চীনের হাত ধরে বাংলাদেশের ডিজিটাল বিপ্লব
ভূঁইয়া মোহাম্মদ ইমরাদ (তুষার): চীনের প্রযুক্তি এখন বিশ্বজুড়ে এক অবিস্মরণীয় শক্তি। টেলিকম, স্মার্টফোন, এআই ও অবকাঠামো সব ক্ষেত্রেই চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশও এই প্রভাবের বাইরে নয়। বরং দেশের প্রযুক্তি ও টেলিকম খাতের দ্রুত বিকাশের পেছনে রয়েছে চীনা বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহায়তার বড় ভূমিকা, এর সঙ্গে বাড়ছে নির্ভরতা।
বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তি ও টেলিকম খাতের মানচিত্রে এখন এক নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, চীনের দৃঢ় উপস্থিতি ও ক্রমবর্ধমান প্রভাব। একসময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো প্রযুক্তি উন্নয়ন ও বাজার দখলে নেতৃত্ব দিতো, এখন সেখানে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্মার্টফোন, নেটওয়ার্ক অবকাঠামো, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) থেকে শুরু করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) পর্যন্ত প্রায় সব প্রযুক্তি খাতেই চীন আজ এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি। এই বৈশ্বিক প্রবণতার স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায় বাংলাদেশেও।
বাংলাদেশে চীনা প্রযুক্তির প্রসার
বাংলাদেশে প্রযুক্তি খাতের অবকাঠামো নির্মাণে চীনের ভূমিকা শুরু হয় প্রায় দুই দশক আগে। বিশেষ করে টেলিকম খাতে হুয়াওয়ে ও জেডটিই দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপনা ও সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও টেলিটক এর নেটওয়ার্ক সেবার বড় অংশই চীনা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশে ফোরজি নেটওয়ার্ক বাস্তবায়নের পেছনে যেমন ছিল হুয়াওয়ে ও জেডটিইর হাত, তেমনি ফাইভজি পরীক্ষামূলক নেটওয়ার্ক চালুর সময়ও চীনা প্রযুক্তিই নেতৃত্ব দেয়। টেলিটক বাংলাদেশে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি সেবা চালু করে ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর। যেখানে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয় হুয়াওয়ে। এই সহযোগিতা শুধু টেলিকম সেক্টরেই নয়, বরং সরকারি প্রকল্প, স্মার্ট সিটি ও ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নেও বিস্তৃত হচ্ছে।
স্মার্টফোন বাজারে চীনের রাজত্ব
বাংলাদেশের স্মার্টফোন বাজারেও চীনা ব্র্যান্ডের দাপট দিন দিন বাড়ছে। অপো, টেকনো, রিয়েলমি, ভিভো, শাওমি এখন দেশের মধ্যবিত্ত ও তরুণ প্রজন্মের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। সাশ্রয়ী মূল্য, আকর্ষণীয় ডিজাইন, ভালো মানের ক্যামেরা ও দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি এই চার বৈশিষ্ট্য চীনা ব্র্যান্ডগুলোকে জনপ্রিয় করেছে।
বাংলাদেশে উৎপাদন কারখানা স্থাপনের মাধ্যমেও তারা তাদের প্রভাব আরও গভীর করেছে। স্থানীয়ভাবে স্মার্টফোন অ্যাসেম্বল করার ফলে পণ্যের মূল্য কমেছে, কর্মসংস্থান বেড়েছে এবং সরকার রাজস্ব আদায়েও লাভবান হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া দেশের প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করছে।
প্রযুক্তি নির্ভর অবকাঠামো ও বিনিয়োগ
চীন শুধু পণ্য বিক্রি করছে না; তারা বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত অবকাঠামোতেও বিনিয়োগ করছে। “ডিজিটাল রুপান্তর” বাস্তবায়নে হুয়াওয়ে ও চায়না টেলিকমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে। ন্যাশনাল ডেটা সেন্টার, স্মার্ট গভর্নমেন্ট নেটওয়ার্ক ও নিরাপত্তা অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে।
এ ছাড়া, চীন বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিও পরিচালনা করছে। হুয়াওয়ের “সিডস ফর দ্য ফিউচার” প্রোগ্রাম তরুণদের আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে স্থানীয় দক্ষ জনবল তৈরিতে সহায়ক হচ্ছে।
বাংলাদেশের জন্য সুযোগ ও কৌশল
চীনের সঙ্গে প্রযুক্তিগত সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য একদিকে উন্নয়নের সুযোগ, অন্যদিকে কৌশলগত চ্যালেঞ্জ। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত চীনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশীয় দক্ষতা ও উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। বাংলাদেশ যদি স্থানীয় প্রযুক্তি শিল্পকে উৎসাহ দেয়, গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়ায় এবং সাইবার নিরাপত্তা নীতিমালা আরও শক্তিশালী করে, তবে চীনা প্রযুক্তি আমাদের উন্নয়নের অংশীদার হতে পারে, আধিপত্যের প্রতীক নয়।
চীন আজ প্রযুক্তি ও টেলিকম দুনিয়ার এক অগ্রণী শক্তি এবং বাংলাদেশও তার প্রভাব থেকে আলাদা নয়। তবে এই প্রভাবকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে ব্যবহার করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। প্রযুক্তিগত সহযোগিতা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই প্রয়োজন স্বনির্ভরতার দিকে অগ্রসর হওয়া। বাংলাদেশ যদি ভবিষ্যতের “স্মার্ট নেশন” হিসেবে এগিয়ে যেতে চায়, তবে তাকে চীনের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজস্ব উদ্ভাবন ও নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সহযোগিতা থাকবে, কিন্তু নির্ভরতা নয়।
ছবি কৃতজ্ঞতায়: চ্যাটজিপিটি





