এনইআইআর: শৃঙ্খলার সুযোগ, নাকি শুল্কের ফাঁদ?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে পূর্ণাঙ্গ কার্যকর হতে যাওয়া ন্যাশনাল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্ট্রার (এনইআইআর)-এর সফলতা নির্ভর করছে জনমুখী নীতি, স্বচ্ছতা এবং শুল্ক কাঠামোর যৌক্তিকীকরণের ওপর। এনইআইআর ব্যবস্থাটি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)-এর একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ (সংশোধিত)-এর অধীনে কার্যকর হতে যাচ্ছে। এই উদ্যোগের প্রধান উদ্দেশ্য হলো অবৈধ মোবাইল ফোন বন্ধ করে বছরে আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি রোধ করা, দেশীয় শিল্পে ১ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান সুরক্ষা দেয়া এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
উদ্দেশ্য বনাম নীতিগত বিতর্ক
এনইআইআর-এর লক্ষ্য অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হলেও, এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় নীতিগত অস্বচ্ছতা নিয়ে গুরুতর বিতর্ক বিদ্যমান। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ এবং টেন্ডারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ঝুঁকি উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
বাজারের ভারসাম্যহীনতা ও গ্রাহক সুফল: এনইআইআর চালু হলে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে প্রিমিয়াম বাজারে। ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্কের কারণে আইফোন সহ অন্যান্য উচ্চমূল্যের মোবাইল ফোনের মূল্য হঠাৎ ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এই ঝুঁকি সত্ত্বেও, গ্রাহকরা পাবেন নিরাপদ, ওয়ারেন্টিযুক্ত এবং জালিয়াতিমুক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের নিশ্চয়তা।
উল্লেখ্য, বর্তমানে নেটওয়ার্কে সচল থাকা সমস্ত মোবাইল ফোন (বৈধ বা অবৈধ) ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধিত হয়ে যাবে, যা গ্রাহকদের একটি বড় অংশকে প্রাথমিক হয়রানি থেকে মুক্তি দেবে।দেশের সকল মোবাইল অপারেটরদেরকে কাস্টমার সাপোর্টকে প্রস্তুত রাখতে হবে।
বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ ও সামাজিক-রাজনৈতিক ঝুঁকি
এনইআইআর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো মূলত প্রযুক্তিগত নয়, বরং নীতিগত ও সামাজিক
গ্রাহক হয়রানি ও নিবন্ধন জটিলতা: বিদেশ থেকে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য আনা মোবাইল ফোনের নিবন্ধন প্রক্রিয়া যদি জটিল ও সময়সাপেক্ষ হয়, তবে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হবেন। এই পদক্ষেপ সরাসরি প্রবাসীদের স্বার্থের পরিপন্থী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, যা সরকারের জন্য তীব্র সামাজিক রাজনৈতিক অসন্তোষের কারণ হতে পারে।
বাজার অস্থিরতা: উচ্চ শুল্ক বজায় রেখে অবৈধ মোবাইল ফোন বন্ধ করলে সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন স্মার্টফোন পাওয়া কঠিন হবে, যা ডিজিটাল বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দেবে।
প্রযুক্তিগত ত্রুটি: স্বয়ংক্রিয় নিবন্ধনের সময় বিপুল ডেটার সিঙ্ক্রোনাইজেশন ত্রুটির কারণে ভুলবশত বৈধ ফোন ব্লক হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি করবে।
নীতির জন্য সাতটি জরুরি সুপারিশ
এনইআইআর-কে সফল, বিতর্কমুক্ত এবং জনবান্ধব করার জন্য নিম্নলিখিত সাতটি নীতিগত পদক্ষেপ নেয়া অপরিহার্য-
১. শুল্ক কাঠামো যৌক্তিকীকরণ (বাজারের ভারসাম্য): এনইআইআর কার্যকর হওয়ার পূর্বে, প্রিমিয়াম মোবাইল ফোনের ওপর অস্বাভাবিক আমদানি শুল্ক অবিলম্বে সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা হোক। এতে মূল্যবৃদ্ধির চাপ কমবে।
২. চুক্তি ও টেন্ডার স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ (জনগণের আস্থা): এনইআইআর চুক্তির বিস্তারিত শর্তাবলী প্রকাশ এবং দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করা হোক।
৩. বিদেশ থেকে আনা ফোনের প্রক্রিয়া সরলীকরণ (গ্রাহক মুক্তি): প্রবাসীদের জন্য মোবাইল ফোনের নিবন্ধন ও ডি-রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে মুক্ত করে সম্পূর্ণ ডিজিটাল ও দ্রুত করা হোক।
৪. মোবাইল অপারেটরদের প্রশিক্ষণ (সেবার মান): মোবাইল অপারেটরদের কর্মীদের এনইআইআর সংক্রান্ত আইনি ও প্রযুক্তিগত বিষয়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা হোক।
৫. স্থানীয় শিল্পের জন্য প্রণোদনা (বিনিয়োগ সুরক্ষা): দেশীয় অ্যাসেম্বলিং ও উৎপাদন শিল্পকে উৎসাহিত করতে নীতিগত সহায়তা ও প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত ঘোষণা করা হোক।
৬. বিশেষ পরামর্শ (ট্রানজিশনাল অ্যামনেস্টি): সামাজিক-রাজনৈতিক ঝুঁকি কমাতে, এনইআইআর কার্যকর হওয়ার পরেও, প্রথম ৬ মাস থেকে ১ বছরের জন্য বিদেশ থেকে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য আনা নতুন মোবাইল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে শুল্ক মওকুফের একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষণা করা উচিত।
৭. ভুলবশত ব্লক হওয়া ফোনের দ্রুত সমাধান: বিটিআরসিকে একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যাতে ভুল ডেটা সিঙ্ক্রোনাইজেশন বা অন্য ত্রুটির কারণে ব্লক হওয়া বৈধ মোবাইল ফোনগুলো ৭২ ঘণ্টার মধ্যে নেটওয়ার্কে সচল করা যায়।
এনইআইআর নিঃসন্দেহে একটি সম্ভাবনাময় নীতি, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। তবে এর সাফল্য নির্ভর করছে নীতি-নির্ধারকদের নিয়ন্ত্রণ ও রাজস্বের লক্ষ্যকে জনস্বার্থ এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে সমন্বয় করার ওপর। এই সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন এনইআইআর-কে একটি সফল, বিতর্ক-মুক্ত এবং জনগণের আস্থা অর্জনকারী নীতিতে পরিণত করবে।
লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব





