অন্যান্য মতামত

ফেসবুক উদ্যোক্তা এবং ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সামগ্রিক দাবি

কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জুলাই ট্রাজেডি এবং ইন্টারনেট শাটডাউনের ফলে সামগ্রিকভাবে ফেসবুকের ওপর নির্ভরশীল উদ্যোক্তারা ই-ক্যাব মেম্বার, এই খাতের সাড়ে তিন লাখেরও বেশি এসএমই উদ্যোক্তা, প্র্যায় ৩৫ লাখের মতো মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য করণীয় প্রসঙ্গে। লিখেছেন মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)

আমাদের বাংলাদেশ হলো ই-কমার্স এর জন্য ৩১তম বৃহত বাজার বিশ্বের সমস্ত দেশগুলোর মধ্যে। যার আর্থিক বাজার মূল্য আনুমানিক প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা, আনুমানিক প্রায় ১২ কোটির মত মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এবং আনুমানিক প্রায় ১০ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারি আছে। যার মধ্যে ১০% ব্যবহারকারি প্রায় ১ কোটি ব্যবহারকারি ই-কমার্স খাতে অর্ডার বা সেবা নিয়ে থাকেন। যার মধ্যে ১৫ লাখ মানুষ ই-কমার্সে অর্ডার করে থাকেন প্রায় প্রতিদিন।

দৈনিক প্রায় ৮ লাখের অধিক অর্ডার হয় এবং প্রতি অর্ডারে বাস্কেট সাইজ ১২৫০ থেকে ১৪৫০ এর মত। দৈনিক ই-কমার্স এর লেনদেন হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকার মত। ই-ক্যাবের প্রায় ২৭০০ সদস্যসহ আনুমানিক প্রায় সাড়ে তিন লাখ ফেসবুক পেজ আছে যারা এফ কমার্স এবং ইনস্টাগ্রামে বিজনেস করে থাকেন। তিন লাখ ফেসবুক পেজে যারা বিজনেস করেন তাদের ৯৭% এসএমই বা ছোট উদ্যোক্তা। দৈনিক প্রায় ২ লাখ ডলারের অধিক ফেসবুক অ্যাড বাবদ বাংলাদেশ থেকে নিয়ে থাকে।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)

বর্তমান বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে ই-কমার্স বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এসএমই উদ্যোক্তা যারা বিজনেস করছেন তারা যে বিশাল পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন বিগত সময় হয়েছেন এবং সামনের দিনগুলোতে হবেন এবং তার যে প্রভাব ৩৫ লাখ লোকের ওপর পড়বে এ থেকে সহসাই উত্তরণের উপায় নেই যদি না ট্রেড বডি, সরকার, অংশীজন এবং বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেদের দাবিগুলো তুলে না ধরি।

আগামী দিনগুলোতে যে পরিমাণ খরচের ধাক্কায় পড়ছি বা পড়বে ছোট উদ্যোক্তাগন তাতে অনেকের টিকে থাকা এবং ব্যবসা থেকে ছিটকে পরে বেকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যদি না সরকার এবং অংশীজন থেকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত হয়। ফেসবুক উদ্যোক্তা এবং ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সামগ্রিক দাবিগুলো….

ই-কমার্স খাতের উদ্যোক্তাদের স্বার্থে মৌলিক অধিকার হিসেবে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ইন্টারনেটের নিশ্চিত করা। ডিজিটাল বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসাকে ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্প হিসেবে ঘোষণা দেয়া। ট্রেড লাইসেন্স ক্যাটাগরিতে ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসাকে সংযুক্ত করা।

আগামী ১২ মাসের জন্য ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের ব্যবসা সংক্রান্ত এবং ব্যক্তিগত সমস্ত লোনের ইন্টারেস্ট মওকুফ করা অথবা একেবারে নমিনাল পর্যায়ে নিয়ে আসা। লোনের কিস্তিগুলোকে শুধুমাত্র মূল টাকাগুলো নিয়ে লোনকে সচল রাখা। এটাকে আমরা ১২ মাসের পেমেন্ট হলিডে হিসেবে আখ্যা দিতে পারি।

ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের জামানতবিহীন লোনের ব্যবস্থা করা। চিরাচরিত অফলাইন ব্যবসার মতো ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের অনেক সময় মেশিনারি, স্টাবলিশমেন্ট অনেক সময় থাকে না। এদের থাকে টেকনোলজি, গুড উইল, কাস্টমার ডাটা, কুরিয়ার ডাটা, ফেসবুক লাইক বা রিচ অথবা ওয়েবসাইটের গ্রহণযোগ্যতা। এগুলো বিবেচনা করেই লোনের ব্যবস্থা করা।

চলতি অর্থ বছরের ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত বা ব্যবসায়িক সমস্ত ভ্যাট ট্যাক্স মওকুফ করা। ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট ট্যাক্স মওকুফ করা। ফেসবুক অ্যাড এর জন্য প্রদত্ত ১৫% ভ্যাট সহ। ই-কমার্স ব্যবসাহীদের বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সরাসরি আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা।

ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত কার্ড, অনলাইন ট্রানজেকশন, এমএফএস এর ট্রানজেকশনগুলো আগামী ৬ থেকে এক বছর পর্যন্ত চার্জ মওকুফ করা। চলতি বছরের ট্রেড লাইসেন্স রিনিউর ক্ষেত্রেও শুধুমাত্র রিনিউয়াল ফি নেয়া, উৎসে কর কর্তন বাদ দিয়ে। সেন্ট্রাল লজিস্টিক ট্রাকিং সিস্টেমের মাধ্যমে সবার সেলস, ব্যবসায়ের গ্রোথ এবং কোম্পানি সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়ার ব্যবস্থা করা।

পৃথিবীর প্রায় অন্যান্য দেশে যেখানে ই-কমার্স গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে সেখানেই ই কমার্স ক্যাশলেস হয়েছে। বাংলাদেশে এখনও ক্যাশ অন ডেলিভারিতে হয়, কিন্তু ক্যাশলেস করার জন্য বাংলাদেশের এমএসএস কোম্পানিগুলোর মাধ্যমেই লেনদেন বেশি করাতে হলে ই-কমার্সের ক্ষেত্রে এমএমএস কোম্পানির সার্ভিস চার্জ ০.৫ টাকাতে নামিয়ে আনা এবং পেমেন্ট গেটওয়ের চার্জও ০.৬ টাকার মধ্যেই রাখার ব্যবস্থা করা। এটির ইফেক্ট আল্টিমেটলি কাস্টমার পাবে প্রাইস কমে যাবে। ফেসবুক অ্যাড এর ক্ষেত্রে অ্যাড লিমিট প্রত্যেকটা ই-কমার্স ব্যবসায়ীর জন্য বাৎসরিক মিনিমাম ত্রিশ হাজার ডলার করে দেয়া উচিত।

দেশীয় পণ্য দেশের বাইরে প্রচার-প্রসারের জন্য ক্রস বর্ডার ই-কমার্সকে উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত, সেক্ষেত্রে কুরিয়ার চার্জ ভ্যাট ট্যাক্স এর বিষয়গুলোকে ক্রস বর্ডারের জন্য শিথিল করা যেতে পারে। বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল পোস্টাল সার্ভিসকে আরও বেশি যুগোপযোগী এবং গ্রহণযোগ্য করে ক্রস বর্ডারকে উৎসাহিত করা উচিত।

আন রেস্ট অবস্থায় যেহেতু বাংলাদেশের টোটাল ইন্টারনেট শাটডাউন ছিল এবং যে সমস্ত অ্যাড ফেসবুকে রানিং অবস্থায় ছিল এবং যাদের টার্গেট গ্রুপ ছিল শুধুমাত্র বাংলাদেশ তাদের কোন ফেসবুক অ্যাড টার্গেট গ্রুপে কাজ করেনি। তাই ই-ক্যাব মেম্বারসহ ই-কমার্স এর যারাই এই সময়ে অ্যাডের টাকা বার্ন করেছেন, সরকারের সহযোগিতার মাধ্যমে ফেসবুকের সঙ্গে আলোচনা করে সমপরিমাণ টাকার ক্রেডিট লিমিটের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য কাজ করে যাওয়া।

বাংলাদেশে আনুমানিক প্রায় দুই লাখ ডলারের সমপরিমাণ টাকা অ্যাডে ব্যয় হয় একদিনে। প্রথম দিকে আট দিনে ব আনুমান ১৬ লাখ ডলারের ফেসবুক অ্যাডে ব্যয় হয়েছে যাতে করে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের কোন কাজই হয়নি। ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য এবং ব্যবসা পুনরায় চালু করতে সহায়তা করার জন্য সরকারি অনুদান বা সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।

ভাঙচুরের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়িক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা। ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা সহজীকরণ করা। ই-কমার্সের গুরুত্ব এবং এর অবদান সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। ই-কমার্স খাতের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা।

ই-কমার্স ব্যবসায়ী হিসেবে আমি, আপনি এবং আমরা সম্মিলিতভাবে এ বিষয়ে অগ্রণী এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি বা রাখার সুযোগ আছে যদি ওপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে উত্থাপন করার মাধ্যমে যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারি। তাহলে ই-কমার্স খাতের সবাই বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন থেকে নিজেদেরকে কিছুটা হলেও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে এবং উদ্যোক্তা হয়তো কিছুটা হলেও তাদের উত্তরণের সুযোগ পাবেন।

লেখক: সোহেল মৃধা (মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা) – ফাউন্ডিং মেম্বার ই-ক্যাব এবং ফাউন্ডার কিনলে ডটকম

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *