতে, আনএনক্রিপ্টেড ব্যাকআপের ফলে হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ ফাঁস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। নিরাপত্তা ত্রুটির কারণে প্ল্যাটফর্মটি ক্ষতিকর ম্যালওয়্যারের ধারক হয়ে উঠেছে। টেলিগ্রামেও ক্ষতিকর ম্যালওয়্যারের সংখ্যা বাড়ছে।

যদিও হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড প্রতিষ্ঠানটি বরাবরই জানিয়েছে দুজন ব্যক্তির মধ্যে যে কথোপকথন হয় তারা সেটা কখনো জানতে পারে না। তবে, কথোপকথন দেখতে না পারলেও গ্রাহকের ডিভাইসের তথ্য, আর্থিক তথ্য, অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য, ফোন নম্বর, কন্ট্রাক্ট লিস্ট, ব্রাউজ করা পণ্য, অধিক ব্যবহার করা অ্যাপস ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করে। টেলিগ্রাম ও সিগন্যালের তুলনায় হোয়াটসঅ্যাপ প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করে থাকে।

হোয়াটসঅ্যাপের বৈশিষ্ট্যগুলো হলো- গ্রাহকের অনেক তথ্য সংগ্রহ, ফ্রি অ্যাপ, মূল অর্থ জোগান করে মেটা, এনক্রিপশন ছাড়া বাকিসব ওপেন সোর্স নয়, এনক্রিপ্টেড সিগন্যাল প্রটোকল ইত্যাদি।

টেলিগ্রাম:
গোপনীয়তার সুরক্ষার ক্ষেত্রে অন্যসব মেসেজিং অ্যাপের চেয়ে টেলিগ্রাম মধ্যবর্তী অবস্থানে। অ্যাপটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো। হোয়াটসঅ্যাপের ন্যায় প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেনা। সিগন্যালের মতো সুরক্ষাও এই অ্যাপটিতে নেই। টেলিগ্রাম ব্যবহারকারীদের আইপি অ্যাড্রেস সংগ্রহ করে। যা সিগন্যাল করে না।

হোয়াটসঅ্যাপ ও সিগন্যালের মতো টেলিগ্রামের মেসেজ বাই ডিফল্ট এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড না। অ্যাপের সেটিংস থেকে অপশনটি চালু করে নিতে হয়। বিশ্লেষকদের মতে, টেলিগ্রামের ‘এমটি প্রোটো’ এনক্রিপশন সিস্টেম আংশিক ওপেন সোর্স। গ্রাহকের মেসেজ টেলিগ্রামের সার্ভারে গেলে কী ঘটে সেটার কিছুই জানা যায় না।

এখন পর্যন্ত টেলিগ্রামে অনেক ধরনের তথ্য চুরির ঘটনা ঘটেছে। প্ল্যাটফর্মটির প্রায় ৪২ মিলিয়ন গ্রাহকের ইউজার আইডি ও ফোন নম্বর ২০২০ সালের মার্চে চুরি হয়। ২০১৬ সালেও ১৫ মিলিয়ন গ্রাহকের তথ্য হাতছাড়া হয়েছিলো। একসময় টেলিগ্রামে ভুয়া বট ছিল। এর দ্বারা নারী ব্যবহারকারীদের সাধারণ ছবি থেকে নগ্ন ছবি তৈরি করা হতো। অ্যাপটির জিপিএস প্রযুক্তির সাহায্যে কাছাকাছি থাকা অন্য ব্যবহারকারী সম্পর্কে জানা যায়। এটি ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

টেলিগ্রাম এর বৈশিষ্ট্য: গ্রাহকের নাম, ফোন নম্বর, কন্ট্রাক্ট লিস্ট ও ইউজার আইডি সংগ্রহ; ফ্রি ও কিছুক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে বিজ্ঞাপন ও প্রিমিয়াম ফিচার; আংশিক ওপেন সোর্স; এমটি প্রোটো এনক্রিপশন।

সিগন্যাল:
সিগন্যাল ব্যবহার বেশ সহজ। গতানুগতিক মেসেজিং অ্যাপের মতো। টেক্সট, অডিও, ভিডিও ও পিকচার মেসেজ এনক্রিপ্টেড। গুগলের প্লে-স্টোর ও আইফোনের অ্যাপ স্টোরে এটি পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে যারা অনেক বেশি সচেতন তারাও অনেক বছর ধরে সিগন্যাল ব্যবহার করছেন। এডওয়ার্ড স্নোডেন তাদের মধ্যে একজন।

সিগন্যালের নিরাপত্তা বেস্টনি ভেঙে গ্রাহকের গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করা সহজ নয়। অ্যাপটি গ্রাহকের তথ্য কখনো রেকর্ড করে না। এনক্রিপশন ছাড়া অ্যাপটি নির্দিষ্ট অ্যাপের জন্য নির্দিষ্ট লক, মেসেজ ডিলিট করা ও ফেস-ব্লারসহ অ্যান্টিসার্ভেইলেন্স ফিচার দেয়। কালেভদ্রে অ্যাপটিতে ছোটখাটো সমস্যা দেখা যায়। নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে সিগন্যাল কোনো বিতর্কে পড়েনি।

সিগন্যালের বৈশিষ্ট্য: ফোন নম্বর ছাড়া অন্য কোনো তথ্য সংগ্রহ করে না; সম্পূর্ণ ফ্রি, কোনো বিজ্ঞাপন নেই; সিগন্যাল ফাউন্ডেশন দ্বারা পরিচালিত; সম্পূর্ণ ওপেন সোর্স অ্যাপ; সিগন্যাল প্রটোকল এনক্রিপ্টেড।

ফেসবুক মেসেঞ্জার:
বিশ্বের ৩০০ কোটির বেশি মানুষ মেসেঞ্জার ব্যবহার করেন। তবে এখনো ফেসবুক মেসেঞ্জারের চ্যাটিং বাই ডিফল্ট এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড না। কারো সঙ্গে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপ্টেড চ্যাটিং করতে চাইলে অপশনটি আলাদাভাবে চালু করতে হয়। অপশনটির নাম ‘সিক্রেট কনভারসেশন’।

এতে নির্দিষ্ট সময় পর স্বয়ংক্রিভাবে মেসেজ মুছে ফেলার অপশন রয়েছে। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ তাঁর সকল প্ল্যাটফর্মে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন চালুর ঘোষণা দিলেও সেটি এখনো পুরোপুরি কার্যকর করতে পারেননি। ২০২২ সালের আগস্টে ফেসবুক ঘোষণা দিয়েছিলো, তারা নিজস্বভাবে মেসেঞ্জারে বাই ডিফল্ট এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন পরীক্ষামূলক চালু করছে।

ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ক্ষেত্রে ফেসবুকের দুর্নাম প্রযুক্তি বিশ্বে সবারই জানা। ফেসবুক থেকে গ্রাহকদের বিশাল তথ্যভাণ্ডার ফাঁস বা চুরির একাধিক ঘটনা ঘটেছে। সেজন্য ফেসবুকের মিলিয়ন ডলার জরিমানাও গুনতে হয়েছে।

ফেসবুক এপর্যন্ত ২০১৩ সালে ৬ মিলিয়ন; ২০১৮ সালে ১০০ মিলিয়ন; ২০১৯ সালে – মার্চে ৬০০ মিলিয়ন, এপ্রিলে ৫৪০ মিলিয়ন, সেপ্টেম্বরে ৪১৯ মিলিয়ন, ডিসেম্বরে ৩০৯ মিলিয়ন; ২০২১ সালে – এপ্রিলে ৫৩৩ মিলিয়ন গ্রাহকের তথ্য হয় ফাঁস হওয়ার কথা স্বীকার করেছে।

যুক্তরাজ্যের কনসাল্টেন্সি প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ফেসবুকের প্রায় ৮৭ মিলিয়ন গ্রাহকের তথ্য চুরি করেছিলো। পরে এসব তথ্য তারা রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক কাজে লাগায়। প্রযুক্তি ইতিহাসে এটি অন্যতম কলঙ্কময় ঘটনা।

ফেসবুক মেসেঞ্জারের বৈশিষ্ট্য: গ্রাহকের অধিক তথ্য সংগ্রহ করে; ফ্রি অ্যাপ; প্রচুর বিজ্ঞাপন; এনক্রিপশন বিদ্যমান, তবে বাই ডিফল্ট নয়।

ইন্টারনেটে কোনো কিছুই ‘শতভাগ নিরাপদ’ নয়। তবে, এসব অ্যাপ ব্যবহারে সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *