একটিই লক্ষ্য হোক দক্ষতা: শিক্ষা ও উদ্যোক্তা জীবনে দক্ষতা উন্নয়নের অপরিহার্যতা

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): বর্তমান বিশ্বের দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি আর সনদের ওপর নির্ভর করে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছানো কঠিন। ‘একটিই লক্ষ্য হতে হবে দক্ষ’- এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, যেখানে পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনের ওপরও সমান গুরুত্ব দেয়া হবে। বিশেষত, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন অপরিহার্য। এই দক্ষতা কেবল ব্যক্তিগত জীবন বা কর্মজীবনের ক্ষেত্রেই নয়, একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বনাম দক্ষতা: একটি নতুন সমীকরণ
ঐতিহ্যগতভাবে, আমাদের সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই সফলতার একমাত্র চাবিকাঠি হিসেবে দেখা হয়েছে। ভালো ফল, উচ্চশিক্ষা এবং একটি ভালো চাকরির লক্ষ্যেই বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ও অভিভাবক তাদের প্রচেষ্টা ব্যয় করেন। কিন্তু আধুনিক শ্রমবাজারের চাহিদা এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আগমন এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। এখন কেবল মুখস্থ বিদ্যা বা তত্ত্বীয় জ্ঞান নয়, বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে সক্ষম ব্যবহারিক দক্ষতা এবং নতুন কিছু শেখার আগ্রহই কর্মজীবনে সফল হওয়ার পূর্বশর্ত।
আমরা দেখছি, উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের হার ক্রমবর্ধমান। এর একটি বড় কারণ হলো, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে শিল্প ও ব্যবসার বাস্তব চাহিদার সমন্বয়হীনতা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর যে বিপুল সংখ্যক স্নাতক বের হচ্ছেন, তাদের অনেকেরই শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকে না। ফলে চাকরির বাজারে তাদের হিমশিম খেতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়নকে আর ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে দেখা যাবে না, বরং এটি হয়ে ওঠেছে অত্যাবশ্যকীয়। দক্ষতা উন্নয়নের বিভিন্ন দিক ও এর অপরিহার্যতা- জীবনে লক্ষ্য অর্জন বা প্রতিষ্ঠিত হতে হলে যে সকল দক্ষতা অপরিহার্য, সেগুলোকে মোটা দাগে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:

০১. সফট স্কিলস (Soft Skills)
এগুলো হলো আন্তঃব্যক্তিক এবং ব্যক্তিগত গুণাবলী যা কর্মক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। স্পষ্ট ও কার্যকর যোগাযোগ পেশাগত সম্পর্ক স্থাপন এবং সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে। উদ্যোক্তাদের জন্য গ্রাহক, বিনিয়োগকারী ও কর্মীদের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ ব্যবসার প্রসারের জন্য জরুরি। দ্রুত ও কার্যকরভাবে সমস্যা চিহ্নিত করা ও সমাধানের ক্ষমতা সফল ব্যক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
একা কাজ করার সুযোগ সীমিত; একটি দলের অংশ হিসেবে কাজ করা এবং সম্মিলিত লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা এবং নতুন জ্ঞান অর্জনে ইচ্ছুক থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অন্যদের অনুপ্রাণিত করা, নির্দেশনা দেয়া এবং একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করার ক্ষমতা পেশাগত জীবনে এগিয়ে নিয়ে যায়। সময়ের সঠিক ব্যবহার এবং কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণের ক্ষমতা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। নতুন ধারণা তৈরি এবং প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
০২. হার্ড স্কিলস (Hard Skills)
এগুলো হলো নির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য এবং শেখার মতো দক্ষতা যা কোনও নির্দিষ্ট কাজ বা পেশার জন্য প্রয়োজনীয়। ডিজিটাল যুগে কমপিউটার লিটারেসি, মাইক্রোসফট অফিস, ডেটা অ্যানালাইসিস টুলস, কোডিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদি দক্ষতা অপরিহার্য। বিপুল পরিমাণ ডেটা থেকে অর্থপূর্ণ তথ্য বের করার ক্ষমতা আজকাল প্রায় সকল শিল্পের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক অর্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা, বাজেট তৈরি ও আর্থিক ঝুঁকি বোঝার ক্ষমতা সফলতার জন্য জরুরি। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও ব্যবসার প্রসারের জন্য একাধিক ভাষা জানা একটি মূল্যবান সম্পদ। বিক্রয় ও বিপণন দক্ষতা: যেকোনও পণ্য বা সেবার সফলতার জন্য কার্যকর বিক্রয় ও বিপণন কৌশল জানা আবশ্যক।
উদ্যোক্তা জীবনে দক্ষতার ভূমিকা ও অপরিহার্যতা
একজন উদ্যোক্তা হলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি ঝুঁকি নিয়ে নতুন কিছু তৈরি করেন, ব্যবসা শুরু করেন এবং পরিচালনা করেন। উদ্যোক্তা হওয়ার পথটি মসৃণ নয়; এখানে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ এবং অনিশ্চয়তা থাকে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সফল হওয়ার জন্য ওপরে উল্লিখিত দক্ষতাগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একটি ভালো আইডিয়া থাকলেই চলে না, সেই আইডিয়াকে বাস্তবে রূপান্তর করার জন্য বহুমুখী দক্ষতার প্রয়োজন হয় একজন উদ্যোক্তা একই সঙ্গে বিপণনকারী, বিক্রেতা, হিসাবরক্ষক, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক এবং একজন দূরদর্শী নেতা। এসব ভূমিকা পালনে উল্লেখিত সফট ও হার্ড স্কিলসগুলো অপরিহার্য। পাশাপাশি, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, নেটওয়ার্কিং, স্ব-প্রণোদনা ও শৃঙ্খলা এবং গ্রাহক সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা একজন সফল উদ্যোক্তার জন্য অত্যাবশ্যক।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের দক্ষতা অর্জনে অবদান
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপাপটে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (বিটিইবি) দক্ষতা উন্নয়নে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের বিশাল কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তরের ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দেশের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বাবধান এবং উন্নয়নের জন্য গঠিত একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এর প্রধান কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে:
বিটিইবি শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রণয়ন ও নিয়মিত আপডেট করে। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও অন্যান্য ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফলের ভিত্তিতে ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট প্রদান করে বিটিইবি। কারিগরি শিক্ষা বোর্ড বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিভুক্তি প্রদান করে এবং তাদের শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ করে।
বিটিইবি শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করে। শিল্পের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে বিটিইবি শিল্পের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কারিকুলাম ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতির উন্নতি সাধন করে। বাজারের পরিবর্তিত চাহিদা অনুযায়ী বিটিইবি নতুন নতুন ট্রেড ও কোর্স চালু করে, যেমন তথ্যপ্রযুক্তি, ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদি।
কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব ও অবদান
কারিগরি শিক্ষা শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে তৈরি করে, যা তাদের দ্রুত কর্মসংস্থান পেতে সাহায্য করে। এটি দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব হ্রাসে ভূমিকা রাখছে। কারিগরি শিক্ষা শুধু চাকরির জন্যই নয়, স্ব-কর্মসংস্থান বা উদ্যোক্তা হওয়ার জন্যও দারুণ সুযোগ সৃষ্টি করে। এ ছাড়াও, দেশের অর্থনীতিতে দক্ষ জনবলের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে এটি জাতীয় উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
‘একটিই লক্ষ্য হতে হবে দক্ষ’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা জরুরি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জনের ওপর জোর দিতে হবে, কারণ এটিই আজকের বিশ্বের চাহিদা। সফট স্কিলস এবং হার্ড স্কিলস উভয়ের উন্নয়নই ব্যক্তি জীবন ও কর্মজীবনে সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এই লক্ষ্য পূরণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।
তবে, এই ধারাকে আরও গতিশীল করতে হলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ জনগণেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। দক্ষতা উন্নয়নকে জাতীয় অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং কারিগরি শিক্ষার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। যখন আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে দক্ষতাকেই মূল লক্ষ্য হিসেবে দেখা হবে, তখনই আমরা একটি সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হব।
লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব