প্রযুক্তি যখন মাঠে নামে, তখন কৃষক শুধু শ্রমিক নয়- উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন

মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: একজন কৃষক প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভাঙান। পিঠে কাঁচা ব্যথা, মাথায় ধার শোধের টান। তবুও হাসি মুখে মাঠে যান। কারণ তার বিশ্বাস, এই জমিই তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ। একজন খামারি প্রতিদিন মুরগির খামারে ঢুকে শ্বাস চেপে রাখেন। না জানি আজ কতটা মুরগি হঠাৎ অসুস্থ হবে। একজন মাছচাষি রাত্রি ৩টায় ওঠে পুকুরে যান-জল ঘোলা কিনা দেখতে। তাদের হাতে নেই প্রযুক্তি। তারা জীবন দিয়ে খাদ্য উৎপাদন করেন, কিন্তু ফল পান না সেভাবে।
ভাইরাস এলে সব মরে যায়। মূল্য পড়ে গেলে লোকসান চেপে বসে। তাদের জন্য একটুখানি প্রযুক্তি মানে-একটুখানি আশা। কেমন হতে পারত জীবন, যদি প্রযুক্তি থাকত পাশে? মোবাইল অ্যাপে যদি জানা যেত- জমিতে কীটনাশক লাগবে কিনা, ফিশ সেন্সর যদি জানিয়ে দিত-পানিতে অক্সিজেন কমে গেছে, ডিজিটাল ভেট অ্যাপ যদি বলে দিত-গরুটা কেন হঠাৎ কাঁপছে, কোল্ড স্টোরেজ যদি ফসলটি দুইদিন ধরে রাখত- বাজারে ভালো মূল্যে বেচার সুযোগ দিত। তাহলে হয়তো কৃষক আর শ্রমিক থাকতেন না, তারা হয়ে ওঠতেন উদ্যোক্তা।
বাংলাদেশের কৃষি, পোলট্রি, মৎস্য ও পশুপালন খাত এখন এক নীরব সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে। এই খাতগুলোর উন্নয়নে প্রযুক্তিই হতে পারে সবচেয়ে বড় বাঁক পরিবর্তনের মাধ্যম।
বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক বাস্তবতা
৪.৮ কোটি মানুষ কৃষি-নির্ভর। বছরে উৎপন্ন মাছ: প্রায় ১০ লাখ টন। ১.৮ লাখ পোলট্রি খামার। ৭৫ লাখ নারী গবাদিপশু পালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু ৭০% এর বেশি এখনও প্রযুক্তি বা সঠিক বাজার তথ্য থেকে বঞ্চিত। প্রায় ৩০–৩৫% ফল, দুধ বা মাছ পচে নষ্ট হয় সংরক্ষণের অভাবে।
প্রযুক্তি কীভাবে বদলাতে পারে তাদের জীবন
ফসল ও ফলমূল চাষে: ড্রোন ইমেজিং ও সয়েল হেলথ সেন্সর জমির অবস্থা ও সার প্রয়োগ ঠিক করে। কৃষি মোবাইল অ্যাপ-আবহাওয়ার পূর্বাভাস, রোগ-পোকার সতর্কতা। কোল্ড চেইন ট্রাক-ফল বা শাক সবজি পচে না, বাজারে ভালো মূল্য পাওয়া যায়।
পোলট্রি খাতে: স্মার্ট সেন্সর ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, আর্দ্রতা ঠিক রাখে-রোগ কমে। এআই রোগ শনাক্তকরণ-ছবি তুলে মুরগির চোখ, পালক দেখে রোগ চেনা। অটোমেটেড ফিডিং ও ওজন ট্র্যাকিং-খাওয়ার পরিমাণ ট্র্যাক করে ওষুধ বা খাবারে রেগুলেশন আনে মুরগির বেড়ে ওঠা ও খরচ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
মৎস্য খাতে: আইওটি ফিশ ট্যাংক- অক্সিজেন ও pH লেভেল রিয়েল-টাইমে জানা যায়। অটো ফিডার ও টেম্পারেচার এলার্ট- মাছ কম মরে, উৎপাদন বাড়ে। ডেটা-ভিত্তিক ফার্মিং অ্যাপ-কোন পুকুরে কোন মাছ বেশি ফলদায়ক।
গবাদিপশু পালনে: ডিজিটাল ভেট অ্যাপ-গরু বা ছাগলের রোগ চিহ্নিত করে। দুধ উৎপাদন ট্র্যাকার-কোন খাবারে কত দুধ আসে তা বোঝা যায়। বাজার সংযুক্ত অ্যাপ-পশু বিক্রি করা যায় ন্যায্য মূল্যে, অনলাইনেই।
এই খাতগুলোতে প্রযুক্তি বাস্তবায়ন
ছোট উদ্যোগেই বড় পরিবর্তন: প্রতিটি ইউনিয়নে এগ্রি-টেক বন্ধু গড়ে তোলা-যারা কৃষককে অ্যাপ, সেন্সর ও মোবাইল ব্যবহার শিখাবে। নারী খামারিদের জন্য গ্রামীণ টেক প্রশিক্ষণ সেশন। কৃষকদের জন্য সহজ ও সস্তায় সাবসিডি ভিত্তিক স্মার্ট টুল ভাড়ার ব্যবস্থা।
পলিসি লেভেলে যা প্রয়োজন: উপজেলা পর্যায়ে প্রযুক্তি-সক্ষম কৃষি পরিষেবা কেন্দ্র স্থাপন। মোবাইল মার্কেটিং প্ল্যাটফর্ম- চাষি সরাসরি দর দেখতে ও পণ্য বিক্রি করতে পারবে। ডেটা-ভিত্তিক কৃষি ঋণ স্কিম- উৎপাদন ও রেকর্ড দেখে লোন অনুমোদন। কোল্ড চেইন অবকাঠামোতে বিনিয়োগ- মাছ, দুধ, ফলমূল রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক।
একটি সামষ্টিক আহ্বান
যারা আমাদের খাওয়ায়, তারা যেন নিজের পরিবারের মুখে ঠিকমতো খাবার দিতে পারেন- এটিই প্রযুক্তির ন্যায্যতা। কৃষি মানে শুধু কষ্ট নয়, কৃষি হোক জ্ঞান ও উদ্ভাবনের ভিত্তি। প্রযুক্তি যেন শহরের হাইটেক পার্কে সীমাবদ্ধ না থেকে মাঠে নামে, কারণ ফসল যেমন জমিতে ফলে, তেমনি দেশের স্বপ্নও গ্রাম থেকেই শুরু হয়।
লেখক: মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম- ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্মার্ট টেকনোলজিস (বিডি) লি. ও সভাপতি বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি (বিসিএস)