প্রতিবেদন

ক্লিকের আড়ালে ভেজাল: গ্রাহক ঝুঁকিতে ও রাষ্ট্রের ১৩ দফা চ্যালেঞ্জ

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিতে অনলাইন খাদ্যপণ্যের বাজার দ্রুত এক বিশাল অংশ দখল করে নিয়েছে। বর্তমানে দেশে লক্ষাধিক অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪০ শতাংশেরও বেশি প্রতিষ্ঠান খাদ্য, মুদিপণ্য এবং স্বাস্থ্যবর্ধক পণ্য সরবরাহ করে। বাজার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই অনলাইন খাদ্য মার্কেট প্রতি বছর ১২ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দৈনিক প্রায় ১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ খাদ্যপণ্য সংক্রান্ত অর্ডার হয়।

ক্রেতাদের সময় বাঁচানো ও সহজে পণ্য পাওয়ার সুবিধার আড়ালে রয়েছে লাইসেন্সবিহীন বিক্রি, ভেজাল এবং নিম্নমানের পণ্য সরবরাহের মারাত্মক চ্যালেঞ্জ, যা সরাসরি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। বিপুল সংখ্যক ই-কমার্স ও এফ-কমার্স উদ্যোক্তার এই বাজারে পণ্যটির স্বাস্থ্যসম্মত, অথেন্টিক ও ভেজালমুক্ত মান নিশ্চিত করা এখন রাষ্ট্রের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

সর্বাধিক বিক্রীত খাদ্যপণ্য ও মানের প্রশ্ন
অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে মুদিপণ্য ও রান্না করা খাবার ছাড়াও বিশেষায়িত এবং ঐতিহ্যবাহী পণ্যের চাহিদা তুঙ্গে। সর্বাধিক বিক্রীত কিছু খাদ্যপণ্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা-

১. প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেজড খাদ্য: ঘি, মধু, সরিষার তেল ও নারিকেল তেল (যা ‘ঘানিতে ভাঙা’ হিসেবে পরিচিত), বিভিন্ন ধরনের মশলার গুঁড়ো, ড্রাই ফ্রুটস, প্রিমিয়াম চা-কফি।
২. ঐতিহ্যবাহী ও বিশেষ খাদ্য: শীতকালীন খেজুরের গুড়, বিভিন্ন আঞ্চলিক পিঠা, হাতে তৈরি আচার, বালাচাও, হোমমেড বাটার, চিজ, পনির।

৩. স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবর্ধক: প্রোটিন পাউডার, বিভিন্ন ধরনের ফুড সাপ্লিমেন্ট, সিডস্ (তিসি, চিয়া), অর্গানিক চা-কফি এবং ডায়াবেটিক বা ডায়েট ফুড।
৪. তাজা পণ্য: চাল, ডাল, সবজি ও মাংসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় মুদিপণ্য (বিশেষ করে চালডাল, দারাজের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে)।

এই সকল পণ্য বিক্রেতাদের একটি বড় অংশ তাদের পণ্যকে ‘১০০% খাঁটি’, ‘অর্গানিক’ বা ‘কেমিক্যাল-মুক্ত’ বলে দাবি করলেও, প্রায়শই যথাযথ প্রমাণপত্র (যেমন- বিএসটিআই, বিএফএসএ সনদ বা ল্যাব টেস্ট রিপোর্ট) দিতে ব্যর্থ হন। এই ফাঁক গলে চিনির সিরা মিশ্রিত মধু, কৃত্রিম রং মেশানো গুড়, বা কম গুণগত মানের উপাদান দিয়ে তৈরি ফুড সাপ্লিমেন্ট বাজারে চলে আসছে, যা সরাসরি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিক্রি হওয়া অনেক পাউডারের উপাদান, কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক তথ্য থাকে না এবং সেগুলো প্রায়শই লাইসেন্সবিহীনভাবে বিক্রি হয়।

নিরাপদ খাদ্য আইন: ভেজাল রোধে রাষ্ট্রের কঠোর অবস্থান ও লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া
খাদ্যে ভেজাল ও দূষণ রোধে বাংলাদেশ সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এবং এর অধীনে প্রণীত বিভিন্ন প্রবিধানমালায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। লাইসেন্স ছাড়া খাদ্যপণ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ বা বিক্রয় করা আইনগতভাবে সম্পূর্ণ অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

নীতিমালার মূল নির্দেশনা এবং লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তা
আইনের ২৫ ধারায় সুস্পষ্টভাবে ভেজাল খাদ্য উৎপাদন বা বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে এবং আইন অমান্য করলে লাইসেন্স বাতিল, সর্বোচ্চ পাঁচ বছর জেল এবং তিন লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে। খাদ্য ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিকে নিম্নলিখিত প্রধান লাইসেন্স বা অনুমোদনের মাধ্যমে আইনি বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে হয়-
ট্রেড লাইসেন্স: ব্যবসার প্রাথমিক অনুমোদন।
বিএফএসএ রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স: নিরাপদ খাদ্য আইন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক নিবন্ধন।
বিএসটিআই সার্টিফিকেশন মার্কস: বাধ্যতামূলক ১০৯টি পণ্যের জন্য গুণগত মানের সনদ।
উদ্যোক্তাদের জন্য সহজীকরণ: লক্ষ লক্ষ ই-কমার্স ও এফ-কমার্স উদ্যোক্তাকে আইনের আওতায় আনতে, সরকারকে অবশ্যই অনলাইন ওয়ান-স্টপ-সার্ভিস সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষুদ্র ও এফ-কমার্স উদ্যোক্তাদের প্রথম দুই বছরের জন্য লাইসেন্সিং ফি-তে বিশেষ ছাড় বা সাবসিডি দেওয়া যেতে পারে।

ভেজালকারীকে শনাক্তকরণ ও গ্রাহকের সুরক্ষা কৌশল
অনলাইন বাজারে ভেজালকারী ও খাঁটি বিক্রেতাকে শনাক্ত করা এবং প্রতারণা থেকে বাঁচার জন্য গ্রাহকদের সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি বা লোভনীয় বিজ্ঞাপনে মুগ্ধ না হয়ে, বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য নিম্নলিখিত কৌশলগুলো অনুসরণ করা উচিত-

১. গ্রাহক কীভাবে আসল পণ্য বেছে নেবেন
লাইসেন্স ও প্রমাণপত্রের প্রমাণ দাবি: বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করুন, তাদের ট্রেড লাইসেন্স, বিএফএসএ বা বিএসটিআই রেজিস্ট্রেশন নম্বর আছে কিনা এবং সম্ভব হলে লাইসেন্সের বৈধতার প্রমাণস্বরূপ ছবি বা লিংক দেখতে চাইতে হবে।

লেবেলের সঠিকতা যাচাই: পণ্যের লেবেলে প্রস্তুতকারকের সম্পূর্ণ ঠিকানা, উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এবং উপাদান তালিকা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে কিনা, তা যাচাই করুন।
পর্যালোচনার গুণগত মান: শুধু স্টার রেটিং নয়, পর্যালোচনার সুনির্দিষ্টতা দেখে পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে ধারণা নেয়া।
অতিরিক্ত মিথ্যা দাবি সম্পর্কে সচেতনতা: যদি কোনও বিজ্ঞাপন কোনও পণ্যকে ‘ম্যাজিক বুলেট’ বা ‘অসাধ্য সাধনকারী’ হিসেবে দাবি করে, তবে সেই বিজ্ঞাপনটিকে মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত মনে করে এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।

২. কর্তৃপক্ষের করণীয়
ইনফ্লুয়েন্সার রেগুলেশন: বিএফএসই এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে অবশ্যই বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা তৈরি করতে হবে। যদি কোনও বিজ্ঞাপনে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর দাবি প্রমাণিত হয়, তবে শুধু বিক্রেতা নয়, সেই বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণকারী বা প্রচারকারী প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার বিধান থাকা উচিত।

লাইসেন্সিং ডেটাবেজ বাধ্যতামূলক করা: বিএফএসই বা বিএসটিআই-এর অনলাইন ডেটাবেজে সব লাইসেন্সধারী বিক্রেতার তালিকা প্রকাশ করা এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোতে সেই তালিকা অনুযায়ী বিক্রেতাদের রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা।
ট্র্যাক রেকর্ড পর্যবেক্ষণ: যে বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে, তাদের প্রোফাইলে সতর্কবার্তা দেখানো বা প্ল্যাটফর্ম থেকে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া।

খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এবং ১৩ দফা সুপারিশ
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের মূল দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি, ভোক্তা অধিকার সংগঠন, গবেষণা সংস্থা এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ যারা সরাসরি খাদ্য নিয়ে কাজ করছেন, তাদের পরামর্শ ও অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এই সম্মিলিত উদ্যোগে বাজারে শৃঙ্খলা আনতে ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে-

১. প্ল্যাটফর্মের দায়বদ্ধতা: বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোতে বিক্রেতার লাইসেন্সিং নম্বর প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা।
২. নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি: বিএফএসই বা বিএসটিআই-এর ল্যাব সক্ষমতা ও পরিদর্শকদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি করা।
৩. ডিজিটাল সার্টিফিকেশন: পণ্যের জন্য কিউআর কোড ভিত্তিক সার্টিফিকেশন সিস্টেম চালু করা।

৪. ফুড সাপ্লিমেন্টের বিশেষ নিয়মাবলী: স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাপ্লিমেন্ট বিক্রির জন্য কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা।
৫. ক্রস-বর্ডার পর্যবেক্ষণ: আমদানি করা খাদ্য এবং সাপ্লিমেন্টের ওপর বিএফএসএ-এর তদারকি বাড়ানো।
৬. পণ্য প্রত্যাহারের দ্রুত ব্যবস্থা: জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য বাজার থেকে দ্রুত প্রত্যাহারের জন্য একটি ন্যাশনাল ফুড রিকল পোর্টাল তৈরি করা।

৭. কোল্ড চেইন ব্যবস্থাপনা: হিমায়িত পণ্যের জন্য কঠোর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকা প্রণয়ন করা।
৮. এফ-কমার্স মনিটরিং: সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে কেবল বৈধ লাইসেন্সধারী বিক্রেতাদের বিজ্ঞাপন দেয়ার সুযোগ সীমিত করা।
৯. ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার: দীর্ঘমেয়াদে, পণ্যের সরবরাহ চেইন (ফার্ম-টু-টেবিল) ট্র্যাক করতে ব্লকচেইন পাইলট প্রকল্প চালু করা।

১০. আন্তঃসংস্থা সমন্বয়: বিএফএসই, বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ই-ক্যাব সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে ডেটা শেয়ারিং এবং যৌথ এনফোর্সমেন্ট টিম গঠন করা।
১১. জনস্বাস্থ্যকর্মী ও পরিদর্শক প্রশিক্ষণ: ই-কমার্স এবং ডিজিটাল প্রমাণ সংগ্রহের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষণ চালু করা।
১২. আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সমন্বয়: দেশের খাদ্য আইন ও প্রবিধানমালাকে কোডেক্স অ্যালিমেন্টারিয়াস কমিশন এর মতো আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সমন্বয় করা।
১৩. সাবসিডি ও ওয়ান-স্টপ-সার্ভিস: ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সহজ করতে আর্থিক ছাড় এবং অনলাইন ওয়ান-স্টপ-সার্ভিস চালু করা।

অনলাইন খাদ্যবাজারের দ্রুত প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অপার সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। তবে, এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ভেজালের ফাঁদ এবং গ্রাহকের স্বাস্থ্যঝুঁকি একটি অনস্বীকার্য সত্য। এটি এখন শুধু নিয়ন্ত্রক সংস্থার একক দায়িত্ব নয়, বরং সরকার, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম, ভোক্তা অধিকার সংগঠন, এবং প্রত্যেক গ্রাহকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। উপরে বর্ণিত ১৩ দফা কৌশলগত ও প্রযুক্তিগত পরামর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশেষ করে ডিজিটাল সার্টিফিকেশন, ব্লকচেইন ট্র্যাকিং এবং আন্তঃসংস্থা সমন্বয় এই বাজারকে কেবল ভেজালমুক্ত করাই নয়, বরং একে একটি আন্তর্জাতিক মানের এবং বিশ্বাসযোগ্য খাদ্য সরবরাহ প্ল্যাটফর্মে পরিণত করা সম্ভব। এই সম্মিলিত উদ্যোগই পারে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে ডিজিটাল অর্থনীতির সত্যিকারের সুফল ঘরে তুলতে।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *