সাইবার নিরাপত্তা আইনে শাস্তি কমানোর প্রস্তাব
ক.বি.ডেস্ক: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রতিস্থাপিত হয়ে আসছে সাইবার নিরাপত্তা আইন। এ আইনে শাস্তি কমানোর পাশাপাশি, যখন তখন গ্রেপ্তারের বিষয়ে পুলিশি ক্ষমতাও শিথিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু অনেকের মতে, বাক স্বাধীনতা ও ভিন্নধর্মী লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে এমন ধারা যদি নতুন আইনেও থাকে, তবে তা শেষ পর্যন্ত হয়রানির কাজেই ব্যবহৃত হতে পারে।
গতকাল শনিবার (১২ আগস্ট) রাজধানীর বনানীতে ঢাকা গ্যালারিতে এডিটরস্ গিল্ড আয়োজিত ‘ডিজিটাল থেকে সাইবার: ভিন্নতা কতটুকু?’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন দরকার, তবে এই আইন যেন ডিজিটাল নিরাপত্তার আইনের মতো বাক স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করার পাশাপাশি নিপীড়নমূলক না হয় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য তাড়াহুড়া না করে আইনটি চূড়ান্ত করার আগে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার তাগিদ দিলেন বিশ্লেষকরা।
গোলটেবিল আলোচনার সঞ্চালনা করেন গ্লোবাল টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা। আলোচক ছিলেন সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক গোলাম রহমান, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. হাসান মাহমুদ খন্দকার, দৈনিক আমাদের সময়ের এমিরেটাস সম্পাদক নাইমুল ইসলাম খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সাদেকা হালিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এ জে এম শফিউল আলমা ভুইয়া, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামাল, আর্টিকেল-১৯ এর পরিচালক ফারুক ফয়সাল, আইনজীবী ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ইমতিয়াজ মাহমুদ।
অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, অজামিনযোগ্য যে ধারাগুলো সেগুলো অনেকক্ষেত্রেই জামিনযোগ্য হয়েছে। বিচারের আগেই যখন একজন মানুষ শাস্তি পায় তখন সেটা অন্যায়। আইন এটা সমর্থন করে না। এখানে সেই সুযোগটা কমেছে। কিন্তু পুরো কমেছে তা বলা যাবে না। কারণ, একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে যথেষ্ট দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি যেকোনো সময় একজনের বাড়িতে ঢুকতে পারবেন।
ড. হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, যদি নখ না থাকে দাঁত না থাকে সেরকম একটি আইন যদি হয়ে যায় তবে সম্ভাব্য অপরাধী মনে করতে পারে, এখন সময় এসে গেছে, টু গো ফর অ্যাকশন। তখন কিন্তু ঝামেলা আছে। রামুর ভয়াবহতা আমার চাক্ষুষ দেখা হয়েছে। সাঈদীর ভয়াবহতা চাক্ষুষ দেখা হয়েছে।
নাইমুল ইসলাম খান বলেন, আইনটা সংস্কার করে পুরোটা বাতিল করে দিলে আজকের থেকে হয়তো এক বছর পরে আমাদের গোলটেবিল করতে হবে সরকারেরতো দাঁত-নখ নেই। এই আইন দিয়ে কিছুই করতে পারছে না।
অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, নারী নির্যাতন আইনের অনেক পুরুষকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। জমি দখলের জন্য। এই আইনটাও (ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন) কিন্তু রাজনীতিক, প্রভাবশালী, ব্যবসায়ী শ্রেণিদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে।
অধ্যাপক এ জে এম শফিউল আলম ভুইয়া বলেন, যে সাইবার বুলিয়েংর শিকার হয়… আজকে যদি আমার বিরুদ্ধে একটি ফেসবুক ক্যাম্পেইন শুরু করেন যার দ্বারা আমার মানহানি হয়। সেটার জন্যতো প্রতিকার থাকতে হবে।
মাসুদ কামাল বলেন, আমার বউ আমার মেয়ে আমাকে বলে, এত কথা না বললে হয় না। এটা হলো ভয়ের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি বিরাজ করছে।
ফারুক ফয়সাল বলেন, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই আইনের যত অপব্যবহার হয়েছে তার ওপর একটা বিচার বিভাগীয় তদন্ত হতে হবে। একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। যারা এতে জড়িত ছিলো তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, কণ্ঠরুদ্ধ করতে সুযোগ যতদিন থাকবে। ততদিন পর্যন্ত এটা ভয়াবহ বোমার মতো এখানে থাকবে। এটার ভয়ে আমাদের সৃজনশীল লেখক যারা আছেন ওরা থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের ছেলেমেয়রা পর্যন্ত একটা দাস মনোবৃত্তি নিয়ে বড় হবে। ভয়ে কথা বলতে পারবে না। বললে না আবার ধরে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করে নতুন সাইবার সিকিউরিটি আইনের খসড়া নিয়ে বিভিন্ন মহল সমালোচনা করছে। সরকারের মন্ত্রীরা এ নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেও বিভ্রান্তি দূর হচ্ছে না। হ্যাকিং, অশ্লীলতা, উপাত্ত সুরক্ষার মতো বিষয়ের জন্য আইনের প্রয়োজন রয়েছে –এ বিষয়ে একমত আলোচকরা। তারা বলছেন, বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় সাইবার অপরাধ ঠেকাতে এ আইন পুরোপরি বাতিলের সুযোগ নেই। সাইবার নিরাপত্তা আইন তৈরির আগে তাড়াহুড়া না করে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার তাগিদ দেন আলোচকরা।
আইন পাল্টে যখন নতুন করা হচ্ছে তা নিয়েও শঙ্কাও কম নয় সাংবাদিক সংগঠনগুলোর। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তার আইনে হওয়া ‘অপব্যাবহার’ এতে কমবে। গণমাধ্যমের ওপর যে ‘চাপ’ তৈরি হয়েছিলো তাও প্রশমিত হবে।
চলতি মাসে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের ফলে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম বদলে যাচ্ছে। নতুন নাম হচ্ছে ‘সাইবার সিকিউরিটি আইন’। একই সঙ্গে আইনের অনেকগুলো ধারায় সংশোধন আনা হচ্ছে। বেশকিছু জামিনঅযোগ্য ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। সাজাও কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।