প্রতিবেদন

বাংলাদেশ কি জিটিসি’র ডেটা সেন্টার স্থাপনের জন্য উপযুক্ত?

মো. আরিফুল হক: গুগল, ফেসবুক এবং অ্যাকামাই ইত্যাদি গ্লোবাল টেকনোলোজি কোম্পানি (জিটিসি) ডেটা সেন্টার নির্মাণের জন্য স্থান বাছাই করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে, যা তাদের সেবার মান এবং অবকাঠামোর স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়। এখানে মূল বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো…….

ব্যবহারকারীদের নিকটবর্তীতা
জিটিসি তাদের ডেটা সেন্টার ব্যবহারকারীদের যথাসম্ভব নিকটে স্থাপন করে, যার ফলে লেটেন্সি হ্রাস পায় এবং পরিষেবাগুলোর গতি বাড়ে। এটি গুগল সার্চ, ফেসবুক, ইউটিউব এবং অন্যান্য ক্লাউড পরিষেবায় দ্রুততর অ্যাক্সেস প্রদান করে। ২০২৪ সালের হিসাবে, বাংলাদেশে ফেসবুকের প্রায় ৫.৩ কোটি ব্যবহারকারী রয়েছে, যা এটিকে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে পরিণত করেছে।

অন্যদিকে, গুগল তাদের ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রকাশ করে না, তবে বাংলাদেশে উচ্চ ইন্টারনেট প্রবেশ হার (৪৪% এর বেশি জনসংখ্যা অনলাইনে), বিবেচনা করে ধারণা করা যায় যে, গুগলের বিভিন্ন সেবা যেমন- ইউটিউব, জিমেইল এবং সার্চ কয়েক কোটি বাংলাদেশির দ্বারা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় (Demand Sage)(Data Reportal- Global Digital Insights)। এই সংখ্যাগুলো বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ডিজিটাল উপস্থিতি এবং প্রবৃদ্ধি প্রতিফলিত করে, ফলে বাংলাদেশকে ফেসবুক এবং গুগলের মতো প্রযুক্তি জায়ান্টদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে দেখা যায়।

মো. আরিফুল হক
টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী

নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ
ডেটা সেন্টারগুলো প্রচুর বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, তাই জিটিসি এমন অবস্থান বেছে নেয় যেখানে নির্ভরযোগ্য এবং স্থিতিশীল বিদ্যুৎ সরবরাহ রয়েছে। টেকসই লক্ষ্য পূরণে বায়ু, সৌর বা জলবিদ্যুৎ শক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস থাকা এলাকাগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।

২০২৪ সালে, বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৬,৭০০ মেগাওয়াট। তবে প্রকৃত চাহিদা প্রায় ১৫,৫০০ মেগাওয়াট। সঠিক পরিকল্পনা এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশে ডেটা সেন্টার নির্মাণের জন্য নির্ভরযোগ্য এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব।

বাংলাদেশে ডেটা সেন্টারগুলোর কনটেন্ট ক্যাশিংয়ের জন্য উচ্চ ক্ষমতা ও নির্ভরযোগ্য সাবমেরিন ক্যাবলের সক্ষমতা রয়েছে

মো. আরিফুল হক

কুলিংয়ের জন্য পানির প্রাপ্যতা
ডেটা সেন্টার প্রচুর তাপ উৎপন্ন করে, তাই কুলিংয়ের জন্য পানি ব্যবহার করা হয়। এমন জায়গাগুলো বেছে নেয়া হয় যেখানে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ রয়েছে, যা ডেটা সেন্টারগুলোর কার্যকারিতা বজায় রাখতে সহায়ক। বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কুলিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পানির ব্যবস্থা রয়েছে। সুতরাং, ডাটা সেন্টার কুলিংয়ের জন্য পানির যথেষ্ট প্রাপ্যতা রয়েছে।

তাপবিদ্যুৎ এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে পানি ব্যবহার করা হয় এবং এই পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে মূলত বড় নদী বা জলাশয়ের কাছে। তাই ডেটা সেন্টারের জন্যও পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা সম্ভব।

উচ্চ ক্ষমতা ও নির্ভরযোগ্য সাবমেরিন ক্যাবল অবকাঠামো
ডেটা সেন্টারগুলো তাদের কনটেন্ট ক্যাশিংয়ের জন্য উচ্চ ক্ষমতা ও নির্ভরযোগ্য সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে সরবরাহকৃত ব্যান্ডউইডথ ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশ বর্তমানে দুটি আন্তর্জাতিক সাবমেরিন ক্যাবলের সঙ্গে সংযুক্ত। SMW4 এবং SMW5 নামের দুটি সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে দেশে প্রায় ২,৯০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ করা হয়, যার মোট সক্ষমতা প্রায় ৭,২০০ জিবিপিএস।

এ ছাড়া তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল SMW6 প্রকল্প চলমান রয়েছে, যা ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ প্রায় ১৩,২০০ জিবিপিএস অতিরিক্ত ব্যান্ডউইডথ সক্ষমতা অর্জন করবে। এতে করে দেশের মোট ব্যান্ডউইডথ ক্ষমতা ২০,৪২০ জিবিপিএস-এর বেশি হবে। সুতরাং বাংলাদেশে ডেটা সেন্টারগুলোর কনটেন্ট ক্যাশিংয়ের জন্য উচ্চ ক্ষমতা ও নির্ভরযোগ্য সাবমেরিন ক্যাবলের সক্ষমতা রয়েছে।

ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক অবকাঠামো
জিটিসিগুলোর নির্ভরযোগ্য এবং উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন নেটওয়ার্ক সংযোগের প্রয়োজন। এমন স্থানে তারা ডেটা সেন্টার স্থাপন করে, যেখানে বিদ্যমান ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে ভালো সংযোগ রয়েছে, যা ডেটা সেন্টার এবং ব্যবহারকারীদের মধ্যে দ্রুত ডেটা পরিবহনে সহায়তা করে। বাংলাদেশের অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে যাতে দ্রুত ইন্টারনেট এবং আধুনিক টেলিকমিউনিকেশনসের জন্য বাড়তি চাহিদা পূরণ করা যায়।

দেশের অপটিক্যাল ফাইবার অবকাঠামো সম্প্রসারণ করা হচ্ছে, যেখানে বেসরকারি কোম্পানি এবং সরকারি প্রকল্পগুলো দুইই অংশগ্রহণ করছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ রেলওয়ে তার বিস্তৃত ফাইবার নেটওয়ার্ক বিভিন্ন টেলিকম এবং ইন্টারনেট প্রদানকারীদের লিজ দিয়েছে, যা দেশের ইন্টারনেট গতির উন্নতি করবে। সামিট কমিউনিকেশনস এবং ফাইবার এট হোমের মতো কোম্পানিগুলোর ফাইবার নেটওয়ার্ক ৫০,০০০ কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ, যা বাংলাদেশে উন্নত সংযোগ এবং রিডান্ডেন্সি নিশ্চিত করছে (দ্য ডেইলি স্টার)।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ প্রকৌশলী স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন যারা ডেটা সেন্টারের নির্মাণ এবং পরিচালনার জন্য দক্ষ কর্মী হিসেবে কাজ করতে সক্ষম

মো. আরিফুল হক

এ ছাড়াও, বাংলাদেশ সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প অনুমোদন করেছে যা বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) এর ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নত করবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ফাইভ জি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং উপজেলা স্তরেও ইন্টারনেট অ্যাক্সেস উন্নত হবে। ২০২৪ সালের মধ্যে বিটিসিএল ৩,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি বিস্তৃত অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ১০০ গিগাবিট প্রতি সেকেন্ড ডেটা গতির লক্ষ্যে পৌঁছানোর পরিকল্পনা করেছে। এই উন্নয়নগুলো প্রমাণ করে যে দেশের স্থানীয় অপটিক্যাল নেটওয়ার্ক নির্ভরযোগ্য এবং উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি
প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- ভূমিকম্প, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে জিটিসিগুলো ডেটা সেন্টারের স্থান নির্ধারণ করে। দুর্যোগের সম্ভাবনা কম এমন এলাকাগুলো ডাউনটাইমের ঝুঁকি কমায়। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকিমুক্ত একাধিক স্থান রয়েছে এবং বর্তমানে গ্রামীণফোন, রবির মত অনেক গ্লোবাল কোম্পানির একাধিক ডেটা সেন্টার রয়েছে।

জমি এবং নির্মাণের খরচ
জমির মূল্য এবং নির্মাণ খরচও জিটিসিগুলোর অবস্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কম খরচে ডেটা সেন্টার নির্মাণ এবং পরিচালনা করা সম্ভব এমন এলাকাগুলো জিটিসিগুলোর জন্য আকর্ষণীয়। বাংলাদেশে ডেটা সেন্টার নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জমি এবং নির্মাণের খরচ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।

সরকারি নিয়মনীতি ও প্রণোদনা
কিছু কিছু দেশে জিটিসিগুলোকে অনুকূল সরকারি নিয়মনীতি বা প্রণোদনা, যেমন করছাড় বা ভর্তুকি দেয়া হয়, যা জিটিসিগুলোর জন্য একটি ডেটা সেন্টার স্থাপনকে আর্থিকভাবে আরও সুবিধাজনক করে তোলে। বাংলাদেশ সরকার জিটিসিগুলোকে দেশে ডেটা সেন্টার নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা প্রদান করতে পারে এতে দেশে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে, যা দেশের বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

দক্ষ জনবলের প্রাপ্যতা
ডেটা সেন্টারের নির্মাণ এবং পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবলের প্রয়োজন। জিটিসিগুলো ডেটা সেন্টারের নির্মাণের জন্য এমন স্থানগুলো বেছে নেয় যেখানে স্থানীয় দক্ষ জনবলের প্রাচুর্য থাকে বা যেখানে কর্মী আকর্ষণ করা সহজ হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ২০,০০০ প্রকৌশলী স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন যারা ডেটা সেন্টারের নির্মাণ এবং পরিচালনার জন্য দক্ষ কর্মী হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। প্রয়োজনে বাংলাদেশি প্রকৌশলী যারা বিদেশে ডেটা সেন্টারের নির্মাণ এবং পরিচালনায় দক্ষ তাদেরকে দেশে এনে এ কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে যেটা আমাদের প্রতিবেশী দেশে করা হয়েছে।

টেকসই লক্ষ্যমাত্রা
জিটিসিগুলো তার টেকসই লক্ষ্য এবং কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই তারা এমন স্থানগুলোকে অগ্রাধিকার দেয় যেখানে সবুজ প্রযুক্তির সংযোজন সহজ এবং নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের কাছাকাছি অবস্থিত। দেশের পরিবেশগত এবং স্থিতিশীলতার বৃহত্তর লক্ষ্যগুলোর অংশ হিসেবে, নবায়নযোগ্য শক্তির সক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলেছে।

উপর্যুক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে, বাংলাদেশ গুগল, ফেসবুক এবং অ্যাকামাই সহ অন্যান্য গ্লোবাল টেকনোলজি কোম্পানির (জিটিসি) পরবর্তী এজ ডেটা সেন্টার স্থাপনের জন্য একটি উপযুক্ত স্থান হতে পারে।

লেখক: মো. আরিফুল হক, টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *