প্রতিবেদন

আইএসপি ও গ্রাহকের দুশ্চিন্তা: নতুন টেলিযোগাযোগ নীতি কি ইন্টারনেটের মূল্য বাড়াবে?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) কর্তৃক প্রণীত ‘‘টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং লাইসেন্সিং নীতি ২০২৫’’-এর খসড়া নির্দেশিকা দেশের ইন্টারনেট খাতে এক গভীর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। দেশীয় উদ্যোক্তা ও গ্রাহকের স্বার্থের সংঘাত, না কি টেলিকম খাতে যুগান্তকারী শৃঙ্খলা?

দেশের ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) এই খসড়াকে ‘দেশীয় উদ্যোক্তার স্বার্থবিরোধী’ ও ‘অন্যায্য মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কাজনক সূচনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সেখানে সরকার এই নীতিকে বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটিয়ে এক আধুনিক কাঠামোর সূচনা বলছে। এই নীতি কার্যকর হলে একদিকে যেমন গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের মূল্য বাড়বে বলে আইএসপিগুলো আশঙ্কা করছে, তেমনি অন্যদিকে সরকার এর মাধ্যমে গ্রাহকসেবার মান বৃদ্ধি ও সুলভ মূল্য নিশ্চিত করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দেখাচ্ছে।

বিটিআরসি’র দৃষ্টিকোণ থেকে কেন নতুন নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা?
বহু বছর ধরে চলতে থাকা পুরোনো লাইসেন্সিং কাঠামোতে বেশ কিছু অসামঞ্জস্যতা ছিল। দেশে বর্তমানে প্রায় ২৬ ধরনের লাইসেন্স আছে এবং প্রায় তিন হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান এই লাইসেন্সগুলো ব্যবহার করে সেবা দিচ্ছে। এই অতিমাত্রায় স্তরায়ন প্রায়শই সেবার মান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। বিটিআরসি মূলত এই জটিলতা দূর করে লাইসেন্স সংখ্যা হ্রাস এবং খাতটিকে আরও সুসংগঠিত করার লক্ষ্য নিয়ে এই সংস্কারমূলক নীতিমালা নিয়ে এসেছে।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যবের মতে, “এই নীতির মাধ্যমে দীর্ঘদিনের অকার্যকর ও মধ্যস্বত্বভোগী নির্ভর লাইসেন্সিং ব্যবস্থা বাদ দেয়া হয়েছে। এই সংস্কারের পেছনে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) এবং গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস অ্যাসোসিয়েশন (জিএসএমএ)- এর চাপও একটি কারণ, যারা ২০১৫ সাল থেকেই বাংলাদেশকে একটি সহজ লাইসেন্সিং ব্যবস্থা নিয়ে আসার জন্য চাপ দিচ্ছিল। সরকারের মূল উদ্দেশ্য হলো লাইসেন্সকে তিনটি মূল স্তরে (ANSP, NICSP, ICSP) সীমাবদ্ধ করে দক্ষতা বৃদ্ধি করা। এর মাধ্যমে গ্রাহকসেবার মান নিশ্চিত করতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ন্যূনতম গতি ১৫ এমবিপিএস এবং মোবাইল ইন্টারনেটের গতি ১০ এমবিপিএস নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও, অতিরিক্ত মধ্যস্বত্বভোগী কমিয়ে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো হবে, যা পরবর্তীতে গ্রাহককে সুলভ মূল্যে সেবা দিতে শুল্ক শিথিলতা বা ভর্তুকি দেয়ার সুযোগ তৈরি করবে।”

গ্রাহক বঞ্চনা ও মূল্যবৃদ্ধির শঙ্কা: পরিসংখ্যানগত তথ্য
নতুন খসড়া গাইডলাইনটির সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে সাধারণ গ্রাহকের ওপর। আইএসপিএবি’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রস্তাবিত নীতিমালায় বিভিন্ন ফি ও চার্জ আরোপের কারণে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবার খরচ অতিরিক্ত প্রায় ১৮.৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এই বৃদ্ধি মূলত কয়েকটি কারণে ঘটছে-

লাইসেন্স ফি ও বাৎসরিক ফি বৃদ্ধি: মাত্র তিন বছর আগে একবার ফি বৃদ্ধির পরও, নতুন নীতিমালায় বর্তমান লাইসেন্স ফি নূন্যতম ৫ গুণ এবং বাৎসরিক ফি নূন্যতম ১০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এই বিপুল পরিচালন ব্যয় সরাসরি গ্রাহকের কাঁধে চাপানো হবে।

অন্যায্য রেভিনিউ শেয়ার: প্রস্তাবিত রেভিনিউ শেয়ার ও চার্জের বিধান আইএসপিগুলোর লাভ কমিয়ে দেবে, যার ফলে তারা প্রান্তিক পর্যায়ে সেবার মান বজায় রাখতে বা মূল্য কমাতে পারবে না।

প্রতিযোগিতাহীনতা: দেশীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি আইএসপিগুলো এই উচ্চ ফি এবং জটিল নিয়মের কারণে বাজার থেকে ছিটকে পড়লে, বাজারে প্রতিযোগিতা কমবে। এর ফলে সরকার কর্তৃক ঘোষিত ‘এক দেশ, এক রেট’-এর মতো সাশ্রয়ী মূল্যের ইন্টারনেট সরবরাহের উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে।

বিদেশি কোম্পানি ও দেশীয় উদ্যোক্তার নীতিগত বৈষম্য
নীতিমালায় যে নৈতিক প্রশ্নটি সামনে এসেছে, তা হলো দেশীয় বিনিয়োগকারী এবং বিদেশি মালিকানাধীন মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর (CMSP)-এর মধ্যে সৃষ্ট বৈষম্য এবং বাজারের নিয়ন্ত্রণ।

একীভূত লাইসেন্সিং ও মোবাইল কোম্পানির সুযোগ: সরকার এই নীতিমালার মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত ‘একীভূত লাইসেন্সিং’ (Unified Licensing) চালু করছে। তবে আইএসপিএবি’র উদ্বেগ হলো, এই প্রক্রিয়ার আড়ালে মোবাইল কোম্পানিগুলোকে ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাকসেস (FWA) এবং লাস্ট মাইল ফাইবার সংযোগের মাধ্যমে ফিক্সড কানেক্টিভিটি দেয়ার স্পষ্ট অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এটি দেশীয় নিজস্ব বিনিয়োগে গড়ে ওঠা আইএসপিগুলোর জন্য চরম অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে।

সরকারের পাল্টা যুক্তি: সরকারের দাবি, এই ইউনিফাইড লাইসেন্সিং ও CMSP-দের ফিক্সড মার্কেটে প্রবেশাধিকার প্রযুক্তি-নিরপেক্ষতা ও প্রতিযোগিতা বাড়াবে এবং দূরবর্তী অঞ্চলে দ্রুত ইন্টারনেট পৌঁছাতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া সরকার বিদেশি মালিকানা সীমিত করে অন্তত ১৫ শতাংশ শেয়ার স্থানীয় বাজারে উন্মুক্ত করার বাধ্যবাধকতা এনেছে, যা দেশীয় বিনিয়োগের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।

রাজস্ব ও মধ্যবর্তী স্তর বাতিল: আইসিএক্স এবং আইজিডব্লিউ-এর মতো মধ্যবর্তী লাইসেন্সগুলো বাতিল হলে একদিকে যেমন সরকার সাময়িকভাবে রাজস্ব ক্ষতির মুখে পড়তে পারে (কারণ এই প্রতিষ্ঠানগুলো আয়ের একটি অংশ সরকারকে দিত), তেমনি অন্যদিকে বিটিআরসি দাবি করছে যে পুরোনো ব্যবস্থায় রাজস্বের টাকা অনাদায়ী রেখে বন্ধ হওয়া টোল কালেক্টরদের হাত থেকে দীর্ঘমেয়াদে রাজস্ব সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।

অবকাঠামো ভাগাভাগিতে নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষুদ্র আইএসপিদের ভবিষ্যৎ: দেশীয় আইএসপিদের ওপর Active Sharing-এর মতো ন্যায্য প্রযুক্তির ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণমূলক প্রতিবন্ধকতা আরোপ করা হয়েছে, যা বিনিয়োগ ও পরিচালন ব্যয় বাড়াবে। অন্যদিকে, সরকারের লক্ষ্য ছিল ক্ষুদ্র ও মাঝারি আইএসপিদের জন্য নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে ‘লাইট টাচ লাইসেন্সিং’ আনা। তবে আইএসপিএবি আশঙ্কা করছে যে, ডিস্ট্রিক্ট পর্যায়ের আইএসপিদের ওপর ডিজিটাল সেবা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে তা এক ধরনের ভোক্তা বৈষম্য তৈরি করবে।

আইএসপিএবি’র মূল দাবি


ডিজিটাল রুপান্তরে নৈতিক ভিত্তিকে সুরক্ষিত রাখতে আইএসপিএবি মনে করে, অযৌক্তিক ফি বৃদ্ধি এবং মোবাইল কোম্পানিগুলোকে ফিক্সড কানেক্টিভিটির সুযোগ দেয়া দেশীয় বিনিয়োগকে চরম অনিশ্চয়তার মুখে ফেলবে। তাই তারা সরকারের কাছে পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে-

নতুন FTSP/ISP গাইডলাইন অবিলম্বে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। দেশীয় উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের নীতিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশি CMSP-দের জন্য ফিক্সড কানেক্টিভিটি স্কোপ বাতিল করতে হবে। অযৌক্তিক লাইসেন্স ও বাৎসরিক ফি বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে হবে। Active Sharing ও FWA প্রযুক্তির ন্যায্য ব্যবহারের অনুমোদন দিতে হবে।

‘টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং লাইসেন্সিং নীতি ২০২৫’ নিঃসন্দেহে দেশের টেলিকম খাতে যুগোপযোগী সংস্কার আনার এক উচ্চাভিলাষী প্রচেষ্টা। লাইসেন্সিং কাঠামোর শৃঙ্খলা, সেবার ন্যূনতম মান নির্ধারণ এবং আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনার সরকারি উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও, আইএসপিএবি’র উত্থাপিত উদ্বেগগুলো দেশের ইন্টারনেট মূল্য এবং স্থানীয় বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর প্রশ্ন তোলে। ২০২৭ সালের মধ্যে বিদ্যমান লাইসেন্সগুলোর মাইগ্রেশন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করা এবং দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বৈষম্যমূলক পরিবেশ তৈরি না হয়, সেদিকে বিটিআরসি’র নজর দেয়া অত্যন্ত জরুরি।

এই নীতিমালার চূড়ান্ত রূপরেখা নির্ধারণের সময় সরকারকে অবশ্যই শুধু প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নের দিকে মনোযোগ না দিয়ে, দেশীয় বিনিয়োগের সুরক্ষা এবং সাধারণ গ্রাহকের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত ইন্টারনেট সেবার অধিকার নিশ্চিত করার মধ্যে একটি যৌক্তিক ভারসাম্য স্থাপন করতে হবে। এই ভারসাম্য রক্ষার ওপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশের ডিজিটাল অগ্রযাত্রার ভবিষ্যৎ।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *