অবৈধ মোবাইল ফোন বন্ধে এনইআইআর: নিরাপত্তা ও অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)-এর উদ্যোগে ‘ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টার’ (এনইআইআর) ব্যবস্থা প্রবর্তন দেশের সার্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সুরক্ষা এবং টেলিযোগাযোগ খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য এক অপরিহার্য পদক্ষেপ। অবৈধভাবে আমদানি করা এবং নকল মোবাইল ফোন নিয়ন্ত্রণ করাই এই ব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্য, যা সমাজে বহু স্তরের অপরাধমূলক কার্যক্রমের বিস্তার রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিটিআরসি নিশ্চিত করেছে যে, এই ব্যবস্থা কার্যকরভাবে চালু হতে যাচ্ছে আগামী ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ তারিখ থেকে।
অপরাধ দমন ও সামাজিক নিরাপত্তা
অবৈধ মোবাইল ফোন শুধু কর ফাঁকির বিষয় নয়, এটি বহুবিধ ডিজিটাল অপরাধের মূল কারণ। এনইআইআর কার্যকর হলে এই সংশ্লিষ্ট অপরাধগুলোতে কঠোরভাবে লাগাম টানা সম্ভব হবে-
সিম ও এমএফএস সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ: অবৈধ মোবাইল ফোনে নিবন্ধিত সিম বা ভুল এমএফএস রেজিস্ট্রেশন/eKYC এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিং সংক্রান্ত অপরাধ (যেমন- অর্থ পাচার, প্রতারণা) একটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৭৩ শতাংশ ডিজিটাল জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনা অবৈধ ডিভাইস এবং সিম কার্ডের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। এনইআইআর চালু হলে প্রতিটি মোবাইল ডিভাইসের জন্য ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি (IMEI) নিবন্ধিত থাকবে, ফলে এমএফএস খাতে জালিয়াতি বন্ধ হবে। এটি মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি, ব্যাংকিং খাত, বিএফআইইউ-এর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রমাগত অনুরোধের প্রেক্ষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
eKYC প্রক্রিয়া শক্তিশালীকরণ: প্রতিটি বৈধ মোবাইল ফোন আইএমইআই সিম-এর সঙ্গে যুক্ত থাকবে, যা eKYC সিস্টেমে সিমের ভুল রেজিস্ট্রেশন/eKYC এবং ভুয়া বা একাধিক নিবন্ধন অসম্ভব করে তুলবে। এতে আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা, বিশেষ করে মোবাইল ব্যাংকিং সেক্টরের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৭৩ শতাংশ ডিজিটাল জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনা অবৈধ ডিভাইস এবং সিম কার্ডের মাধ্যমে সংঘটিত হয়
চুরি ও স্ক্যামিং প্রতিরোধ (গ্রাহক সুরক্ষা): চুরি যাওয়া বা হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোনের আইএমইআই সহজেই ব্লক করে দেয়া যাবে। ফলে চোরেরা সেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আর সিম প্রতারণা, স্ক্যাম বা ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড জালিয়াতি করতে পারবে না, যা চুরি যাওয়া মোবা্ইল ফোন উদ্ধার, ছিনতাই ও মোবাইল চুরির ঘটনাকে নিরুৎসাহিত করবে এবং হারানো মোবাইল ফোন ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ হবে।
অনলাইন জুয়া ও অবৈধ ক্লোন ফোন সংক্রান্ত অপরাধ: অবৈধ ক্লোন ফোন সংক্রান্ত অপরাধ, অনলাইন জুয়া, স্ক্যামিং, জুয়ার লিংক এবং এমএলএম প্রতারণার বাল্ক এসএমএস পাঠানোর মতো ডিজিটাল অপরাধগুলো প্রায়শই অবৈধ ডিভাইস ব্যবহার করে করা হয়। এনইআইআর এই ধরনের অপরাধের উৎসকে চিহ্নিত করে বন্ধ করতে সাহায্য করবে। অর্থাৎ নাগরিক, সমাজ, অর্থনীতির ও রাষ্ট্রের বহু স্তরের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার নানাবিধ বিষয় জড়িত এখানে।
সরকার বছরে প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা থেকে ২,০০০ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব হারাচ্ছে
অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও রাজস্ব নিশ্চিতকরণ
অবৈধভাবে মোবাইল ফোন আমদানি দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক আঘাত হানে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনইআইআর মুখ্য ভূমিকা রাখবে-
রাজস্ব ক্ষতি হ্রাস ও শুল্ক ফাঁকি রোধ (অর্থনৈতিক তথ্য): দেশের ১৬ হাজার কোটি টাকার মোবাইল ফোনের বাজারের ৪০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশই অবৈধ মোবাইল ফোনের দখলে। এর ফলে সরকার বছরে প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা থেকে ২,০০০ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব হারাচ্ছে। এনইআইআর চালু হলে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত চোরাচালান, বিমানবন্দরের লাগেজ পার্টি, ভুয়া এইচএস কোড ব্যবহার এবং কেজি দরে মোবাইল আমদানির পথ সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ হবে, যা সরকারের কোষাগারে সঠিক রাজস্ব নিশ্চিত করবে এবং আয়কর ও শুল্ক ফাঁকি রোধ করবে। অবৈধভাবে আনা মোবাইল ফোন, বিশেষত ভারত ও চীন থেকে অবৈধ আনবক্সড মোবাইল ফোন আমদানি বন্ধ হবে।
দেশীয় শিল্পের বিকাশ (পরিসংখ্যানগত তথ্য): অবৈধ মোবাইল ফোনের দাপটে স্থানীয় উৎপাদকরা টিকে থাকতে না পেরে স্মার্ট ও ফিচার ফোন মিলিয়ে উৎপাদন প্রায় ৩০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে, যা এই খাতে প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ এবং ১ লাখ ৬০ হাজার কর্মসংস্থানকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। বিডা (BIDA) এর মতো সংস্থাগুলো এই শিল্পের বিকাশে আগ্রহী।
অবৈধভাবে আনা মোবাইল ফোন, বিশেষত ভারত ও চীন থেকে অবৈধ আনবক্সড মোবাইল ফোন আমদানি বন্ধ হবে
প্রযুক্তিগত শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা
টেলিযোগাযোগ খাতে নিরাপত্তা ও সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য এনইআইআর একটি কাঠামোগত ভিত্তি তৈরি করবে-
নকল/ক্লোন ফোন প্রতিরোধ (পরিসংখ্যানগত তথ্য): বর্তমানে একটি মাত্র আইএমইআই কোডের বিপরীতে দেড় লাখেরও বেশি ক্লোন বা নকল মোবাইল ফোন তৈরি করে দেশে প্রবেশ করানো হচ্ছে। এই চোর ও মাফিয়া চক্রের তৎপরতা বন্ধ করতে এনইআইআর ব্যবস্থা কার্যকর হলে অবৈধ ক্লোন করা মোবাইল ফোন শনাক্ত করা এবং নেটওয়ার্কে তাদের ব্যবহার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ করা সম্ভব হবে।
আন্তর্জাতিক রয়্যালটি নিশ্চিতকরণ: প্যাটেন্ট ও প্রযুক্তিগত বিভিন্ন রয়্যাল্টি না দেয়া মোবাইল ফোন আমদানি বন্ধ হবে, যা প্রযুক্তিগত সুশাসন নিশ্চিত করবে।
অবৈধ মোবাইল ফোন শুধু কর ফাঁকির বিষয় নয়, এটি বহুবিধ ডিজিটাল অপরাধের মূল কারণ
গ্রাহক স্বাচ্ছন্দ্য ও নিয়ন্ত্রক পদক্ষেপের সর্বশেষ আপডেট
গ্রাহক পর্যায়ে এনইআইআর ব্যবস্থা চালুতে যেন কোনও ভোগান্তি না হয়, সেদিকে নজর রেখেই বিটিআরসি কাজ করছে এবং ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ থেকে কার্যক্রম শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে-
স্বয়ংক্রিয় বৈধতা: ১৬ ডিসেম্বরের আগে বাংলাদেশের নেটওয়ার্কে ব্যবহৃত সকল মোবাইল ফোন (বৈধ বা অবৈধ যাই হোক) স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধিত হবে এবং তা নেটওয়ার্কে সচল থাকবে।
বৈধতা যাচাই প্রক্রিয়া: নতুন মোবাইল ফোন কেনার আগে গ্রাহকরা সহজেই সেটির বৈধতা যাচাই করতে পারবেন। মোবাইল ফোনটির আইএমইআই নম্বর ব্যবহার করে KYD (Know Your Device) প্রক্রিয়া বা এসএমএসের মাধ্যমে যাচাই করা সম্ভব হবে, যা অবৈধ মোবাইল ফোন ক্রয় করে প্রতারিত হওয়া থেকে গ্রাহকদের রক্ষা করবে।
রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজ করতে বিটিআরসি কাজ করছে
সহজ রেজিস্ট্রেশন ও এনবিআর ফি: প্রবাসীরা বাইরে থেকে নিয়ম মেনে একটি বা দুটি ফোন ফ্রি আনবেন, নিয়ম মেনে রেজিস্ট্রেশন করবেন। কোনও ঝামেলা হবে না। বর্তমানে, একজন সাধারণ যাত্রী বছরে একটি নতুন মোবাইল ফোন শুল্কমুক্তভাবে আনতে পারেন, তবে বিএমইটি কার্ডধারী প্রবাসীরা দুটি নতুন ফোন শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবেন। দুটির বেশি ফোনের ক্ষেত্রে এনবিআরের আলাদা নিয়ম রয়েছে, অর্থাৎ তৃতীয় বা অতিরিক্ত ফোনের ক্ষেত্রে এনবিআরের শুল্ক ও কর (একটি ফি) পরিশোধ করতে হয়, এটি পুরোনো নিয়ম। রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজ করতে বিটিআরসি কাজ করছে।
মূল্য কমানোর উদ্যোগ: বৈধ মোবাইলের মূল্য যাতে না বাড়ে, সেই লক্ষ্যে বিটিআরসি কাজ করছে। আমদানি শুল্ক কমাতে এনবিআরকে চিঠি দেয়া হয়েছে এবং এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে দ্রুতই আলোচনা করা হবে। পাশাপাশি দেশীয় উৎপাদকদেরকে বিটিআরসির পক্ষে মূল্য কমাতে মৌখিকভাবে অনুরোধও জানানো হয়েছে।
নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ: আপনার নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম যদি ক্লোন করা হয়নি, এমন বৈধ বা নিবন্ধিত ফোনে ব্যবহার করা হয় তবে কখনই ঝামেলায় পড়তে হবে না।
রেজিস্ট্রেশন/ডি-রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সরলীকরণ: গ্রাহকদের কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন, ডি-রেজিস্ট্রেশন এবং রি-রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি সমূহ কীভাবে আরও সহজ করা যায়, সে বিষয়ে যৌক্তিক পরামর্শ গ্রহণ করা হচ্ছে।
এনইআইআর ব্যবস্থা শুধু একটি প্রযুক্তিগত সমাধান নয়, এটি দেশের নাগরিক, সমাজ, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রের বহুস্তরের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার একটি সমন্বিত উদ্যোগ। চোরাচালানকারী ও মাফিয়া চক্রের প্রভাবকে মোকাবিলা করে ডিজিটাল শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য এই ব্যবস্থার বাস্তবায়ন একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজন। ক্লোন করা, অবৈধভাবে আমদানিকৃত ও চোরাচালানকৃত ফোন বন্ধ করতে হবে এবং এখানে কোনও ছাড় দেয়া সমুচিত হবে না।





