প্রতিবেদন

অস্থিরতার বাজারে টিকে থাকার লড়াই: বাংলাদেশের ই-কমার্স ও এসএমই খাত

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তীতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আগমন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক গভীর অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। এই পটপরিবর্তনের প্রায় এক বছর পর, দেশের ই-কমার্স ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) খাত এখনও স্থিতিশীলতা খুঁজে ফিরছে। আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকার আসা পর্যন্ত এই খাতগুলোর বর্তমান চ্যালেঞ্জ, অর্থনৈতিক প্রভাব এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা নিয়ে বিশ্লেষণ।

জুলাই-আগস্টের সংকটের সংখ্যাগত অর্থনৈতিক প্রভাব
রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জরুরি অবস্থার সময় ইন্টারনেট ও লজিস্টিকস বন্ধ থাকায় এই খাত দুটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, এই অস্থিরতার কারণে স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যায়- ২০২৩ সালে ৭১ মিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৪-এ তা নেমে আসে মাত্র ৩৫ মিলিয়নে। অন্যদিকে, দৈনিক প্রায় ১০০ কোটি টাকার লেনদেন সম্পূর্ণ থমকে যাওয়ায় উদ্যোক্তাদের পুঁজি দ্রুত হ্রাস পায়। জিডিপিতে ৩২ শতাংশ অবদান রাখা এসএমই খাতের পণ্য উৎপাদন ও কাঁচামাল আমদানি প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি বহু অর্ডার বাতিল হয়।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অনেকেই মন্তব্য করেছেন, “ব্যবসা এখন আর প্রবৃদ্ধি নয়, টিকে থাকার লড়াই। উচ্চ সুদের কারণে নতুন বিনিয়োগে যেতে সাহস পাচ্ছি না।”

ই-কমার্স বাজারের বর্তমান চিত্র ও লজিস্টিক সাপোর্ট
সংকটকালীন ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতটি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলেও, এর গতি এখনও মন্থর। বর্তমানে বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজারের আর্থিক মূল্য আনুমানিক ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা বিশ্বব্যাপী ৩১তম বৃহৎ বাজার। অর্থনৈতিক চাপের কারণে অর্ডারের পরিমাণ এবং গড় বাস্কেট সাইজ কমেছে। লজিস্টিকস বর্তমানে সচল থাকলেও, উচ্চ পরিচালন খরচের কারণে ডেলিভারি চার্জ বেড়েছে। সাড়ে তিন লাখ ফেসবুক পেজের মাধ্যমে পরিচালিত এফ-কমার্স দ্রুত মানিয়ে নেয়ার সক্ষমতা দেখিয়ে টিকে আছে।

নীতিগত শূন্যতা, ভ্যাট-ট্যাক্স জটিলতা এবং ব্যবসায়ী মহলের তৎপরতা
উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সরকারের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট নীতি সহায়তা না পাওয়া এবং সাংগঠনিক কাঠামোর দুর্বলতা।

সংগঠন ও দাবি উত্থাপন: ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)-এর কার্যকরী কমিটি নিয়ে সাংগঠনিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। ফলস্বরূপ, এই সাংগঠনিক শূন্যতার সময়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রভাবশালী বা সিনিয়র উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ী নেতারা একটি অনানুষ্ঠানিক প্রতিনিধি দলের মাধ্যমে সরকারের কাছে দ্রুত তৎপরতা দেখান। তারা সারাদেশে ই-কমার্স খাতে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুত আর্থিক প্যাকেজ প্রদানের দাবি জানান।

স্বচ্ছতার দাবি ও মূল লক্ষ্য: ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংগঠনটির অরাজনৈতিক ও স্বচ্ছ রূপান্তরের দাবি জোরদার হয়েছে। দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল যে, সংগঠনের মূল লক্ষ্য ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার চেয়ে অন্য দিকে ধাবিত হচ্ছিল। তাই, বর্তমান দাবিগুলোর মধ্যে ই-কমার্সকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা, আর্থিক চাপ কমাতে আগামী ১২ মাসের জন্য ব্যবসায়িক ঋণের সুদ মওকুফ এবং ট্রেড লাইসেন্স ক্যাটাগরিতে ‘অনলাইন ব্যবসা’ সুনির্দিষ্টভাবে সংযোজন করার দাবি প্রধান হয়ে ওঠেছে।

সরকারের ভূমিকা ও ভ্যাট-ট্যাক্স জটিলতার বিশ্লেষণ: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের সীমিত সময়ের কারণে ই-কমার্স বা এসএমই খাতের জন্য নতুন কোনও আইন বা দীর্ঘমেয়াদী নীতি প্রণয়ন করেনি। অন্যদিকে, অনলাইন ব্যবসায়ীদের বর্তমানে বেশিরভাগ পণ্য ও সেবার ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট (ক্ষেত্রবিশেষে ১৫ শতাংশ) এবং ট্যাক্সের চাপ বহন করতে হচ্ছে। সংকট মোকাবিলায় ভ্যাট-ট্যাক্সের স্লাব কমানোর দাবি থাকলেও, সরকার তাতে সাড়া দেয়নি, ফলস্বরূপ উদ্যোক্তাদের পুঁজির ওপর বাড়তি বোঝা সৃষ্টি করছে।

কর্মসংস্থান ও সুশাসন: মূল সংকট
এসএমই খাত দেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ শিল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং পুঁজির সংকটের কারণে এই খাতে নতুন নিয়োগ প্রায় বন্ধ। দেশের অর্থনীতি বিশ্লেষক মহল জোর দিয়ে বলেছেন, “শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এলেই অর্থনীতি চাঙ্গা হবে না। উচ্চ সুদহার ও ঋণ জালিয়াতির মতো কাঠামোগত দুর্নীতি যতক্ষণ না বন্ধ হবে, ততক্ষণ এসএমই খাতের জন্য সহজ অর্থায়ন নিশ্চিত করা অসম্ভব। নতুন সরকারের প্রধান কাজ হবে সুশাসনকে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি করা।”

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও চূড়ান্ত আহ্বান
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীদের মনোভাব সতর্কতামূলক। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক বা অন্যান্য সংস্থার পক্ষ থেকে বড় ধরনের নতুন ঋণ বা সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে সুশাসন ও কাঠামোগত সংস্কারের ওপর নতুন করে জোর দেয়া হচ্ছে।

পরিশেষে, নির্বাচিত সরকার যদি দুর্নীতি দমনে দৃঢ় পদক্ষেপ নেয় এবং উচ্চ সুদহার কমিয়ে এনে ই-কমার্স ও এসএমই উদ্যোক্তাদের হাতে নগদ অর্থের প্রবাহ নিশ্চিত করার মতো কার্যকর অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে আসে, তবেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *