প্রতিবেদন

ই-জিপি ক্রয় সংস্কারে একটি বড় সাফল্য

ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পের ওপর ভিত্তি করে ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) বাস্তবায়ন সরকারের একটি যুগান্তকারী সাফল্য। ২০১১ সালের ২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ই-জিপি পোর্টাল উদ্বোধন করেন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ই-জিপি’র মাধ্যমে প্রায় ৭৯২,৬৬৪ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।

২০১২ থেকে ১ দশক ধরে ই-জিপি ব্যবস্থাটির ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, পাশাপাশি সরকারী ক্রয়কারী সংস্থা ও বেসরকারী খাতের দরপত্রদাতারাও ইলেকট্রনিক টেন্ডারিংকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে। নব-প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) এই ব্যবস্থার তত্ত্বাবধায়ক। ক্রয়কারী সংস্থা ও দরপত্রদাতারা ই-জিপি ব্যবহার করছে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘‘সরকারি ইলেকট্রনিক ক্রয় কার্যক্রমকে আরও জোরদার করতে বিপিপিএ তৈরি করা হয়েছে। ই-জিপি’র আওতা ১০০ শতাংশে উন্নীত করার প্রচেষ্টা চলছে। বাংলাদেশে সরকারি ক্রয়ে এটি একটি যুগান্তকারী সংস্কার। ই-জিপি পদ্ধতি সময় ও খরচ সাশ্রয় করছে। এটি সরকারের জন্য রাজস্বও তৈরি করছে। এটি পরিবেশের জন্যও উপকারী, কারণ সিস্টেমটি টেন্ডার জমা দেয়ার ক্ষেত্রে কাগজ এবং ভ্রমণের সময় কমিয়ে দিচ্ছে।’’

বিপিপিএ’র সিইও মোহাম্মদ শোহেলার রহমান চৌধুরী বলেন, ‘‘দেশে কতভাগ ই-জিপি কভারেজ হলো- সেদিকে তাকাচ্ছি না। আমরা আমাদের লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছি। আমরা ৩২টি বৃহত্তর ক্রয় সংস্থাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যাচ্ছি- মোট প্রায় ৮০ শতাংশ সরকারি ক্রয় এদের মাধ্যমে হয় এবং এদের বেশিরভাগই এখন ই-জিপি সিস্টেমের মাধ্যমে ক্রয় পরিচালনা করছে। মন্ত্রিসভা সকল ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে ই-জিপি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা তাদের ক্রয় প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজড করার জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতেও আলোকপাত করছি। আমরা সংস্থাগুলোকে পৃথক চিঠিও ইস্যু করছি, এখনও প্রেসে অফলাইন দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করছি। আমরা তাদের অফলাইন মাধ্যমের পরিবর্তে ই-জিপি সিস্টেমের মাধ্যমে দরপত্র আমন্ত্রণ জানাতে অনুরোধ করছি।’’

সম্প্রতি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব তাদের নিজ নিজ বিভাগে ই-জিপি বাস্তবায়নের জন্য সমস্ত মন্ত্রণালয়কে একটি ডেমি অফিসিয়াল চিঠি জারি করেছে। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের অধীনে সিপিটিইউ একটি ইউনিট।

ই-জিপি প্রসঙ্গে দোহাটেক নিউ মিডিয়ার চেয়ারম্যান এ কে এম শামসুদ্দোহা বলেন, ‘‘বিশ্বব্যাংকের মতে, ই-জিপি সিস্টেম ব্যবহার করে বাংলাদেশ বছরে ১.১ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করছে। সিস্টেমটি গড় সংগ্রহ প্রক্রিয়াকরণের সময় ১০০ দিন থেকে কমিয়ে ৫৭ দিনে করেছে। বিপিপিএ ২২,০০০ এরও বেশি সরকারি কর্মকর্তা, ১৫,০০০ নিবন্ধিত দরপত্রদাতা ও ১,৩০০ জন ব্যাংকারকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সরকারি লোকদের প্রয়োজনীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সিস্টেমের উন্নয়ন, অপারেশন রক্ষণাবেক্ষণ ও পেশাদার প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে আমরা এই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সাফল্যের অংশ হতে পেরে সম্মানিত হয়েছি।’’

২০২৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ই-জিপির মাধ্যমে মোট ৭৬১,১৪৬টি দরপত্র আহ্বান করা হয়-যার মোট আনুমানিক ব্যয় ৭৯২,৬৬৪ কোটি টাকা। সংখ্যাটি দিন দিন বাড়ছে। সরকার ই-জিপি সিস্টেমের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় করে। বর্তমানে জাতীয় বাজেটের প্রায় ৪০ শতাংশ এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৮০ শতাংশ সরকারি ক্রয় বাবদ ব্যয় করা হয়েছে। সরকারি ক্রয়ের মোট বার্ষিক ব্যয় বছরে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার।

সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত সংস্কারের বিভিন্ন দিক রয়েছে- যেমন সক্ষমতা উন্নয়ন এবং পেশাদারিকরণ, নাগরিকের সম্পৃক্ততা ও সচেতনতা, স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডার নথি আপডেট করা, ই-জিপি সিস্টেমে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের প্রবর্তন, টেকসই সরকারি ক্রয় (এসপিপি) নীতি গ্রহণ এবং সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটকে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটিতে (বিপিপিএ) রূপান্তর।

বিপিপিএ কর্মকর্তারা বলেছেন, সরকারি ক্রয় সরকারি তহবিল দিয়ে করা হয় এবং সেজন্য নাগরিকদের সরকারি ক্রয় সম্পর্কে জানার অধিকার রয়েছে। অধিকার পূরণের জন্য, বিপিপিএ নাগরিকদের কাছে সরকারি ক্রয়ের তথ্য প্রকাশ করার জন্য একটি সিটিজেন পোর্টাল প্রতিষ্ঠা করেছে। সামগ্রিক ক্রয় ব্যবস্থাপনার আরও উন্নতি এবং দেশে একটি টেকসই ক্রয় পরিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য, সরকার সম্প্রতি আইএমাডি-এর সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ) কে বিপিপিএ -তে রূপান্তরিত করেছে।

২০০৯ সালে, প্রাক্তন সিপিটিইউ ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) চালু করার প্রক্রিয়া শুরু করে। ই-জিপি নির্দেশিকা ২০১১ সালে জারি করা হয়েছিল। ২০১১ সালে ২ জুন প্রধানমন্ত্রী অনলাইন ভিত্তিক ই-জিপি পোর্টাল (www.eprocure.gov.bd) উদ্বোধনের মাধ্যমে সরকারি ক্রয়ে ডিজিটালাইজেশনের বাস্তবায়ন শুরু হয়। ই-জিপি সারা দেশে সত্তা এবং দরপত্রদাতা সংগ্রহের মাধ্যমে একটি নির্ভরযোগ্য এবং গতিশীল ব্যবস্থা হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে।

সরকারি সংগ্রহে দক্ষতা, প্রতিযোগিতা এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৭ সালে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে চুক্তির পুরস্কার ছিল ১০ শতাংশ, যা এখন ৯০ শতাংশে উন্নীত হযয়েছে। ২০০৭ সালে প্রতিটি টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীর গড় সংখ্যা ছিল ৪, এখন তা ২৬ জনে উন্নীত হযয়েছে। ২০০৭ সালে, দরপত্রের বিজ্ঞাপন প্রকাশের হার ছিল ১৫ শতাংশ। বর্তমানে এটি ১০০ শতাংশ। ২০০৭ সালে চুক্তি পুরস্কারের প্রকাশ ছিল ১৫ শতাংশ। বর্তমানে তা ১০০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

‘ইলেক্ট্রনিক টেন্ডার, শেখ হাসিনার উপহার’ শ্লোগানের সঙ্গে, বিপিপিএ ই-জিপি সিস্টেমের আরও সম্প্রসারণ, সরলীকরণ এবং স্থায়িত্বের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ২০১১ থেকে জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত ই-জিপি বাস্তবায়েনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

ই-জিপিতে ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত নিবন্ধিত মহিলা দরপত্রদাতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩৮৮ জন। মোট ৭৬১,১৪৬টি দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল যার মোট আনুমানিক ব্যয় ৭৯২,৬৬৪ কোটি টাকা। ই-জিপির সঙ্গে নিবন্ধিত ব্যাংকের সংখ্যা এখন ৫২ এবং সারা দেশে ৬,৮৭৬টি শাখার সঙ্গে তারা দরপত্রদাতাদের অর্থ প্রদানের পরিষেবা প্রদান করছে।

প্রতিটি টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীদের গড় সংখ্যা ২৬.০৭ এ বৃদ্ধি পেয়েছে। ই-জিপি সিস্টেম বছরে ৪০০-৪৫০ কোটি টাকা আয় করছে। শুরু থেকে ৩১ জুলাই, ২০২৩ পর্যস্ত মোট আয় ছিল ২১৩৭.৬৯ কোটি টাকা। এর পরিমান টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে। বিপিপিএ খুব শীঘ্রই ই-জিপি সিস্টেমে পরিষেবা সংগ্রহ করার জন্য কাজ করছে। ২০২২ সালে, ই-জিপি সিস্টেমে কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যুক্ত করা হয়েছে।

আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি
বাংলাদেশের ই-জিপি সিস্টেম দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। অনেক দেশ ও সংস্থা সাবেক সিপিটিইউ পরিদর্শন করেছে এবং তা চলছে। ইথিওপিয়া এবং নাইজেরিয়া ২০১১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রাক্তন সিপিটিইউ থেকে ই-জিপিতে প্রশিক্ষণ পেয়েছে। গাম্বিয়া, নেপাল, ভুটান, পাকি, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মোজাম্বিক এবং মিশরের প্রতিনিধিরা ই-জিপি বাস্তবায়ন সম্পর্কে জানতে প্রাক্তন সিপিটিইউ পরিদর্শন করেছে। বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারীতে ই-জিপি সিস্টেম একদিনের জন্যও থেমে থাকেনি। বিপিপিএ সাউথ এশিয়ান পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাসোসিযয়েশন নেটওয়ার্ক (এসএপিপিএন) এবং গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট লার্নিং নেটওয়ার্ক (জিডিএলএন), একটি আন্তর্জাতিক প্রকিউরমেন্ট প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সংযুক্ত হযয়েছে।

কৃতজ্ঞতায়: গোলাম মঈন উদ্দিন, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *