এনইআইআর: শুধু বাংলাদেশ নয়, রাজস্ব সুরক্ষার বিশ্বজনীন কৌশল
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): বাংলাদেশে ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (NEIR) বা আইএমইআই (IMEI) ভিত্তিক নিবন্ধন ব্যবস্থার প্রবর্তন নিঃসন্দেহে দেশের মোবাইল খাতে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে এই প্রযুক্তি বিশ্বের অন্যান্য দেশে অপ্রচলিত এমন ধারণা ভুল। সুপ্রতিষ্ঠিত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অবৈধ মোবাইল ফোন বন্ধ করা, বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করা এবং জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে এই ধরনের প্রযুক্তি যেমন- সেন্ট্রাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (CEIR) বা ডিআরআইবিএস (DIRBS) বিশ্বের বহু দেশে ২০০০ সালের প্রথম দিক থেকেই সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ইতিহাসের পাতায় আইএমইআই প্রযুক্তির জন্ম
মোবাইল ফোন চুরি ও জালিয়াতি রোধে আইএমইআই-ভিত্তিক রেজিস্ট্রি পদ্ধতির ধারণাটি নতুন নয়। আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (ITU) এবং জিএসএমএ (GSMA)-এর সম্মিলিত উদ্যোগে এই প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে। আইএমইআই-ভিত্তিক ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (EIR) সিস্টেমের ধারণা এবং পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ২০০০ সালের প্রথম দিকে শুরু হয়।
মোবাইল ডিভাইস চুরি এবং জালিয়াতি রোধে কঠোর আইএমইআই রেজিস্ট্রি ব্যবস্থা চালু করা প্রথম দিককার দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। তারা বিদেশ থেকে আনা মোবাইল ফোন নিবন্ধনে কঠোর আইন প্রয়োগ করে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিবন্ধন না করলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ব্যবস্থা চালু করে, যা পরবর্তীকালে বহু দেশের জন্য মডেল হিসেবে কাজ করেছে।
বিশ্বজুড়ে সিস্টেমের নাম ও পরিচালনার কৌশল
যদিও বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা এনইআইআর নামে পরিচিত, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচালিত হয়, তবে মূল প্রযুক্তি একই যা প্রতিটি মোবাইল ফোনের স্বতন্ত্র আইএমইআই নম্বরকে কেন্দ্র করে কাজ করে।
বিভিন্ন পরিচিত নাম: ভারতে সেন্ট্রাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (সিইআইআর), যা ডিভাইস আইডেন্টিফিকেশন, রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ব্লকিং সিস্টেম (ডিআইআরবিএস) নীতির ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চলে ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (ইআইআর) এবং উজবেকিস্তানের নিজস্ব UZIMEI সিস্টেম। প্রতিটি দেশই এই সিস্টেমকে তিনটি মূল স্তম্ভের মাধ্যমে পরিচালনা করে-
এনইআইআর- এর মতো প্রযুক্তি বিশ্বের অন্যান্য দেশে অপ্রচলিত এমন ধারণা ভুল
১. সরকারি রাজস্ব ও কর নিশ্চিতকরণ:
এই সিস্টেমের মাধ্যমে সরকার চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকি রোধ করে রাজস্ব নিশ্চিত করে। উজবেকিস্তানের UZIMEI বা তুরস্কের CEIR-এর মতো সিস্টেমে কঠোর নিয়ম রয়েছে:
কাস্টমস ডেটাবেস সংযোগ: এই ডেটাবেসগুলো সরাসরি দেশের কাস্টমস বা শুল্ক বিভাগের ডেটাবেসের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। যখন কোনও মোবাইল ফোন বৈধভাবে আমদানি হয় এবং শুল্ক পরিশোধ করা হয়, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই আইএমইআই নম্বরটি সিস্টেমের হোয়াইট/এলাউলিস্টে যুক্ত হয়ে যায়।
অনিবন্ধিত ডিভাইসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন: বিদেশী ফোন বা অবৈধভাবে আসা ডিভাইসগুলোকে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা দেয়া হয় শুল্ক পরিশোধ ও নিবন্ধনের জন্য। এই সময়ের মধ্যে তা না হলে, ফোনটি নেটওয়ার্ক থেকে স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
২. নকল ও অবৈধ পণ্য সরবরাহ চেইন বন্ধ:
অবৈধ মোবাইল ফোন এবং নকল চ্যানেল প্রোডাক্ট বা চোরাই পণ্য ঠেকানোর জন্য এই দেশগুলো ব্ল্যাকলিস্টিং ও এলাউলিস্টিং পদ্ধতি ব্যবহার করে।
ব্ল্যাকলিস্টিং: চুরি যাওয়া বা অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত ফোনগুলো অভিযোগের ভিত্তিতে দ্রুত ডেটাবেসে ব্ল্যাকলিস্ট করা হয়। জিএসএমএ এবং নির্মাতাদের আন্তর্জাতিক ডেটার সঙ্গে যাচাই করে নকল আইএমইআই সহজে শনাক্ত করা যায়।
নকল আইএমইআই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা: চোরাকারবারীরা প্রায়শই বৈধ আইএমইআই নম্বর নকল করে (ক্লোনিং) ব্যবহার করে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে, সিইআইআর/এনইআইআর সিস্টেমগুলো একই আইএমইআই নম্বরের অধীনে একাধিক ডিভাইস সক্রিয় দেখলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সবগুলো সংযোগ বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়, যা প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করে।
নকল পণ্য নিয়ন্ত্রণ: কেনিয়া, চিলি ও আজারবাইজানের মতো দেশগুলোতে এলাউলিস্ট পদ্ধতি কার্যকর। অর্থাৎ, শুধুমাত্র অনুমোদিত (বৈধ পথে আসা) মোবাইল ফোনগুলোই নেটওয়ার্ক অ্যাক্সেস পায়।
আইএমইআই-ভিত্তিক ইআইআর সিস্টেমের ধারণা এবং পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ২০০০ সালের প্রথম দিকে শুরু হয়
৩. গ্রাহক সুরক্ষা এবং সহজলভ্য পরিষেবা:
এই দেশগুলোর প্রধান লক্ষ্য থাকে গ্রাহকের আস্থার জায়গা তৈরি করা।
পাবলিক ভেরিফিকেশন পোর্টাল: ভারত (Sanchar Saathi) ও পাকিস্তান (DIRBS পোর্টাল) সহ বিভিন্ন দেশে নাগরিকরা অনলাইনে বা এসএমএস-এর মাধ্যমে যেকোনও মোবাইল ফোন কেনার আগে সেটির আইএমইআই বৈধ, নকল নয় বা চুরি হওয়া কিনা তা যাচাই করতে পারে। এটি গ্রাহকের প্রতারিত হওয়া রোধ করে।
ভোক্তা আস্থা সূচক: আইএমইআই যাচাইয়ের মাধ্যমে ভোক্তা নিশ্চিত হন যে তিনি আসল, মানসম্পন্ন এবং প্রস্তুতকারকের ওয়ারেন্টিযুক্ত পণ্য কিনছেন। এতে গ্রাহকের অর্থ হারানোর ঝুঁকি কমে এবং বাজারে ভোক্তা আস্থা সূচক বৃদ্ধি পায়।
পরিবেশগত প্রভাব: যেহেতু এই ব্যবস্থা নিম্নমানের নকল ফোনের বাজার সংকুচিত করে, তাই দ্রুত নষ্ট হওয়া এই ডিভাইসগুলো থেকে সৃষ্ট ই-বর্জ্য উৎপাদন কমাতেও পরোক্ষভাবে সহায়তা করে।
রাজস্ব আদায় ও অর্থনৈতিক গভীরতা
আইএমইআই রেজিস্ট্রির মাধ্যমে সরকার চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকি রোধ করে রাজস্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি রোধ করতে পারে। পাকিস্তান ও ভারতের মতো দেশগুলো এই ব্যবস্থা থেকে সরাসরি লাভবান হয়েছে। ডিআইআরবিএস চালুর পর পাকিস্তানে মোবাইল শিল্পের রাজস্ব আদায় প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একসময় বাজারের যে ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ মোবাইল ফোন অবৈধ ছিল, তা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, এই ব্যবস্থা জাতীয় রাজস্বে শত শত কোটি টাকা যুক্ত করতে পারে। শুল্ক ফাঁকি বন্ধ হওয়ায় বৈধ আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়ে, যা দেশীয় মোবাইল উৎপাদন শিল্পকে উৎসাহিত করে।
মোবাইল ফোন চুরি ও জালিয়াতি রোধে আইএমইআই-ভিত্তিক রেজিস্ট্রি পদ্ধতির ধারণাটি নতুন নয়
দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে কঠোর নিয়ন্ত্রণ
ভারতে সেন্ট্রাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার (সিইআইআর) নামে কেন্দ্রীয় ডেটাবেস কার্যকর রয়েছে, যা ডিভাইস আইডেন্টিফিকেশন, রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ব্লকিং সিস্টেম নীতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত এবং সঞ্চার সাথী পোর্টালে গ্রাহকদের সহায়তা দেয়া হয়। পাকিস্তানে ডিআরআইবিএস মডেল চালু রয়েছে। তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, ইরান ও নাইজেরিয়ায় অবৈধ মোবাইল ফোন বন্ধে কঠোর বাধ্যতামূলক আইএমইআই রেজিস্ট্রি কার্যকর রয়েছে। উজবেকিস্তান ও আজারবাইজানে শক্তিশালী আইএমইআই এলাউলিস্ট সিস্টেম ব্যবহৃত হচ্ছে। নেপাল ও লেবাননে আইএমইআই ভিত্তিক রেজিস্ট্রি সিস্টেম বিদ্যমান।
লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকা অঞ্চলে প্রয়োগ: কলম্বিয়া, চিলি, ইকুয়েডর এবং কেনিয়াতে আইএমইআই ভিত্তিক ডিভাইস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মোবাইল শিল্পের ভূমিকা
এই ব্যবস্থার সফলতায় আন্তর্জাতিক সংস্থা ও নির্মাতাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। আইটিইউ ও জিএসএমএ তারা বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে এই প্রযুক্তির প্রসারে সহায়তা করে। কার্যকর চোরাচালান রোধ করার জন্য বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা পারস্পরিক ডেটা শেয়ারিং চুক্তির অধীনে কাজ করে। জিএসএমএ-এর মাধ্যমে এই আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা নিশ্চিত করা হয়, যাতে একটি দেশে ব্ল্যাকলিস্টেড হওয়া ফোন অন্য দেশে সক্রিয় হতে না পারে। মোবাইল উৎপাদনকারী: নির্মাতারা এই ব্যবস্থাটিকে ব্র্যান্ড সুরক্ষা, রাজস্ব নিশ্চিতকরণ এবং বৈধ প্রতিযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে সমর্থন করে।
এনইআইআর-এর সফল বাস্তবায়নে করণীয়
এনইআইআর-এর সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করে শুধুমাত্র প্রযুক্তি প্রয়োগের ওপর নয়, বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থা, অপারেটর, উৎপাদনকারী এবং সর্বোপরি সাধারণ গ্রাহকের মধ্যে আস্থা ও সমন্বয়ের ওপর। এনইআইআর-এর প্রাথমিক প্রয়োগে যে ধরনের চ্যালেঞ্জ আসতে পারে (যেমন- প্রবাসীদের ফোন নিবন্ধনে সাময়িক জটিলতা), তা মোকাবিলায় যা করা প্রয়োজন-
বাংলাদেশে এনইআইআর নামে পরিচিত, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচালিত হয়
দ্রুত এবং সরল ব্লকিং প্রক্রিয়া: চুরি যাওয়া বা হারানো ফোন দ্রুততম সময়ে (২৪ ঘণ্টার মধ্যে) ব্লকিং করার জন্য একটি ২৪/৭ সক্রিয় এবং ব্যবহার-বান্ধব অনলাইন পোর্টাল বা হটলাইন নিশ্চিত করা।
স্বচ্ছ যাচাইকরণ ও সচেতনতা: জনগণকে আইএমইআই যাচাই এবং ফোন হারানোর পর ব্লকিং পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাপকভাবে সচেতন করা। বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের জন্য শুল্ক পরিশোধ ও নিবন্ধনের নীতিমালা অত্যন্ত স্পষ্ট ও ঝামেলামুক্ত করা, যাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস পায়।
শিল্প ও রফতানি সুবিধা: স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মোবাইল ফোনগুলোর আইএমইআই নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে অন্যান্য দেশের চেয়েও দ্রুত, স্বয়ংক্রিয় এবং বিনামূল্যে করা। এটি স্থানীয় উৎপাদনকারীদের রফতানি বাজারে দ্রুত প্রবেশের সুযোগ দেবে।
ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি: এনইআইআর-এর কাঠামোকে ভবিষ্যতে ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ডিভাইস শনাক্তকরণ এবং নিবন্ধনের জন্য উপযোগী করে তোলা উচিত, যা জাতীয় নিরাপত্তার বৃহত্তর পরিসরকে সুরক্ষিত রাখবে।
ডেটা নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা: গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য যাতে কঠোরভাবে সুরক্ষিত থাকে, তা নিশ্চিত করা এবং সিস্টেমের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এনইআইআর-এর কার্যকর বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে শুধুমাত্র অবৈধ মোবাইল ফোন মুক্ত একটি স্বচ্ছ বাজারই দেবে না, বরং বৈশ্বিক টেলিযোগাযোগ মানদণ্ডে দেশকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।





