প্রতিবেদন

বাংলাদেশ: প্রযুক্তির যুগে নতুন মহামারী ই-ওয়েস্ট

মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: এরকম ঘটনা আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই আছে। নতুন মোবাইল কিনি, পুরোনোটা ফেলে দিই। নতুন ল্যাপটপ আনি, পুরোনোটার কী হয় সেটা আর ভাবি না। কিন্তু জানেন কি, এই ফেলে দেয়া ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীগুলো আমাদের চারপাশে একটা বিশাল সমস্যা তৈরি করছে।

আমাদের পুরোনো গ্যাজেটগুলো যায় কোথায়
একবার ভেবে দেখুন, আপনার বাড়িতে এই মুহূর্তে কতগুলো পুরোনো মোবাইল ফোন আছে। কতগুলো নষ্ট ব্যাটারি। হয়তো একটা পুরোনো টিভি বা কাজ না করা ল্যাপটপ। এই সবগুলোর একটি নাম আছে ই-ওয়েস্ট মানে ইলেকট্রনিক্স বর্জ্য। বেশিরভাগ সময় আমরা এই জিনিসগুলো ফেলে দিচ্ছি সাধারণ আবর্জনার সঙ্গে। তারপর এগুলো চলে যায় কোথায়, ঢাকার আশপাশের কোনও বস্তিতে। সেখানে দরিদ্র মানুষজন এগুলো ভেঙে দরকারি অংশ বের করে। বাকিটা ফেলে দেয় নদীতে, খালে বা যেখানে-সেখানে।

সংখ্যায় আমাদের সমস্যা
আমাদের দেশে এই সমস্যাটি কতটা বড়, সেটির একটি ধারণা দেই- প্রতি বছর আমরা তৈরি করি প্রায় ৩০ লাখ টন ই-ওয়েস্ট। মানে বুঝতে পারছেন ৩০ লাখ টন! এটি এতো বেশি যে ট্রাকে করে বয়ে নিয়ে যেতে হলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ট্রাকের লাইন দিতে হবে। শুধু মোবাইল ফোন থেকেই প্রতি বছর এক কোটি ইউনিট ই-ওয়েস্ট তৈরি হয়। আর এর মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ সঠিক উপায়ে রিসাইক্লিং হয়। বাকি ৯৭ শতাংশ, সেগুলো নষ্ট করছে আমাদের পরিবেশ। শুধু ঢাকা শহরেই প্রতিদিন জমা হয় ৩০০ টনের বেশি ই-ওয়েস্ট। এটি এতোই বেশি যে একদিনের ই-ওয়েস্ট দিয়ে একটি পুরো ফুটবল মাঠ ভরে ফেলা যাবে।

আসল বিপদটি কি
সমস্যা শুধু জায়গা দখল করা নয়। আসল বিপদ আরও গভীরে। আমাদের মোবাইল, কমপিউটার, ব্যাটারিতে আছে অনেক বিষাক্ত উপাদান। সীসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম- এই নামগুলো শুনলেই বুঝতে পারবেন কতটা ক্ষতিকর। এগুলো মাটিতে মিশে যায়, পানিতে মিশে যায়। তারপর সেই পানি আমরা পান করি, সেই মাটিতে ফসল ফলিয়ে খাই। আর সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই ই-ওয়েস্ট ভাঙার কাজে নিয়োজিত আছে হাজার হাজার শিশু। ছোট্ট বাচ্চারা সারাদিন বিষাক্ত ধুলো শ্বাস নিচ্ছে। তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তারা জানেই না যে এই কাজ তাদের জন্য কতটা বিপজ্জনক। আমাদের নদী-খাল দূষিত হয়ে যাচ্ছে। মাছ বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। কৃষিজমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

বিশাল সুযোগ হারাচ্ছি
কিন্তু এই গল্পের আরেকটি দিক আছে। আমরা যে ই-ওয়েস্টগুলো ফেলে দিচ্ছি, সেগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। একটি মোবাইল ফোনের মধ্যে আছে সোনা, রূপা, তামা, লিথিয়াম- এই সব মূল্যবান ধাতু। এক টন ই-ওয়েস্ট থেকে যতটুকু সোনা পাওয়া যায়, সেটি একটি সোনার খনি থেকে ১০ টন মাটি খুঁড়ে যা পাওয়া যায় তার চেয়েও বেশি। আমরা এই সব কিছুই নষ্ট করে ফেলছি। অথচ সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করলে এখানেই তৈরি হতে পারত হাজার হাজার কর্মসংস্থান।

সমাধান কী
এই সমস্যার সমাধান একদম অসম্ভব নয়। বরং সমাধানগুলো বেশ সহজ। শুধু দরকার সবার একসঙ্গে কাজ করা-
আইন করা: যে প্রতিষ্ঠানগুলো মোবাইল, টিভি, কমপিউটার বিক্রি করে, তাদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে সেগুলোর বর্জ্য সংগ্রহ করার। বিশ্বের অনেক দেশে এই নিয়ম আছে। আমাদের দেশেও এটি করা যায়।
শহরে শহরে ই-ওয়েস্ট কালেকশন সেন্টার বানাতে হবে: মানুষ যেন সহজেই তাদের পুরোনো ইলেকট্রনিকস জমা দিতে পারে। এই মুহূর্তে আমরা জানিই না পুরোনো মোবাইল কোথায় দিতে হবে।

রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে হবে: এখানে তৈরি হবে নতুন চাকরি। আমাদের তরুণরা কাজ পাবে।
মানুষকে সচেতন করতে হবে: স্কুলে, কলেজ, অফিস- সবাইকে বলতে হবে যে ই-ওয়েস্ট আলাদাভাবে ফেলতে হয়।
উৎসাহ দিতে হবে: যে মানুষ পুরোনো মোবাইল ফেরত দেবে, তাকে নতুন মোবাইল কিনতে ছাড় দিতে হবে। এতে মানুষ আগ্রহী হবে।

এখনই সময়
প্রযুক্তির উন্নতি একটি ভালো জিনিস। আমরা সবাই চাই আরও ভালো মোবাইল, আরও দ্রুত কমপিউটার। কিন্তু এই উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দায়িত্বও বাড়ছে। আমরা যদি এখনই ই-ওয়েস্ট নিয়ে ব্যবস্থা না নেই, তাহলে আগামী ১০ বছর বাদে আমাদের শহরগুলো হয়ে ওঠবে বিশাল ই-ওয়েস্টের ডাম্পিং গ্রাউন্ড। আমাদের বাচ্চারা বাস করবে বিষাক্ত পরিবেশে।

কিন্তু সময় এখনও আছে। আমরা এখনও পারি এই সমস্যার সমাধান করতে। আর সেই সমাধানের মধ্যে দিয়ে তৈরি করতে পারি একটা নতুন শিল্প, নতুন কর্মসংস্থান। আমাদের শুধু একটু সচেতন হতে হবে। আমাদের পুরোনো গ্যাজেটগুলো যত্রতত্র না ফেলে সঠিক জায়গায় জমা দিতে হবে। এই ছোট্ট একটি কাজ করেই আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ রেখে যেতে পারি। আর মনে রাখবেন, প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করার জন্য, জটিল করার জন্য নয়।

লেখক: মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম:- ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি (লি.) এবং সভাপতি- বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি (বিসিএস)

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *