প্রতিবেদন

ভারতে ইউটিউব জিও-ব্লকিং: প্রযুক্তি নির্ভরতা না স্বনির্ভরতা?

মো. আরিফুল হক: ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউটিউব প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশি চারটি টেলিভিশন চ্যানেলকে জিও-ব্লক করার সিদ্ধান্ত নতুন এক বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়েছে বাংলাদেশকে। এটি শুধু সম্প্রচারে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাংলাদেশের ডিজিটাল অবকাঠামোর নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও কৌশলগত অবস্থানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।

প্রযুক্তিনির্ভরতার ছায়া
বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনার একটি বড় অংশ- প্রায় ৫৫ শতাংশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল (আইটিসি) হয়ে এই সংযোগ পরিচালিত হয়। এর মানে দাঁড়ায়, বাংলাদেশের ইন্টারনেট ট্রাফিকের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ অন্য দেশের নীতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ভারতে কোনো নীতিগত পরিবর্তন বা নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ তৈরি হলে তার প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশে এসে পড়ছে।

ক্ষতির মুখে কনটেন্ট নির্মাতা ও মিডিয়া
এই জিও-ব্লকিংয়ের ফলে বাংলাদেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ভারতীয় দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইউটিউবভিত্তিক রাজস্ব আয়। বাংলাদেশের অনেক কনটেন্ট নির্মাতা, মিডিয়া প্রতিষ্ঠান ও ডিজিটাল উদ্যোক্তা ভারতের বিশাল বাংলা ভাষাভাষী দর্শকের ওপর নির্ভর করে। ইউটিউব, বিজ্ঞাপন কিংবা স্পনসরশিপ-সব ক্ষেত্রেই ক্ষতি হচ্ছে। একে শুধু বাণিজ্যিক ক্ষতি হিসেবে দেখলে ভুল হবে; এটি আমাদের সৃজনশীল ডিজিটাল অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ওপরও আঘাত।

স্বনির্ভরতা কি শুধু নীতিগত উচ্চারণ?
এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করেছে যে ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব এখন কেবল ধারণা নয়, বাস্তব চাহিদা। নিজস্ব সাবমেরিন ক্যাবল, ডেটা সেন্টার, কনটেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক (সিডিএন), জাতীয় ইন্টারনেট গেটওয়ে এবং বিকল্প কানেক্টিভিটি গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

সরকার ইতিমধ্যে গুগল ও মেটার মতো আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশে ডেটা সেন্টার স্থাপনের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। তবে বাস্তব অগ্রগতি ধীর। নীতিগত ঘোষণা থাকলেও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিনিয়োগ বাস্তবায়নে নেই কাঙ্ক্ষিত গতি।

ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাও ভাবনার বিষয়
এই ঘটনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- ডিজিটাল নিরাপত্তা এখন শুধুই প্রযুক্তি বা কমপিউটার বিষয় নয়, এটি একেবারে ভূরাজনৈতিক মাত্রায় চলে গেছে। যেসব দেশ একে অপরের অবকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল, সেখানে রাজনৈতিক বা নিরাপত্তাজনিত সিদ্ধান্ত মুহূর্তেই অন্য দেশের অর্থনীতি ও তথ্যপ্রবাহে প্রভাব ফেলতে পারে।

সামনে কী?
ভারতের জিও-ব্লকিং সিদ্ধান্ত একটি ঘটনা হলেও, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি কৌশলগত শিক্ষা। ডিজিটাল জগতে টিকে থাকতে হলে কেবল ব্যবহারকারী নয়, পরিকাঠামোর মালিকও হতে হয়। আত্মনির্ভর ডিজিটাল অবকাঠামো, স্বচ্ছ নীতিমালা এবং প্রযুক্তি কূটনীতি ছাড়া ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়।

লেখক: মো. আরিফুল হক, টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *