অন্যান্য মতামত

ভুয়া কল বন্ধে নতুন যুগ: সিএনএপি কি চালু করবে বিটিআরসি?

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): প্রতিদিন দেশের কোটি কোটি মোবাইল ব্যবহারকারী ভুয়া বা স্প্যাম কলের শিকার হচ্ছেন। একটি অচেনা রিংটোন মুহূর্তেই কারও কারও জীবনে ডেকে আনছে আর্থিক বিপর্যয়। এই প্রতারণামূলক মোবাইল ফোন জালিয়াতি এখন আর নিছক ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি জাতীয় অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে এবং ডিজিটাল লেনদেনের প্রতি জনগণের আস্থাকে তীব্রভাবে আঘাত করছে।

স্প্যাম কলের আর্থিক ও সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি
যদিও বাংলাদেশে ভুয়া কলের সংখ্যা ও আর্থিক ক্ষতির সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান অপ্রতুল, সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ভয়াবহতা চরম। আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুযায়ী, সাইবার জালিয়াতির কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর শত শত কোটি ডলার ক্ষতি হয়।

অপরাধী চক্রের ধরণ: এই প্রতারণায় মূল মনোযোগ দেয় সংগঠিত অপরাধী চক্র (যারা ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা সেজে ওটিপি হাতিয়ে নেয়), অবৈধ ভিওআইপি ব্যবহারকারী (যারা কল স্পুফিং করে) এবং অনিয়ন্ত্রিত টেলিমার্কেটিং সংস্থা। এই প্রতারণা দেশের ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা, বিশেষত মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) প্রতি জনগণের আস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

সিএনএপি (CNAP) পরিপূরক প্রযুক্তি এবং সুরক্ষার সমন্বয়
এই সংকট মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে কলিং নেম প্রেজেন্টেশন (সিএনএপি) সহ একাধিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। সিএনএপি এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে কলারের নম্বর নয়, বরং তার কেওয়াইসি (KYC) যাচাইকৃত বৈধ নাম রিসিভারের স্ক্রিনে প্রদর্শিত হয়।

কার্যকারিতা: সিএনএপি সরাসরি নেটওয়ার্ক স্তরে কাজ করে এবং সরকার অনুমোদিত আইডি দ্বারা নিবন্ধিত তথ্য ব্যবহার করে। ফলস্বরূপ, স্পুফিং করেও প্রতারক তার আসল পরিচয় লুকাতে পারে না। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত এই সেবা বাধ্যতামূলক করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

সিএনএপি-এর পরিপূরক প্রযুক্তি
STIR/SHAKEN ফ্রেমওয়ার্ক: এটি মূলত কলার আইডি স্পুফিং মোকাবিলায় ব্যবহৃত একটি ডিজিটাল সার্টিফিকেট ফ্রেমওয়ার্ক। এটি নিশ্চিত করে কলটি বৈধ উৎস থেকে আসছে।
এআই এবং মেশিন লার্নিং: মোবাইল অপারেটররা এআই মডেল ব্যবহার করে কল ট্র্যাফিকের অস্বাভাবিক প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে দ্রুতগতিতে স্প্যাম বা রোবোকল ট্র্যাফিক ব্লক করতে পারে।

বিটিআরসি’র প্রতি আবেদন ও সরকারের কৌশলগত সুপারিশসমূহ
নাগরিকদের অর্থ ও আস্থার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিটিআরসিকে অবিলম্বে সিএনএপি চালুর জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। এর পাশাপাশি, প্রতারণা মোকাবিলায় নিম্নলিখিত বহুমাত্রিক কৌশলগত সুপারিশসমূহ গ্রহণ করা সমুচিত হবে-

নীতিগত কাঠামোর সংস্কার ও কঠোরতা
সিএনএপি বাধ্যতামূলক প্রবর্তন: সিএনএপি-কে সকল গ্রাহকের জন্য ডিফল্ট এবং বিনামূল্যে নিরাপত্তা পরিষেবা হিসেবে চালু করতে হবে।
জরিমানা বৃদ্ধি ও আইনি কঠোরতা: স্পুফিং এবং প্রতারণামূলক কলের বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে কঠোর জরিমানার বিধান যুক্ত করতে হবে।
জাতীয় স্প্যাম রেজিস্ট্রি: প্রতারণামূলক কল রিপোর্ট করার জন্য একটি ‘কেন্দ্রীয় জাতীয় গ্রাহক অভিযোগ ও প্রতিরোধ রেজিস্ট্রি’ (এনসিপিআর) তৈরি করতে হবে।

প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান ও সহযোগিতা
দ্রুত কল ট্রেসিং সক্ষমতা: প্রতারণার রিপোর্ট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীর অবস্থান ও জিও-লোকেশন দ্রুত শনাক্ত করার জন্য অপারেটর ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে একটি উন্নত এবং দ্রুত ‘কল ট্রেসিং’ প্রোটোকল স্থাপন করা অত্যাবশ্যক।
STIR/SHAKEN বিবেচনা: স্পুফিং পুরোপুরি নির্মূল করতে এই আধুনিক ফ্রেমওয়ার্কগুলো ধীরে ধীরে চালু করার রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক ফিল্টারিং: বিটিআরসি একটি কেন্দ্রীয় এআই প্ল্যাটফর্ম চালু করতে পারে, যা রিয়েল-টাইমে স্প্যাম নম্বর ব্লক করার নির্দেশ দেবে।
সিম নিবন্ধনের কঠোর নিরীক্ষা: অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত সিমগুলোর ওপর নিয়মিত কঠোর নিরীক্ষা জরুরি।

সাংগঠনিক বাস্তবায়ন এবং জ্ঞান বিনিময়
পাইলট প্রজেক্ট এবং পর্যায়ক্রমিক রোলআউট: সিএনএপি-এর মতো বড় পরিবর্তন একবারে চালু না করে প্রথমে একটি ‘পাইলট প্রজেক্ট’ হিসেবে শুরু করা যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব: বিটিআরসি ভারত বা অন্যান্য দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলে প্রযুক্তিগত জ্ঞান বিনিময় করতে পারে।

নাগরিক অধিকার, ক্ষতিপূরণ এবং দ্রুত আইনি প্রতিকার
ক্ষতিপূরণ ফান্ড প্রতিষ্ঠা: সরকার একটি ‘সাইবার প্রতারণা ক্ষতিপূরণ ফান্ড’ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। নিয়ন্ত্রক ব্যর্থতার কারণে প্রতারিত গ্রাহককে এই ফান্ড থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রক্রিয়া চালু করা যেতে পারে।
ফাস্ট-ট্র্যাক ট্রাইব্যুনাল: সাইবার প্রতারণা সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ফাস্ট-ট্র্যাক ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা যেতে পারে।
ডেটা সার্বভৌমত্ব ও নিয়ন্ত্রণ: গ্রাহকদের তাদের ব্যক্তিগত ডেটা ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ দিতে হবে।

জনসচেতনতা সৃষ্টিতে জাতীয় কর্মসূচি
সার্বজনীন প্রচার: ‘ওটিপি নয়, আপনার পিন আপনার টাকা’- এই ধরনের সহজ বার্তা নিয়মিত প্রচার করতে হবে।
প্রতারিত হলে করণীয়: প্রতারণার শিকার হলে তাৎক্ষণিক ব্যাংক বা এমএফএস সেবাদাতাকে (যেমন বিকাশ/নগদ/রকেট) অবহিত করে লেনদেন স্থগিত করার অনুরোধ জানান। বিটিআরসি এবং সাইবার ক্রাইম বিভাগ বা নিকটস্থ থানাতে অভিযোগ করুন।

ডিজিটাল রুপান্তরের পথে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রাথমিক শর্ত। সিএনএপি এবং এর পরিপূরক প্রযুক্তিগুলো কেবল একটি প্রযুক্তিগত সমাধান নয়, এটি জনগণের আস্থার প্রতীক। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অবশ্যই মোবাইল অপারেটরদের বাণিজ্যিক সুবিধা-অসুবিধা ছাপিয়ে নাগরিকের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা এই বৃহত্তর স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *