বিশাল সাশ্রয়! এমএফএস থেকে ব্যাংকে টাকা পাঠাতে খরচ কমলো হাজারে ১০ টাকা

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): আগামী ১ নভেম্বর ২০২৫ থেকে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন আসছে। ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ (NPSB) প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ব্যাংক এবং মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আন্তঃলেনদেন ব্যবস্থা চালু হওয়ার ফলে গ্রাহকের অর্থ লেনদেনের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে। দীর্ঘদিনের উচ্চ ক্যাশ আউট চার্জের বোঝা থেকে মুক্তি দিয়ে, এই নতুন ব্যবস্থা ডিজিটাল অর্থনীতির ভিত্তি আরও মজবুত করবে।
এমএফএস থেকে ব্যাংকে টাকা স্থানান্তরের জন্য সর্বোচ্চ চার্জ ০.৮৫ শতাংশ বা প্রতি হাজারে ৮ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করায়, গ্রাহকের প্রতি হাজারে প্রায় ১০ টাকা সাশ্রয় হবে। এই পদক্ষেপটি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক জারি করা একটি বাধ্যতামূলক আইনগত নির্দেশ।
নতুন চার্জ কাঠামো এবং গ্রাহকের সাশ্রয় বিশ্লেষণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, NPSB আন্তঃলেনদেন ব্যবস্থায় মোট তিনটি প্রধান ক্ষেত্রে চার্জ কার্যকর করা হয়েছে। সমস্ত চার্জ ও সংখ্যাগত মান সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হলো- ব্যাংক থেকে এমএফএস (Bank – MFS) লেনদেন ০.১৫ শতাংশ। টাকার পরিমাণ (প্রতি হাজারে) ১ টাকা ৫০ পয়সা; এমএফএস থেকে ব্যাংক (MFS-Bank) লেনদেন ০.৮৫ শতাংশ। টাকার পরিমাণ (প্রতি হাজারে) ৮ টাকা ৫০ পয়সা এবং এমএফএস থেকে অন্য এমএফএস (MFS- MFS) লেনদেন ০.৫০ শতাংশ। টাকার পরিমাণ (প্রতি হাজারে) ৫ টাকা।
গ্রাহকের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, প্রায় ৫ কোটি ৫০ লাখ শুধুমাত্র এমএফএস ব্যবহারকারী এখন কম খরচে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবেশ করতে পারবে। ১.৮৫ শতাংশ বা হাজারে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা ক্যাশ আউট চার্জের বিপরীতে ০.৮৫ শতাংশ চার্জে লেনদেনের সুযোগ গ্রাহকের সাশ্রয় নিশ্চিত করবে।
অর্থনৈতিক প্রভাব: এমএফএস ও ব্যাংকের লাভ-ক্ষতির চিত্র
এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর চ্যালেঞ্জ ও লাভ: এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার হার ১.৮৫ শতাংশ থেকে ০.৮৫ শতাংশ কমলেও, চার্জ কমায় লেনদেনের পরিমাণ বহুগুণে বাড়বে। এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর কৌশল হলো কম মুনাফার হারে অধিক ভলিউম তৈরি করা, যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের মোট বার্ষিক আয় বৃদ্ধি করবে।
ব্যাংকের সুবিধা: ব্যাংকগুলোর জন্য এমএফএসে টাকা পাঠানোর ০.১৫ শতাংশ চার্জ একটি নতুন আয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এমএফএস থেকে ব্যাংকে টাকা এলে তাদের ডিপোজিট বেস বৃদ্ধি পাবে, যা ব্যাংকিং খাতের তারল্য বাড়াতে সহায়ক হবে।
রাজস্ব ও ভ্যাট-ট্যাক্স বেনিফিট: এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সংগৃহীত চার্জের ওপর সরকার নির্ধারিত হারে ভ্যাট এবং মোট বার্ষিক মুনাফার ওপর কর্পোরেট ট্যাক্স প্রদান করে। লেনদেনের ভলিউম বাড়লে সরকারের ভ্যাট ও ট্যাক্স সংগ্রহ বাড়বে।
ই-কমার্স খাতে প্রভাব ও নতুন সুযোগ
আন্তঃলেনদেন সুবিধার কারণে ই-কমার্স ও এফ-কমার্স খাতে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ক্রেতারা এখন তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা অন্য কোনও এমএফএস থেকে সহজেই তার পছন্দের এমএফএসে টাকা পাঠাতে পারবে। বিশেষ করে, আন্তঃ এমএফএসে ০.৫০ শতাংশ চার্জ প্রযোজ্য হওয়ায়, ক্যাশলেস পেমেন্ট আরও সহজ হবে। মার্চেন্টরা তাদের এমএফএস পেমেন্ট কম খরচে ০.৮৫ শতাংশ সরাসরি তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিয়ে আসতে পারবে।
লেনদেনের সংখ্যা, রাজস্ব এবং সুশাসনের চ্যালেঞ্জ
দৈনিক ও বার্ষিক লেনদেন: এমএফএস-এর মাধ্যমে দেশে দৈনিক গড়ে প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা থেকে ৩,০০০ কোটি টাকা লেনদেন হয়। বছরে এই লেনদেনের মোট পরিমাণ ১০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
দীর্ঘমেয়াদী সাশ্রয় পরিকল্পনা: জনকল্যাণের স্বার্থে, লেনদেনের ভলিউম একটি নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছালে ০.১৫ শতাংশ, ০.৮৫ শতাংশ এবং ০.৫০ শতাংশ সকল চার্জই পর্যায়ক্রমে আরও কমানোর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা উচিত।
নিরাপত্তা ও ইন্স্যুরেন্স: লেনদেন ব্যর্থ হলে গ্রাহকের অভিযোগ ছাড়াই যেন স্বয়ংক্রিয় রিফান্ড সিস্টেম কাজ করে। এ ছাড়া, গ্রাহকের অর্থ সুরক্ষায় একটি যৌথ ইন্স্যুরেন্স ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা জরুরি।
কাঠামোগত ও নীতিগত পরামর্শ
সরকারি লেনদেনের ইন্টিগ্রেশন: সরকারের সকল প্রকার অর্থ বিতরণ ও সংগ্রহ NPSB প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নিষ্পত্তির নীতি গ্রহণ করা উচিত।
আঞ্চলিক সংযোগ: রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে NPSB-কে সরাসরি আন্তঃসীমান্ত রেমিট্যান্স অপারেটরদের সঙ্গে যুক্ত করা জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পদক্ষেপ দেশের ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য একটি মাইলফলক। এই ব্যবস্থা গ্রাহকের সাশ্রয় নিশ্চিতের পাশাপাশি এমএফএস এবং ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতাকে উৎসাহিত করবে।
লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব