প্রতিবেদন

২০২৬ সালের প্রযুক্তি মহাযুদ্ধ: ২৫টি বৈশ্বিক প্রবাহ ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রস্তুতি

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): এজেন্টিক এআই, সিক্সজি ও ডিজিটাল টুইন নতুন প্রযুক্তির প্রবল প্রবাহে বিশ্ব অর্থনীতি, ডিজিটাল রূপান্তরে এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের এক নতুন অধ্যায়। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের শক্তিতে বিশ্বজুড়ে অভূতপূর্ব প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ঘটছে। এই গতিশীল প্রবাহ বৈশ্বিক অর্থনীতি ও সমাজের কাঠামো মৌলিকভাবে বদলে দিচ্ছে। দ্রুত অগ্রগতির এই যুগে, ২০২৫ সালে পরিবর্তন আনতে চলেছে এমন ২৫টি প্রযুক্তিগত প্রবাহ চিহ্নিত করেছে গিকস ফর গিকস-এর এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন।

বাংলাদেশের মতো কর্মক্ষম জনসংখ্যার সুবিধাভোগী অর্থনীতির জন্য, এই প্রবাহগুলোর সঙ্গে সফলভাবে খাপ খাইয়ে নিতে না পারলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। এই প্রতিবেদনটি সেই ২৫টি প্রবাহের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ তুলে ধরবে এবং ডিজিটাল রুপান্তর ভিশন বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনা দেবে।

প্রযুক্তিগত প্রবাহসমূহের সম্পূর্ণ তালিকা
এই বছরে বিশ্ব অর্থনীতিকে পরিচালনা করতে যাওয়া ২৫টি প্রবাহ হলো- এজেন্টিক এআই ও মাল্টিমোডাল সিস্টেম, ফাইভজি অ্যাডভান্সড ও সিক্সজি এর ভিত্তি, এআইওটি, এন্টারপ্রাইজ ব্লকচেইন ও টোকেনাইজেশন, স্পেশিয়াল কম্পিউটিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, এআই অ্যাট দ্য এজ, হাইপারঅটোমেশন, এআই-চালিত জিরো ট্রাস্ট, জলবায়ু প্রযুক্তি ও কার্বন-সচেতন কম্পিউটিং, নিউরাল ইন্টারফেস ও এক্সোস্যুট, এআই-নেটিভ ডেভ টুলস, ভার্টিক্যাল স্যাস+ এআই

স্বায়ত্তশাসিত অ্যাপস ও সুপার অ্যাপস, উন্মুক্ত উৎসের জেনারেটিভ এআই, এআই ট্রাইএসএম, অবিচ্ছিন্ন হুমকি এক্সপোজার ব্যবস্থাপনা, মেশিন গ্রাহক, এআই কোপাইলট+ ওয়্যারেবলস, প্রিসিশন ফারমেন্টেশন ও জিন-সম্পাদিত ফসল, রোবোট্যাক্সি ও এল৪ বাণিজ্যিক ফ্লিট, এআই-চালিত রিয়েল-টাইম ডিজিটাল টুইন, নিউরোমরফিক কম্পিউটিং, নিয়ন্ত্রিত ডিপফেক ও এআই অবতার, এবং প্ল্যাটফর্ম ইঞ্জিনিয়ারিং ও অভ্যন্তরীণ ডেভেলপার প্ল্যাটফর্ম।

২৫টি প্রবাহের মূল থিমে বিন্যাস
কৌশলগত প্রয়োগের সুবিধার জন্য ২৫টি প্রবাহকে পাঁচটি মূল থিমের অধীনে নিয়ে আসা যেতে পারে-
১. কোর ইন্টেলিজেন্স ও অটোমেশন: এজেন্টিক এআই, হাইপারঅটোমেশন, এআই-নেটিভ ডেভ টুলস, মেশিন গ্রাহক, উন্মুক্ত উৎসের জেনএআই এবং এআই ট্রাইএসএম।
২. কানেক্টিভিটি ও ক্লাউড অবকাঠামো: ফাইভজি/সিক্সজি, এআইওটি, এআই অ্যাট দ্য এজ, ভার্টিক্যাল স্যাস, প্ল্যাটফর্ম ইঞ্জিনিয়ারিং।
৩. নিরাপত্তা, বিশ্বাস ও ডিপটেক: কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, এন্টারপ্রাইজ ব্লকচেইন, এআই-চালিত জিরো ট্রাস্ট, সিটিইএম এবং নিউরোমরফিক কম্পিউটিং।
৪. ইমার্সিভ অভিজ্ঞতা ও ইন্টারফেস: স্পেশিয়াল কম্পিউটিং, নিউরাল ইন্টারফেস, স্বায়ত্তশাসিত অ্যাপস ও সুপার অ্যাপস, এআই কোপাইলট+ ওয়্যারেবলস, নিয়ন্ত্রিত ডিপফেক।
৫. টেকসইতা, স্বাস্থ্য ও গতিশীলতা: জলবায়ু প্রযুক্তি, প্রিসিশন ফারমেন্টেশন, রোবোট্যাক্সি, এবং এআই-চালিত ডিজিটাল টুইন।

বিশ্লেষণ পর্ব: প্রধান প্রবাহের ধারাবাহিক বিশ্লেষণ
১. এজেন্টিক এআই ও মাল্টিমোডাল সিস্টেম: এই স্বায়ত্তশাসিত এআই মডেলগুলো নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ২০২৫ সালের মধ্যে বৈশ্বিক এআই বাজারের মূল্য ২৯৪.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমান। বাংলাদেশের আইটি, ফিন্যান্স এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে এআই-এর গভীর প্রয়োগ কর্মদক্ষতা বহুলাংশে বাড়িয়ে দেবে।

২. ফাইভজি-অ্যাডভান্সড ও সিক্সজি এর ভিত্তি: দ্রুততম নেটওয়ার্কিং প্রযুক্তির এই প্রবাহে বৈশ্বিক ফাইভজি বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে ৭৯৭.৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে। এই সংযোগ স্মার্ট সিটি এবং উন্নত ভার্চুয়াল সেবার ভিত্তি তৈরি করবে।

৩. এআইওটি: এআই ও আইওটি-এর সমন্বয়ে তৈরি এই বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে ১.৩৮ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে। এটি শিল্পে পূর্বাভাসমূলক রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
৪. এন্টারপ্রাইজ ব্লকচেইন ও টোকেনাইজেশন: এই বিকেন্দ্রীভূত লেজার প্রযুক্তি সরবরাহ চেইন এবং আর্থিক লেনদেনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এর বাজার ৬২.৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে।

৫. স্পেশিয়াল কম্পিউটিং (এআর/ভিআর/এমআর): ভার্চুয়াল এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি প্রযুক্তির বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে ১১০.২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে, যা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।
৬. কোয়ান্টাম কম্পিউটিং: এটি জটিল সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা রাখে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে এর বাজার ৮.৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে।

৭. এআই অ্যাট দ্য এজ: কম লেটেন্সির জন্য ডেটা প্রক্রিয়াকরণকে উৎসের কাছাকাছি এনে স্বায়ত্তশাসিত সিস্টেমগুলোর জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব করছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এই বাজার ৪৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে।
৮. হাইপারঅটোমেশন: এই স্বয়ংক্রিয়করণ বাজার ২০২৫ সালে ২৫.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে। এটি প্রশাসনিক ও অপারেশনাল কাজ স্বয়ংক্রিয় করে খরচ কমাবে।

৯. নিউরাল ইন্টারফেস থেকে২৫. প্ল্যাটফর্ম ইঞ্জিনিয়ারিং: এই ধারাবাহিকতার বাকি প্রবাহগুলো স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, মিডিয়া এবং সফটওয়্যার উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।
১০. এআই-চালিত জিরো ট্রাস্ট ও ১৭. অবিচ্ছিন্ন হুমকি এক্সপোজার ব্যবস্থাপনা: এই প্রযুক্তিগুলো সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করছে। বৈশ্বিক সাইবার নিরাপত্তা বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে ২৯৮.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে। বাংলাদেশের ই-গভর্নেন্সের জন্য এটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের দাবি রাখে।

১১. জলবায়ু প্রযুক্তি ও কার্বন-সচেতন কম্পিউটিং: পরিবেশবান্ধব এই প্রযুক্তির বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে ৬২.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে। সবুজ উৎপাদন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে এটি বাংলাদেশের শিল্পকে পরিবেশবান্ধব কমপ্লায়েন্সে সহায়তা করবে।

বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ ও কৌশলগত করণীয়
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি: এআই এবং অটোমেশনের দ্রুত প্রবাহ দেশের শ্রমবাজারের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানবসম্পদকে দ্রুত আধুনিক প্রযুক্তি প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত না করলে কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। ফাইভজি নেটওয়ার্ক স্থাপনের উচ্চ ব্যয় এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর মতো গভীর প্রযুক্তিতে সীমিত বিনিয়োগ বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে দিতে পারে।

অভিযোজন কৌশল ও ভবিষ্যৎ করণীয়:
১. মানবসম্পদ রূপান্তর: প্রশিক্ষণে অগ্রাধিকার
সরকার ও বেসরকারি খাতকে অবিলম্বে এআই/এমএল ইঞ্জিনিয়ার, সাইবার নিরাপত্তা আর্কিটেক্ট-এর মতো উচ্চ-চাহিদার ভূমিকার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। এআই-নেটিভ ডেভ টুলস এবং জেনএআই-এর ব্যবহারে জোর দিতে হবে।

২. স্মার্ট শিল্পায়ন: উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি
তৈরি পোশাক শিল্পে এআইওটি এবং এআই-চালিত ডিজিটাল টুইন প্রযুক্তির প্রয়োগকে উৎসাহিত করা আবশ্যক। ডিজিটাল টুইন বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে ১১০.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে; এর প্রয়োগে শিল্প অপচয় হ্রাস পাবে। জলবায়ু প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা দরকার।

৩. নিয়ন্ত্রক কাঠামো: নিরাপত্তা ও কমপ্লায়েন্স
এআই ট্রাইএসএম এবং জিরো ট্রাস্ট আর্কিটেকচার অনুসরণ করে ডেটা নিরাপত্তা নীতি কঠোরভাবে কার্যকর করতে হবে। এন্টারপ্রাইজ ব্লকচেইন ব্যবহারের জন্য দ্রুত সহায়ক আইনি কাঠামো প্রণয়ন করা জরুরি।

৪. অবকাঠামোগত ভিত্তি নিশ্চিতকরণ
ফাইভজি এবং ভবিষ্যতের সিক্সজি-এর ভিত্তির জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যা রোবোট্যাক্সি এবং স্বায়ত্তশাসিত অ্যাপস-এর মতো পরিষেবাগুলির জন্য অপরিহার্য।

২০২৫ সালের প্রযুক্তিগত প্রবাহ বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল অর্থনৈতিক সুযোগ নিয়ে এসেছে। এই প্রবাহগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অভিযোজন করতে হবে। এই প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরপরই এর অভিযোজন কৌশল অংশটি দ্রুত নীতি নির্ধারণী ফোরামে আলোচনা ও ব্রিফিংয়ের জন্য ব্যবহার করা আবশ্যক। সঠিক কৌশল, লক্ষ্যভিত্তিক বিনিয়োগ এবং দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ ডিজিটাল রুপান্তর বিনির্মাণের মাধ্যমে বৈশ্বিক ডিজিটাল অর্থনীতিতে নিজেদের একটি শক্তিশালী কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। ভবিষ্যতে এই বিশ্লেষণের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান ডিজিটাল সক্ষমতার (যেমন ফোরজি/ফাইভজি প্রসারের হার) স্থানীয় ডেটা তুলনা করে গবেষণার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা জরুরি।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *