প্রতিবেদন

ডিজিটাল ব্যাংকিং বিপ্লব: আর্থিক খাতে প্রযুক্তির ভূমিকা

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): বর্তমান বিশ্ব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। তথ্যপ্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো ব্যাংকিং খাত। ঐতিহ্যবাহী ব্যাংকিংয়ের ধারণা পাল্টে এখন ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের জয়জয়কার। এই পরিবর্তন কেবল উন্নত দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এর প্রভাব ব্যাপক। ডিজিটাল ব্যাংকিং কেবল লেনদেনের প্রক্রিয়াকে সহজ করেনি, বরং সমাজের এক বিশাল অংশকে আর্থিক সেবার আওতায় এনে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করেছে। এই লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশে এর যাত্রা, অর্থনীতিতে এর প্রভাব এবং এর সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরা।

ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের বৈশ্বিক যাত্রা: শুরু এবং গ্রহণযোগ্যতা
ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সূচনা হয়েছিল মূলত ইন্টারনেটের আবির্ভাবের পর। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের প্রথম ধারণাটি আসে। ১৯৯৪ সালে স্ট্যানফোর্ড ফেডারেল ক্রেডিট ইউনিয়ন সর্বপ্রথম ওয়েব-ভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা চালু করে। এরপর থেকে, ইন্টারনেট এবং মোবাইল প্রযুক্তির দ্রুত প্রসারের ফলে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের ধারণা আরও শক্তিশালী হয়।

প্রাথমিক পর্যায়ে, ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের গ্রহণযোগ্যতা খুব বেশি ছিল না। গ্রাহকদের মধ্যে অনলাইন লেনদেনের নিরাপত্তা এবং নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে এক ধরনের সংশয় ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে এই সংশয় দূর হয়। ২০০০-এর দশকের শুরুতে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আবির্ভাব ঘটে, যা ডিজিটাল ব্যাংকিংকে আরও সহজলভ্য করে তোলে। বর্তমানে, স্মার্টফোন এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ডিজিটাল ব্যাংকিংকে দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশে পরিণত করেছে। উন্নত দেশগুলোতে বেশিরভাগ ব্যাংকিং কার্যক্রম এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সম্পন্ন হয়।

বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সূচনা ও বিকাশ
বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের যাত্রা হয় মূলত মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) এর মাধ্যমে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং নীতিমালা জারি করার পর, ২০১১ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের সহায়তায় বিকাশ তার কার্যক্রম শুরু করে। এরপর রকেট, নগদ, উপায়-এর মতো অন্যান্য এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো আসে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এর মূল কারণ ছিল এর সহজ ব্যবহার, দ্রুত লেনদেনের সুবিধা এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আর্থিক সেবা পৌঁছে দেয়ার সক্ষমতা।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের বিপ্লব
ডিজিটাল ব্যাংকিং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। এর প্রধান কিছু প্রভাব নিচে তুলে ধরা হলো-
আর্থিক অন্তর্ভুক্তি: বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ, বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, প্রথাগত ব্যাংকিং সেবার বাইরে ছিল। এমএফএস এবং ডিজিটাল ব্যাংকিং এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবার আওতায় এনেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রায় ২০ কোটির বেশি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনীতির গতিশীলতা বেড়েছে। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা (এসএমইএস) এখন সহজে লেনদেন করতে পারছেন, যা তাদের ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারিত করতে সাহায্য করছে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে আর্থিক কার্যক্রমের একটি ডিজিটাল রেকর্ড তৈরি হয়, যা অর্থপাচার এবং অনানুষ্ঠানিক লেনদেন কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। এতে আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়।

ডিজিটাল ব্যাংকিং সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও উপাত্ত
ব্যাংকের সংখ্যা ও লেনদেন: বর্তমানে বাংলাদেশে ৬১টি ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে প্রায় সবগুলো ব্যাংকই তাদের নিজস্ব ডিজিটাল ব্যাংকিং অ্যাপ বা প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুসারে (২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিক), মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে মাসিক লেনদেনের পরিমাণ ১ লক্ষ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। অন্যদিকে, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

লেনদেনকারী শ্রেণি: ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেনকারীদের মধ্যে তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষার্থী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শহরে কর্মরত ব্যক্তিরা তাদের পরিবারের কাছে গ্রামে টাকা পাঠানোর জন্য এমএফএস ব্যবহার করেন। অন্যদিকে, শহর অঞ্চলে বেতন, বিল পরিশোধ এবং অনলাইন কেনাকাটার জন্য ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার বেশি।

শহর ও গ্রামাঞ্চলে সাড়া: ডিজিটাল ব্যাংকিং শহর এবং গ্রামাঞ্চল উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। শহরের মানুষজন ইন্টারনেট ব্যাংকিং এবং মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা নিচ্ছেন। অন্যদিকে, গ্রামাঞ্চলে এমএফএস এর এজেন্ট পয়েন্টগুলো আর্থিক লেনদেনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

নীতিমালা, গ্রাহক সুরক্ষা এবং প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা- ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
ডিজিটাল ব্যাংক নীতিমালা, ২০২৩: এই নীতিমালা অনুযায়ী, দেশে ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপন ও পরিচালনার জন্য একটি সুস্পষ্ট কাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
মোবাইল ব্যাংকিং নীতিমালা: মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম, লেনদেনের সীমা এবং গ্রাহক সুরক্ষার নিয়মাবলী এই নীতিমালায় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
গ্রাহক সুরক্ষা: ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো সাইবার নিরাপত্তা। হ্যাকিং, ফিশিং এবং অনলাইন প্রতারণা থেকে গ্রাহকদের রক্ষা করতে ব্যাংকগুলো উন্নত এনক্রিপশন পদ্ধতি, দ্বি-স্তর যাচাইকরণ এবং নিয়মিত নিরাপত্তা নিরীক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও গ্রাহকদের সচেতন করতে বিভিন্ন সময় নির্দেশনা জারি করে।

বিভিন্ন খাতে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের উপযোগিতা
ডিজিটাল ব্যাংকিং শুধু ব্যাংকিং খাতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতকেও প্রভাবিত করেছে-
ই-কমার্স: ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো ডিজিটাল পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে ক্রেতাদের জন্য সহজ ও নিরাপদ লেনদেনের সুযোগ করে দিয়েছে। ডিজিটাল ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং এবং কার্ড পেমেন্টের মাধ্যমে এখন ক্রেতারা ঘরে বসেই পণ্য ও সেবার মূল্য পরিশোধ করতে পারছেন।

সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান: বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, ইন্টারনেট এবং অন্যান্য ইউটিলিটি সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ডিজিটাল বিল পেমেন্টের সুবিধা দিচ্ছে। এতে গ্রাহকদের লম্বা লাইনে দাঁড়ানোর কষ্ট কমেছে এবং সময় সাশ্রয় হচ্ছে।

সফটওয়্যার কোম্পানি: আইটি এবং সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো ব্যাংকিং খাতের জন্য কোর ব্যাংকিং সলিউশন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং মোবাইল অ্যাপ তৈরি করছে। এসব প্রযুক্তিগত সমাধান ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

ডিজিটাল ব্যাংকিং শুধু একটি প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়, এটি বাংলাদেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এমএফএস এর মাধ্যমে শুরু হওয়া এই যাত্রা এখন ডিজিটাল ব্যাংক এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন দিগন্তে পৌঁছাচ্ছে। যদিও এর সঙ্গে কিছু চ্যালেঞ্জ যেমন সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল বিভাজন এবং গ্রাহক শিক্ষার অভাব জড়িত, তবে সঠিক নীতি, প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ এবং সচেতনতার মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। ডিজিটাল ব্যাংকিং এবং এর সঙ্গে জড়িত প্রযুক্তিগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও গতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবে।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *