নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসএমপি গাইডলাইন চালু করলেও বাস্তবায়ন করেনি
ক.বি.ডেস্ক: দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে স্থিতিশীলতা ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে সিগনিফিক্যান্ট মার্কেট পাওয়ার (এসএমপি) গাইডলাইনের কার্যকর বাস্তবায়নের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ২০১৮ সালে এসএমপি গাইডলাইন চালু করলেও এর গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো কার্যকরভাবে পর্যালোচনা বা বাস্তবায়ন করেনি। এসএমপি গাইডলাইন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে ছোট অপারেটরদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। একইসঙ্গে, অবকাঠামো শেয়ারে উৎসাহ বাড়বে এবং এই খাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন বক্তারা।
আজ মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) ঢাকার একটি হোটেলে টেলিকম রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (টিআরএনবি) আয়োজিত “টেলিযোগাযোগ খাত: বিনিয়োগে ধীরগতি ও অসম প্রতিযোগিতা” শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এই মতামত তুলে ধরেন।
গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) এমদাদ উল বারী। বক্তব্য রাখেন প্রতিযোগিতা কমিশনের সাবেক পরিচালক মো. খালেদ আবু নাসের, ফরেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহী পরিচালক টি আই এম নুরুল কবির, এমটব’র সেক্রেটারি জেনারেল লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব) মো. জুলফিকার। সভাপতিত্ব করেন টিআরএনবি’র সভাপতি সমীর কুমার দে এবং মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংগঠনিক সম্পাদক আল আমিন দেওয়ান।
আরও বক্তব্য রাখেন বাংলালিংকের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স তাইমুর রহমান, বাংলালিংকের কোম্পানি সেক্রেটারি জহরত আদিব চৌধুরী, রবির হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স সাহেদুল আলম, টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল মাবুদ চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম।
মূলপ্রবন্ধে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের মধ্যে একটি একক বৃহৎ অপারেটরের আধিপত্যের কারণে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। যদিও এই অবস্থা থেকে উত্তরণে ৪ বছর আগেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসএমপি গাইডলাইন নিয়ে আসার মতো পদক্ষেপ নিয়েছিল। মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের (এমএনও) ধারাবাহিক বিনিয়োগ সত্ত্বেও, প্রতিবছর গ্রাহকপ্রতি গড় আয় (এআরপিইউ) কমে যাচ্ছে। বর্তমানে ১.৩ মার্কিন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। কমতে থাকা এই এআরপিইউ-এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচ্চ করের বোঝা, এই খাতের প্রবৃদ্ধিকে গতিহীন করছে। উচ্চ কর ও তীব্র প্রতিযোগিতা ছোট অপারেটরদের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে; ফলে, খাতটির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
এসএমপি অপারেটরটি বর্তমানে বাজার হিস্যার ৯০ শতাংশেরও (নেট প্রফিট আফটার ট্যাক্স) বেশি লাভ করছে। রাজস্ব বাজারের ৫০ শতাংশের মতো বাজার তাদের দখলে; এমনকি, শেয়ারযোগ্য অবকাঠামোর ৫০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করলেও তারা তা শেয়ার করতে অনাগ্রহী। এতে করে এই খাতে কেবল নতুন বিনিয়োগকারীরাই নিরুৎসাহিত হচ্ছে না; বরং, বাজারে থাকা পক্ষগুলোও নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ২০১৮ সালে এসএমপি গাইডলাইন চালু করলেও এর গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো কার্যকরভাবে পর্যালোচনা বা বাস্তবায়ন করেনি। এসএমপি নীতিমালার ধারা ৭(১১)-তে বার্ষিক পর্যালোচনার নির্দেশনা থাকলেও তা উপেক্ষিত হয়েছে। এমনকি, বর্তমানে এর বাস্তবায়ন এই খাতের ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে খুব সামান্যই প্রভাব ফেলছে।
মে. জে. (অব) এমদাদ উল বারী বলেন, “নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিটিআরসি’র নিজের কোনও ক্ষমতা নেই, আমাদের সরকারের কাছ থেকে পূর্ব অনুমোদন নিতে হয়। এটি অসম প্রতিযোগিতার পেছনে মুল সমস্যা। বিভিন্ন আইনে ও নীতিমালায় আকস্মিক পরিবর্তন আরেকটি সমস্যা। তবে, এসএমপি প্লেয়ারের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। খাত সংশ্লিষ্টদের মাঝে সহযোগিতা বা অংশীদারিত্বের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। টেলিকম খাতের উচিত হবে গ্রাহকদের ক্ষমতায়নে আরও মনোনিবেশ করা। সেবার মান বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ব্যবসাকে সমর্থন করা হবে।”
মো. খালেদ আবু নাসের বলেন, “১৫ অক্টোবর থেকে প্রতিযোগিতা কমিশন অকার্যকর। এদিকে, বিটিআরসি’র সঙ্গে কমিশনের তেমন কোনো লিয়াজোঁ নেই। ফলে, একচেটিয়া বাজার তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় পুরো টেলিকম খাতের পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরও কার্যকর করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।”
টিআইএম নুরুল কবির বলেন, “কাউকে রাজনৈতিক সুবিধা না দিয়ে বরং ভাবতে হবে আমাদের একীভূত লাইসেন্স মডেল প্রয়োজন কিনা। তবে এই খাতের উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বিটিআরসি’র রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা উচিত। পাশাপাশি, আরও বেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য আইন ও নীতিমালার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
লে. কর্নেল (অব) মো. জুলফিকার বলেন, “টেলিযোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। এই খাতে অনেকেই বিনিয়োগ করেছে। আরও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই খাতের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে পুরো খাতকে সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতির মধ্য থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।”
তাইমুর রহমান বলেন, “ইতোমধ্যে যেসব নিয়মনীতি আছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। অপারেটরদের মধ্যে অবকাঠামো ভাগাভাগি করার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে বিদ্যমান বা নতুন আইনে এ সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা রাখতে হবে। সামনে যেহেতু এআই এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আসছে, আমাদেরকে বাজারে প্রতিযোগিতা কীভাবে আরও বাড়ানো যাবে সে বিষয়ে মনোনিবেশ করতে হবে।”
জহরত আদিব চৌধুরী বলেন, “মোবাইল অপারেটররা অনেক ভালো ভূমিকা রাখছে; ডিজিটাল বিভাজন দূর করতে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে অপারেটররা আরও বিনিয়োগ করতে পারছে না। এ পরিস্থিতির উন্নয়নে কোনো নির্দিষ্ট অপারেটরকে সুবিধা না দিয়ে খাত-বান্ধব আইন ও নিয়মাবলী, বিশেষ করে সিগনিফিক্যান্ট মার্কেট পাওয়ার (এসএমপি) গাইডলাইনের বাস্তবায়ন করা দরকার।”
সাহেদুল আলম বলেন, “ন্যায্য বাজার প্রতিযোগিতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু বাস্তবতা হলো টেলিকম খাতে সুস্থ প্রতিযোগিতার কোনও পরিবেশ নেই। একটি অপারেটর প্রতি বছর বিপুল মুনাফা অর্জন করছে। এর কারণ হলো টেলিকম বিধিমালা বৃহৎ অপারেটরদের সুবিধা দিচ্ছে, অন্যদিকে ছোট অপারেটরদের প্রবৃদ্ধি ব্যাহত করছে।”
নুরুল মাবুদ চৌধুরী বলেন, “অসম প্রতিযোগিতার এতোটাই খারাপ অবস্থা যে, এইটা নিয়ে বলার পরিস্থিতিই নেই। অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিদ্যমান এই প্রতিযোগিতার মাঝে টেলিটক কষ্ট করে টিকে আছে।”
রাশনা ইমাম বলেন, “টেলিযোগাযোগ খাতে সুস্থ প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে এবং বিদ্যমান বিনিয়োগ ধরে রাখতে প্রতিযোগিতা আইন নিয়ে কথা বলতে হবে। এসএমপি গাইডলাইনে ২০টি ধারা আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন করা হয়েছে মাত্র তিনটি, যা বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠায় তেমন ভূমিকা রাখেনি। বিটিআরসি’কে আইনে ক্ষমতা দেয়া আছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সেই ক্ষমতার কার্যকর ব্যবহার করা হচ্ছে না।”
সকল অপারেটরের জন্য সমতাভিত্তিক ক্ষেত্র তৈরি করতে এবং মোবাইল টেলিকম খাতে প্রতিযোগিতা বাড়াতে এসএমপি নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়নের প্রতি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আহ্বান জানান বক্তারা। এই খাতের টেকসই প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ আকর্ষণ ও দীর্ঘমেয়াদী গ্রাহক সুবিধা নিশ্চিত করতে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।