এআই-এর জালে অনলাইনে প্রতারণা: ‘পুরোনো ব্যবসা’ সেজে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ
                                                ক.বি.ডেস্ক: সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইনে কেনাকাটা বিশ্বজুড়েই জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তবে প্রযুক্তির এই সুবিধার আড়ালে ডালপালা মেলছে এক নতুন ধরনের অনলাইন প্রতারণা, যা গ্রাহকদের বিশ্বাস এবং অর্থ দুটোই কেড়ে নিচ্ছে। বিদেশী কিছু প্রতিষ্ঠান অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে নিজেদেরকে ব্রিটেনের বহু পুরোনো ও বিশ্বস্ত পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে তুলে ধরছে। এআই-জেনারেটেড লোভনীয় ছবি, নিখুঁত গল্প আর আবেগপ্রবণ বিজ্ঞাপন দিয়ে তারা গ্রাহকদেরকে ফাঁদে ফেলছে। গ্রাহকরা এসব ওয়েবসাইটে বিশ্বাস করে পণ্য কিনে পরে দেখছেন, উচ্চমূল্যের বিনিময়ে নিম্নমানের পণ্য পাচ্ছেন, যা আসছে সুদূর পূর্ব এশিয়ার গুদামঘর থেকে।
এই প্রতারণার শিকার হচ্ছে যুক্তরাজ্যের হাজার হাজার ক্রেতা। বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য এবং ভোক্তা সুরক্ষা সংস্থাগুলোর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই প্রতারকরা একদিকে যেমন গ্রাহকদের ব্যক্তিগত ক্ষতি করছে, তেমনি স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করছে।
এআই-এর হাত ধরে ‘ভুয়া পারিবারিক ব্যবসা’
প্রতারণার এই নতুন কৌশলের মূল হাতিয়ার হলো এআই-সৃষ্ট ডিজিটাল উপস্থিতি। প্রতারকেরা তাদের ওয়েবসাইটের জন্য এআই দিয়ে এমন সব ছবি তৈরি করছে, যা দেখলে মনে হবে সত্যিই যেন তারা কোনও পারিবারিক, ছোট পরিসরের ব্যবসা।
যেমন, একটি আলোচিত ভুয়া অনলাইন দোকান হলো ‘সে লা ভি’ (C’est La Vie)। এই ওয়েবসাইটটি দাবি করে, বার্মিংহামের ঐতিহাসিক গয়নার পল্লিতে এলিন ও প্যাট্রিক নামের এক দম্পতি ২৯ বছর ধরে হাতে তৈরি গয়নার ব্যবসা চালাচ্ছেন। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পণ্য ফেরত পাঠানোর ঠিকানাটি আসলে চীনের। আরেক উদাহরণ হলো ‘মেবেল অ্যান্ড ডেইজি’, যারা নিজেদের ব্রিস্টলভিত্তিক ব্র্যান্ড হিসেবে প্রচার করে, অথচ তাদের ব্যবসায়িক ঠিকানা হংকংয়ে।
এআই-এর ছবিগুলো এখন এতটাই নিখুঁত যে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিদ অধ্যাপক মার্ক লি-এর মতো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “আগে এআই-সৃষ্ট ছবিতে হাত বা আঙুল বাস্তবসম্মত হতো না, যা দেখে ভুয়া ছবি চেনা যেত। এখন ছবিগুলো এত নিখুঁতভাবে তৈরি হচ্ছে যে, তা বাস্তব মনে হলেও আসলে কৃত্রিম। এই নিখুঁত ছবিগুলো তৈরির পেছনে রয়েছে জেনারেটিভ অ্যাডভার্সারিয়াল নেটওয়ার্ক (GAN) নামক অত্যাধুনিক এআই প্রযুক্তি, যা জাল ছবি শনাক্ত করা আরও কঠিন করে তুলেছে।”
প্রতারণার ফাঁদ: আবেগ ও ছাড়ের টোপ
প্রতারকরা কেবল এআই-সৃষ্ট ছবিতেই সীমাবদ্ধ নয়, তারা ব্যবহার করছে আবেগঘন গল্প। ‘সে লা ভি’-এর সাম্প্রতিক একটি বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়, দোকানের মালিক এলিন তার প্রিয় স্বামী প্যাট্রিককে হারানোর শোকে ব্যবসা বন্ধ করছেন এবং শেষবারের মতো গ্রাহকদের জন্য ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছেন। এই ধরনের গল্প গ্রাহকদের মধ্যে এক ধরনের সহানুভূতি তৈরি করে এবং দ্রুত কেনার জন্য উৎসাহিত করে।
ট্রাস্টপাইলট (Trustpilot)-এর মতো রিভিউ প্ল্যাটফর্মগুলোতে এই দুটি ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে পাঁচ শতাধিক এক তারকা রেটিং জমা পড়েছে। উচ্চমূল্যে নিম্নমানের পণ্য পেয়ে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা লিখেছেন, ‘গয়নার বদলে পেয়েছি রজনের টুকরা আর সস্তা ধাতব আবর্জনা।’
সংখ্যার আড়ালে প্রতারণার ব্যাপ্তি ও প্ল্যাটফর্মের দায়বদ্ধতা
যুক্তরাজ্যের ভোক্তা সুরক্ষা সংস্থা ‘উইচ’ (Which?) জানিয়েছে, এআই-নির্ভর প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে তাদের কাছে আসা অভিযোগের সংখ্যা গত দুই বছরে ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অ্যাডভার্টাইজিং স্ট্যান্ডার্ডস এজেন্সি (এএসএ) এর মতে, স্থানীয় বা ব্রিটিশ পরিচয় দিয়ে গ্রাহককে বিভ্রান্ত করা বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে তাদের পদক্ষেপ নেয়ার সংখ্যা গত বছর ২০ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই ভুয়া ওয়েবসাইটগুলোর মাধ্যমে দৈনিক লক্ষাধিক পাউন্ডের লেনদেন হচ্ছে।
বার্মিংহামের আস্টেলা জুয়েলারির মালিক সানি পাল সতর্ক করেছেন, “এই মিথ্যা প্রচারণা আসল ও ভুয়া ব্যবসার সীমারেখা মুছে দিচ্ছে। এতে স্থানীয় ব্যবসার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।”
ইউকে-র বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এএসএ এবং ভোক্তা অধিকার সংগঠন উইচ এই সমস্যা সমাধানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকেও দায়িত্ব নিতে আহ্বান জানাচ্ছে। কারণ, এই প্ল্যাটফর্মগুলো প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন থেকে বিপুল অর্থ উপার্জন করছে। তাই তাদের বিজ্ঞাপন যাচাইকরণে কেবল প্রযুক্তি নয়, মানবীয় যাচাই (Human Vetting) প্রক্রিয়া আরও কঠোর করা জরুরি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও বাড়তি সতর্কতা
বাংলাদেশের অনলাইন কেনাকাটার ধরনেও প্রতারকরা ভিন্ন কৌশল ব্যবহার করছে। আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটের মতো নিখুঁত এআই চিত্র ব্যবহার না করলেও, লোকাল মডেল ও ভিডিও সম্পাদনার মাধ্যমে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক পণ্যের অননুমোদিত ডিলার সেজে বা ফ্ল্যাগশিপ স্টোর দাবি করে নিম্নমানের চীনা পণ্য বিক্রি করার প্রবণতা দেখা যায়। তারা পণ্যের গায়ে ভুয়া আমদানিকারক স্টিকার ব্যবহার করে প্রতারণা করে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ অনলাইন কেনাকাটা ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম নির্ভর হওয়ায়, এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে দেখানো কোনও বিজ্ঞাপনের লিংক দেখেই কেনাকাটা না করে, সেই পেজ বা অ্যাকাউন্টের ‘পেজ ট্রান্সপারেন্সি’ বিভাগটি চেক করা উচিত।
গ্রাহকদের করণীয়: নিরাপদ থাকার উপায়
প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রতারকদের কৌশলও উন্নত হচ্ছে। তবে গ্রাহকদের কিছু বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করে ঝুঁকি কমানো সম্ভব-
অনলাইন রিভিউ যাচাই: কোনও পণ্য কেনার আগে ট্রাস্টপাইলট বা গুগল রিভিউয়ে অন্যান্য ক্রেতাদের অভিজ্ঞতা ও রেটিং ভালোভাবে দেখুন।
ফেরত ও শর্তাবলি পড়ুন: ওয়েবসাইটের রিটার্ন পলিসি (পণ্য ফেরত নীতি) এবং টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনস (শর্তাবলি) মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। এই শর্তাবলিতে প্রায়ই কোম্পানির প্রকৃত অবস্থান লুকিয়ে থাকে।
অতিরিক্ত নিখুঁত ছবি নিয়ে সতর্ক হোন: এআই-জেনারেটেড ছবি প্রায়শই অতিরিক্ত নিখুঁত, সাজানো এবং বাস্তবতার চেয়ে ভালো হয়।
অবিশ্বাস্য ছাড় এড়িয়ে চলুন: কোনও ওয়েবসাইটে যদি ৮০ শতাংশ বা ৯০ শতাংশ-এর মতো অবিশ্বাস্য ছাড় দেয়া হয়, তাহলে সেটি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করুন।
পেমেন্ট সতর্কতা (বাংলাদেশের জন্য): কোনোভাবেই ব্যক্তিগত মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে (যেমন: বিকাশ/নগদ) বড় অঙ্কের টাকা অগ্রিম পাঠানো উচিত নয়। সবচেয়ে নিরাপদ উপায় হলো ক্যাশ অন ডেলিভারি (COD) এবং পণ্য হাতে পাওয়ার আগে প্যাকেজটি খুলে মান যাচাই করে নেয়া।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার সহায়তা: প্রতারিত হলে দ্রুত বাংলাদেশের জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (DNCRP) এবং বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ-এর কাছে অভিযোগ দায়ের করুন।
এআই-এর এই যুগে, অনলাইন কেনাকাটায় গ্রাহকদেরকে চোখ-কান খোলা রেখে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। শুধুমাত্র লোভনীয় বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট না হয়ে, যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমেই সুরক্ষিত থাকা সম্ভব।
অনলাইনে প্রতারণা ক.বি/সোহেল মৃধা


							
							
							


