সাম্প্রতিক সংবাদ

মাথাচাড়া দিচ্ছে নিত্য-নতুন সাইবার অপরাধ: সিক্যাফ’র গবেষণা

ক.বি.ডেস্ক: দেশে দ্বিগুণ হারে বাড়ছে সাইবার অপরাধের নতুন মাত্রা। ব্যক্তিগত ক্ষতির পাশাপশি আর্থিক ক্ষতি এবং প্রলোভনে প্রকট সাইবার অপরাধ। তবে সামাজিক লোক-লজ্জার ট্যাবুতে তা থকাছে অন্তরালেই। তাই গণ-সাইবার স্বাক্ষরতার পাশাপাশি দেশের সাইবার সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখতে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে নিজস্ব সাইবার সলিউশন তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

আজ শনিবার (২৯ জুন) রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশে সাইবার অপরাধপ্রবণতা-২০২৪’ এবং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উদীয়মান প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এমন অভিমত ব্যক্ত করেন বক্তারা।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে (সিক্যাফ) অনুষ্ঠিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিক্যাফ উপদেষ্টা প্রকৌশলী মো. মুশফিকুর রহমান। গবেষণা প্রতিবেদন পেশ করেন সিক্যাফ গবেষণা দলের প্রধান ওবায়দুল্লাহ আল মারজুক। সভাপতিত্ব করেন সিক্যাফ সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ। সঞ্চালনা করেন সিক্যাফ সাধারণ সম্পাদক নুরুন আশরাফী। উপস্থিত ছিলেন সিক্যাফ সহ-সভাপতি এস এম ইমদাদুল হক এবং প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সম্পাদক আব্দুল মুনয়েম সৈকত।

প্যানেল আলোচক ছিলেন বিটিআরসি’র মহাপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন) ব্রিগে. জে. কাজী মুস্তাফিজুর রহমান, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্নেন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ এ হুসেইন, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক ও প্রধান গবেষক হুসেইন সামাদ, বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজি’র কোষাধ্যক্ষ ব্যারিস্টার নাজমুস সালিহিন এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের (সিটিটিসি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ইশতিয়াক আহমেদ।

কাজী মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘ব্যক্তিগতভাবে যত সচেতনতা বাড়ানো যাবে ততই কমানোর সম্ভব এই সাইবার অপরাধ। সচেতনতার দায়িত্ব সবাইকে সম্মিলিতভাবে পালন করতে হবে।’’

হুসেইন সামাদ বলেন, ‘‘ডিজিটাল বাংলাদেশের এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হয়েছে। এখন এর দক্ষ ব্যবহার দরকার। কিন্তু দেশে ৭০ শতাংশই সাইবার আক্রমণ হচ্ছে ব্যক্তিসচেতনতার অভাবে। তাই সবার সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।’’

মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘‘বিভিন্ন খাতে উদীয়মান প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য উন্নতি ও সুবিধা এনেছে। এই উন্নতির পাশাপাশি কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা সাবধানে বিবেচনা করার দাবি করে। এই উদ্বেগগুলোর মধ্যে রয়েছে সম্ভাব্য গোপনীয়তা ও সুরক্ষা ঝুঁকি, সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি, প্রযুক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঝুঁকি। উদীয়মান প্রযুক্তির সামাজিক সুবিধাগুলো সর্বাধিক করতে, একটি বহুমুখী পদ্ধতি প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে নাগরিকদের অধিকার ও গোপনীয়তা রক্ষা করে এমন নীতি ও বিধিমালা তৈরি করা। উদীয়মান প্রযুক্তির যুগে জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনা সর্বোপরি হওয়া উচিত।’’

নাজমুস সালেহিন বলেন, ‘‘অনলাইন গ্যাম্বিলিংয়ের আড়ালে আছে মানিলন্ডারিং। তবে একে খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোর ব্যাংকিং খাতে সহসাই একটি বিপদ আসছে।

ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘‘৪টি ধারা ছাড়া সাইবার অপরাধ আইন ২০১৩ এর সবগুলো ধারাই হ্যাকিংয়ের আওতায় থাকলেও তা জামিনযোগ্য। এতে আমরা অনেক অপরাধীকেই শস্তির অধীনে আনতে সমস্যা হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা দেরিতে নালিশ করায় আইনের সুরক্ষা দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ছে। দেশে শিশু পর্ণো বাড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তা হচ্ছে। এটা শঙ্কাজনক।’’

সিক্যাফ সাইবার অপরাধ প্রবণতা- ২০২৪ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে সাইবার অপরাধে যুক্ত হচ্ছে নতুন অপরাধ। এক বছরের ব্যবধানে এই হারটা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে মোট অপরাধের ১১.৮৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭৮.৭৮ শতাংশের বয়সই ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এ ছাড়াও আক্রান্তদের প্রায় ৫৯ শতাংশই নারী। অপরাধের ধরনের মধ্যে ২১.৬৫ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনে অ্যাকাউন্ট বেদখলের (হ্যাকিং) শিকার হয়ে শীর্ষে রয়েছে। ২০২৩ সালে দেশে সাইবারজগতে ‘পর্ণোগ্রাফি’ অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতা বেড়েছে। ভুক্তভোগীদের ১১.৩৫ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন পর্ণোগ্রাফি।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৪৭.৭২ শতাংশ সামাজিক মর্যাদাহানী, ৪০.১৫ শতাংশ আর্থিক ক্ষতির শিকার, এবং প্রায় সবাই মানসিক যন্ত্রণায় কাতর ছিলেন। এদের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৮১.২৫ শতাংশ সাধারণ ডায়রি এবং ১৮.৭৫ শতাংশ লিখিত অভিযোগ করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগকারীদের মধ্যে ১২.৫০ শতাংশ মন্তব্য করেননি। ৮৭.৫০ শতাংশ সুফল পাননি। এসব প্রতারণায় আক্রান্তদের বেশিরভাগই শিক্ষিত। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ৪০.৯০ শতাংশ ভুক্তভোগী উচ্চ মাধ্যমিক পাস, ২১.২১ শতাংশ স্নাতক/সম্মান পাস, ১৬.৬৬ শতাংশ মাধ্যমিক পাস এবং ১২.৮৭ শতাংশ মাধ্যমিকের নিচে।

স্ব-প্রণোদিত হয়ে ১৩২ জন ভুক্তভোগী অভিজ্ঞতা থেকে এই ফলাফল পেয়েছে সাইবার দেশের সাইবার জগতকে সুরক্ষিত রাখতে চায় দেশে এই খাতের স্বেচ্ছাসেবীদের অগ্রজ সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারেনস ফাউন্ডেশন (সিক্যাফ)। সংগঠনটি এজন্য কয়েকটি সুপারিশও দিয়েছে অনুষ্ঠানে। গবেষণা প্রতিবেদনে সুপারিশ……:

ব্যাক্তিকেন্দ্রিক
ইন্টারনেট ব্যবহারে ‘দেখা মাত্রই ক্লিক নয়, যাচাই ছাড়া শেয়ার নয়’- এই চর্চা অব্যাহত রাখা। ডিজিটাল লেনদেনে সতর্ক থাকা, যাতে প্রতারকের খপ্পরে পড়তে না হয়। কোথাও ব্যাক্তিগত তথ্য দেয়ার আগে সেখানে সুরক্ষাব্যবস্থা বা এ সংক্রান্ত নীতিমালা আছে কি না যাচাই করে নেয়া। অনলাইন কেনাকাটায় ডেলিভারিম্যানের উপস্থিতিতে প্যাকেজিং খুলে পণ্য মিলিয়ে নিন। ইন্টারনেটে যেকোনো পদক্ষেপে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন- বিষয়গুলো বিবেচনায় নিন।

প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক:
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কড়া নজরদারি সুনিশ্চিত করা। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে সাইবার অপরাধ সেল গঠন করা যেতে পারে যেখানে শিক্ষার্থীরা নিঃসংকোচে অভিযোগ দিতে পারে এবং এর মাধ্যমেই আইনিব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা যায়। সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে ও সচেতনতা তৈরিতে সরকারি-বেসরকারি অংশীজনের সমন্বয়।

প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক/ সরকারি উদ্যোগ
নিয়মিত জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি অংশীজনদের সমন্বয়। নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষায় জোর দেয়া এবং সুরক্ষা লংঘন হলে তা শনাক্তে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নিশ্চিত করা
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের উন্নত প্রশিক্ষণের আওতায় আনা জরুরি। প্রচলিত আইন সম্পর্কে নাগরিকদের জানানো। সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে সেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে। দেশীয় প্রযুক্তির উন্নয়ন ও প্রসারে টেকসই উদ্যোগ গ্রহণ।

গবেষণা প্রতিবেদন সম্পর্কে: ‘বাংলাদেশে সাইবার অপরাধপ্রবণতা ২০২৪’ গবেষণা প্রতিবেদন – CYBER SECURITY AWARENESS (ccabd.org)

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *