প্রতিবেদন

ক্রাউড ফান্ডিং নাকি ফাঁদ? অননুমোদিত হালাল বিনিয়োগে ঝুঁকিতে গ্রাহক

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে ‘হালাল বিনিয়োগ’, ‘ক্রাউড ফান্ডিং’, ‘লভ্যাংশ শেয়ারিং’ বা ‘ইকুইটি শেয়ারিং’-এর মতো মডেলগুলোতে সাধারণ মানুষের অর্থ বিনিয়োগের প্রবণতা বেড়েছে। শরিয়াহসম্মত লাভের আশায় হাজারও মানুষের কোটি কোটি টাকা এখন ঝুঁকিতে। উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখানো অনুমোদিত ক্রাউড ফান্ডিং প্ল্যাটফর্মগুলো কি আসলে পঞ্জি স্কিমের আধুনিক রূপ?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি। বিশেষত উচ্চ মুনাফার প্রলোভন ও শরিয়াহসম্মত উপায়ে উপার্জনের আকাঙ্ক্ষা থেকে মানুষ এসব মডেলের দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু এই বিনিয়োগ কতটা আইনসম্মত, নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত এই প্রশ্নগুলো নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে, যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এই নিবন্ধে বাংলাদেশের আইনি কাঠামো, বিনিয়োগের নিরাপত্তা এবং এই খাতের সার্বিক চিত্র বিশ্লেষণ করা হলো।

হালাল বিনিয়োগ ও ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মূল ধারণা
হালাল বিনিয়োগ মূলত শরিয়াহ (ইসলামী আইন) ভিত্তিক নীতি অনুসরণ করে পরিচালিত হয়, যেখানে সুদ (রিবা) ও অনৈতিক ব্যবসা নিষিদ্ধ। এর মূল ভিত্তি হলো ন্যায়, স্বচ্ছতা এবং প্রকৃত লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্ব। এক্ষেত্রে মুদারাবা (লাভ-লোকসান ভাগাভাগির ভিত্তিতে অপরের সম্পদে শ্রম বিনিয়োগ) এবং মুশারাকা (লাভ-ক্ষতি ভাগাভাগির ভিত্তিতে অংশীদারী ব্যবসা) মডেলগুলো বেশি ব্যবহৃত হয়। তবে, শরিয়াহ নীতি অনুযায়ী কোনও বিনিয়োগে নির্দিষ্ট বা স্থির মুনাফা দেয়া নিষিদ্ধ এই বিষয়টি উল্লেখ করে এই মডেলগুলোর শরিয়াহ্সম্মত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।

অন্যদিকে, ক্রাউড ফান্ডিং হলো একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কোনও প্রকল্প, ব্যবসা বা সামাজিক উদ্যোগের জন্য ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অল্প অল্প করে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। এটি মূলত দুই ধরনের হতে দেখা যায়- ইকুইটি-ভিত্তিক ক্রাউড ফান্ডিং এবং লভ্যাংশ শেয়ারিং ক্রাউড ফান্ডিং।

নিয়ন্ত্রক চোখ এড়িয়ে যাওয়া অন্ধকার বাজার
যারা হালাল বিনিয়োগ বা ক্রাউড ফান্ডিংয়ের নামে অনুমোদন ছাড়াই জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে, সেই অননুমোদিত বাজারের আকার বা লেনদেনের সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কাছে নেই। এই প্ল্যাটফর্মগুলো আইনি তদারকির বাইরে থাকায়, কী পরিমাণ টাকা লেনদেন হচ্ছে বা কত মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন, তার একটি অন্ধকার দিক রয়ে গেছে। তবে, উচ্চ মুনাফার প্রলোভন এবং ধর্মীয় অনুভূতির সুযোগ নিয়ে এই প্ল্যাটফর্মগুলো যে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করছে, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন সেই ইঙ্গিতই দেয়। জনসাধারণের মাঝে হালাল উপায়ে উপার্জনের তীব্র চাহিদা থাকায়, এই অননুমোদিত প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ অনিরাপদ খাতে চলে যাচ্ছে।

ই-কমার্স থেকে এগ্রো-ফার্ম: কেন এই খাতগুলোই প্রধান লক্ষ্য?
বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, মূলত উচ্চ প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনাময় এবং জনসম্পৃক্ত ক্ষেত্রগুলোতে এই ধরনের অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খাতগুলো হলো-
ই-কমার্স এবং এফ-কমার্স: দ্রুত বর্ধনশীল ই-কমার্স বা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নির্ভর ব্যবসা।
এগ্রো এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ: কৃষি খামার, ডেইরি ফার্মিং, পোল্ট্রি, বা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, যেখানে মুদারাবা/মুশারাকা মডেলের নাম ব্যবহার করা হয়।
ট্যুরিজম ও রিয়েল এস্টেট: ট্যুরিজম রিসোর্ট বা এগ্রো-ট্যুরিজম প্রকল্প।
আইটি ও স্টার্টআপ: প্রযুক্তি-ভিত্তিক নতুন উদ্যোগগুলো ইক্যুইটি ক্রাউড ফান্ডিং-এর নামে পুঁজি সংগ্রহ করে।

আইনগত বৈধতা ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রথাগত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও, সাধারণ জনগণের কাছ থেকে উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে হালাল বিনিয়োগ বা ইক্যুইটি ক্রাউড ফান্ডিং করার জন্য এই প্ল্যাটফর্মগুলোর কোনও সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রক কাঠামো নেই।

আইনের সীমাবদ্ধতা: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কর্তৃক জারি করা ‘অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড রুলস, ২০১৫’ মূলত পেশাদার বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রযোজ্য। সাধারণ জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের জন্য এই প্ল্যাটফর্মগুলোর সরকারি অনুমোদন নেই।

অনুমোদিত অর্থ সংগ্রহ: জনগণের কাছ থেকে আমানত বা বিনিয়োগ সংগ্রহের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক বা বিএসইসি-এর অনুমোদন নিতে হয়, যা এই প্ল্যাটফর্মগুলোর নেই। এ ধরনের অননুমোদিত অর্থ সংগ্রহ বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন।

গ্রাহকের পুঁজি রক্ষায় আইনি দুর্বলতা
আইনি কাঠামোর দুর্বলতা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকির অভাবের কারণে এসব প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
পঞ্জি স্কিম বা প্রতারণার ঝুঁকি: আইনগত তদারকির অভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান পঞ্জি স্কিমের আদলে কাজ করতে পারে। অর্থাৎ, তারা নতুন বিনিয়োগকারীর টাকা দিয়ে পুরোনো বিনিয়োগকারীকে লভ্যাংশ দেখায়। এই প্ল্যাটফর্মগুলো প্রায়শই অবাস্তব ও নির্দিষ্ট লভ্যাংশের (যেমন মাসিক ৩-৫ শতাংশ) প্রলোভন দেয়, যা শরিয়াহ নীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং পঞ্জি স্কিমের প্রধান লক্ষণ।

মূলধন হারানোর ভয়: এই বিনিয়োগগুলো ভেঞ্চার ক্যাপিটালের আদলে পরিচালিত হলেও, নিয়ন্ত্রণের অভাবে এখানে অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকি থাকে এবং ব্যবসার ব্যর্থতায় বিনিয়োগকারীরা পুরো মূলধন হারাতে পারেন।

স্বচ্ছতার অভাব: অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে বিনিয়োগ করছে বা লাভ-ক্ষতি হচ্ছে তার বিস্তারিত ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য প্রকাশ করে না।

অনুমোদনহীন অর্থ সংগ্রহ: শাস্তির বিধান ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ
বাজারে বিভিন্ন সময় আলোচনায় আসা কিছু প্ল্যাটফর্ম ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা শরিয়াহসম্মত বিনিয়োগের দাবি করে বা ইক্যুইটি শেয়ারিংয়ের নামে অর্থ সংগ্রহ করে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রজন্ম প্লাস, আইসিবি (সেভেন ব্রিজেস ক্যাপিটাল) এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর নাম এসেছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র ট্রেড লাইসেন্স বা আরজেএসসি’তে সীমিত দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠানহিসেবে নিবন্ধন নিয়েই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পুঁজি সংগ্রহ করে, যা তাদের আর্থিক জবাবদিহিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যদি বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এই ধরনের প্রতিষ্ঠান অনুমোদিত না হয় এবং তারা জনগণের কাছ থেকে বিনিয়োগ সংগ্রহ করে, তবে তা আইন লঙ্ঘন।

আইনি বিধান: লাইসেন্সবিহীন অর্থায়ন ব্যবসা পরিচালনা করা এবং পঞ্জি স্কিমের মাধ্যমে প্রতারণা করা বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এবং দণ্ডবিধি অনুযায়ী গুরুতর অপরাধ। এই অপরাধের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ: এই দিকটি তদারকির জন্য প্রধানত বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) দায়িত্বপ্রাপ্ত। প্রতারণা বা অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (যেমন সিআইডি/ডিবি) তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে।

অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও অর্থ সংগ্রহকারী প্ল্যাটফর্মগুলোর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর উচিত অবিলম্বে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারী ঝুঁকিমুক্ত থাকে। হালাল বিনিয়োগ ও ক্রাউড ফান্ডিংয়ের ধারণাটি অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সুস্পষ্ট অনুমোদন ও তদারকি ছাড়া সাধারণ জনগণের কাছ থেকে এমন বিনিয়োগ সংগ্রহ গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করে।

গ্রাহকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং প্রতারণা থেকে রক্ষা করতে, সরকারের উচিত অবিলম্বে এই ধরনের বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ও কঠোর আইনগত কাঠামো তৈরি করা এবং তাদের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি, সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরও উচ্চ মুনাফার প্রলোভন উপেক্ষা করে, যেকোনো বিনিয়োগের আগে প্রতিষ্ঠানটির আইনি বৈধতা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন ভালোভাবে যাচাই করা অত্যাবশ্যক।

বিশেষ সতর্কতা:
এই নিবন্ধটি একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন, কোনও বিনিয়োগের পরামর্শ নয়। যেকোনও প্রকার হালাল বিনিয়োগ, ক্রাউড ফান্ডিং বা লভ্যাংশ শেয়ারিং মডেলে অর্থ বিনিয়োগ করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আইনি বৈধতা, নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য পাঠকদের নিজস্ব সতর্কতা ও যথাযথ যাচাই-বাছাই করা অত্যাবশ্যক। কোনও প্রতারণামূলক কার্যক্রমে আর্থিক ক্ষতির জন্য এই নিবন্ধ বা প্রকাশনা কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই দায়ী থাকবে না।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *