১০ বছরে ডিজিটাল সেন্টার

জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর যাত্রা হওয়া ডিজিটাল সেন্টারের আজ ১০ বছর পূর্তি হয়। এ উপলক্ষ্যে আজ (১১ নভেম্বর) অনলাইনে আয়োজিত হয়েছে অনলাইন সম্মেলন এবং লোকসঙ্গীত কনসার্ট। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, স্থানীয় সরকার সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ এবং ইউএনডিপি বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জি। সভাপতিত্ব করেন আইসিটি সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলমম। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন এটুআই প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. আব্দুল মান্নান।ডিজিটাল সেন্টারের ১০ বছরের কার্যক্রম নিয়ে উপস্থাপনা প্রদান করেন এটুআই’র পলিসি অ্যাডভাইজর আনীর চৌধুরী।

বিগত ১০ বছরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নাগরিকদের দোরগোড়ায় সরকারি-বেসরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ডিজিটাল সেন্টার কাজ করে যাচ্ছে। আইসিটি বিভাগ ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন এবং ইউএনডিপির সহায়তায় পরিচালিত এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) প্রোগ্রাম ডিজিটাল সেন্টার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। ইতোমধ্যে ডিজিটাল সেন্টার কর্তৃক ৫৫.৪ কোটিরও বেশি সেবা প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে নাগরিকদের ১৬৮ কোটি কর্ম দিবস এবং ৭৬,৭৭৫ কোটি টাকা ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে। একই সঙ্গে উদ্যোক্তারা প্রতি মাসে গড়ে ৬০ লক্ষ সেবা প্রদানের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৪৬৫ কোটি টাকা উপার্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ডিজিটাল সেন্টার থেকে একজন নাগরিক ২৭০টিরও বেশি নাগরিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। এগুলোর মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা, নামজারির আবেদন, পর্চার আবেদন, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্টের আবেদন ও ফি প্রদান ছাড়াও এজেন্ট ব্যাংকিং, অনলাইনে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, বিমান, বাস, লঞ্চ টিকেটিং, মেডিকেল ভিসা ও এপয়েন্টমেন্ট, রেমিটেন্স-এর সুবিধা অন্যতম।

মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল এখন দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের মানুষ প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। আজকে অজপাড়াগাঁয়ে বসবাস করেও মানুষ শুধু দেশেই নয়, সারাবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে সক্ষম হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের মহাসংকটেও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থাকায় মানুষের চলার পথে খুব একটা বাঁধা সৃষ্টি করতে পারেনি। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কারণে মানুষের জীবনযাপনের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান এবং অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নব দিগন্তের সূচনা করে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।

জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, জাতির পিতার দর্শন ছিলো, বৈষম্যহীন সমাজ ও গ্রাম উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন। এই দর্শন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেন। ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে। এখানে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে নাগরিকদের যাতায়াতের দূরত্ব, নারী-পুরুষ বৈষম্য, ধনী-দরিদ্র বৈষম্য এবং দুর্নীতি দূর হয়েছে। ইউনিয়ন পর্যন্ত হাই-স্পিড ইন্টারনেট, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি এবং নতুন সেবার পরিমাণ বাড়াতে আমরা কাজ করছি। আমরা এই সার্ভিস বেজ প্ল্যাটফর্মকে বিজনেস হাব হিসেবে রূপান্তর করার চেষ্টা করছি। এর মাধ্যমে মানবসম্পদ তৈরি করছি এবং আগামীতে প্রতি ২ কিলোমিটারের মধ্যে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন ও ৫০০ সেবাকে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছি।

খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ১০ বছর আগে আমরা যখন ডিজিটাল সেন্টারের কাজ শুরু করি, অনেকেই এর সম্ভাব্যতা এবং উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা কিভাবে দেবো, এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতো! কিন্তু, আমরা ধীরে ধীরে সব উদ্যোক্তাদের হাতে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে সমর্থ হই। শুরুর দিকে প্রায় ১৬০০ ইউনিয়ন পরিষদে কোন বিদ্যুৎ ছিলো না। আমরা তাদের জন্য সোলার ব্যবস্থা করি। এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার জন্য।

হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ১০ বছর আগেও বিভিন্ন সরকারি সেবা গ্রহণের জন্য মানুষকে জেলা বা বিভাগীয় শহরে যেতে হত। এখন ঘরের কাছেই এ সেবা দিচ্ছে ডিজিটাল সেন্টার। এ যাত্রা সহজে তৈরি হয়নি। প্রথমে উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তিগত উপকরণ দিতে আমরা ফান্ড সংগ্রহ করি। এর মাধ্যমে আমরা তাদের ক্যামেরা, ল্যাপটপ, প্রজেক্টর এগুলো দিয়ে সহায়তা করি। এরপর তাদের সেবা প্রদানের লক্ষ্যে বসবার জন্য দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের অফিসে ব্যবস্থা করে দেই। তাদের সামাজিক স্বীকৃতি ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, শিক্ষা সফর ও সনদ প্রদান করি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী ইশতেহার গ্রাম হবে শহর এর বাস্তবায়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমেই এগিয়ে যাচ্ছে অদম্য গতিতে।

ড. মো. আব্দুল মান্নান বলেন, দেশব্যাপী এ সেন্টারগুলো বিভিন্ন রকম সরকারি-বেসরকারি সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ শুরুর আগে গ্রামে বসেই সরকারের সেবা প্রাপ্তির কথা কেউ কল্পনাও করেনি। আজ সেখানে গ্রামে বসেই মানুষ ২৭০টিরও বেশি সেবা গ্রহণ করছে। দেশজুড়ে মুজিব শতবর্ষ ই-সেবা ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে প্রান্তিক অঞ্চলের নাগরিকরা বিনামূল্যে ই-সেবা পেয়েছেন। ভবিষ্যতে উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে ডিজিটাল সেবার গতি আরও বৃদ্ধি করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

সুদীপ্ত মুখার্জি বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়া একটি দেশ দুর্বল অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সূচকে বেশ এগিয়ে আছে। ডিজিটাল সেন্টার প্রান্তিক মানুষদের জীবনে অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে মোবাইল ব্যাংকিং এবং এজেন্ট ব্যাংকিং এর ফলে দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হয়েছে। এখন গ্রামের মানুষও সঞ্চয়ে আগ্রহী হচ্ছেন। তার মতে, ডিজিটাল সেন্টারের ফলে সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশিপ আরও গতি পাবে।

এটুআই’র যুগ্ম প্রকল্প পরিচালক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত অনলাইনে সম্মেলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ডিজিটাল সেন্টার কর্তৃক সারাদেশে আয়োজিত মুজিব শতবর্ষ ই-সেবা ক্যাম্পেইনে ২০২০ অংশগ্রহণকারী সেরা উদ্যোক্তাদের সনদ প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক, জনপ্রতিনিধি, উদ্যোক্তা ও সেবাগ্রহীতারা ডিজিটাল সেন্টার সম্পর্কে তাদের অভিমত ব্যক্ত করার মাধ্যমে গ্রামীণ জনজীবনে যে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে সে বিষয়গুলো তুলে ধরেন। এ ছাড়া আয়োজনে আরও যুক্ত ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, এটুআইর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং গণমাধ্যমকর্মীগণ।