অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক: ‘ফাইবার ব্যাংক’ উদ্যোগ কতটা সম্ভাবনাময়

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ভিত্তি হলো শক্তিশালী যোগাযোগ অবকাঠামো। বর্তমান বিশ্বে উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ প্রতিটি দেশের প্রবৃদ্ধি ও উদ্ভাবনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কের অব্যবহৃত ক্ষমতাকে কার্যকরভাবে ব্যবহারের জন্য একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ‘ফাইবার ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা। এটি কেবল একটি নতুন বাণিজ্যিক ধারণা নয়, বরং সরকারি সংস্থাগুলোর হাতে থাকা হাজার হাজার কোটি টাকার অব্যবহৃত জাতীয় সম্পদকে সচল করার একটি দূরদর্শী কৌশল।
প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব এর তত্ত্বাবধানে এই সফট কনসোর্টিয়ামটি একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবে, যেখানে বেসরকারি খাতের অপারেটররা প্রয়োজন অনুযায়ী এবং প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে ফাইবার ব্যবহার করতে পারবে। এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো সম্পদের অপচয় রোধ করে দেশের প্রতিটি প্রান্তে উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়া, যা একই সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং ডিজিটাল বৈষম্য হ্রাসের পথ খুলে দেবে।
অব্যবহৃত অপটিক্যাল ফাইবার
বাংলাদেশে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কের অব্যবহৃত ক্ষমতা কাজে লাগানোর জন্য একটি নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ‘ফাইবার ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা। এই উদ্যোগটি মূলত একটি সফট কনসোর্টিয়াম হিসেবে কাজ করবে। এর লক্ষ্য হলো, সরকারি সংস্থাগুলোর হাতে থাকা হাজার হাজার কিলোমিটার অব্যবহৃত ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ককে একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্মে এনে তা বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া। এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য বহুমুখী- একদিকে জাতীয় সম্পদের অপচয় রোধ করা, অন্যদিকে দেশের ডিজিটাল সংযোগকে আরও শক্তিশালী করা। সরকারের এই উদ্যোগটি দেশের টেলিকম অবকাঠামো এবং ডিজিটাল অর্থনীতিতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতি এবং অব্যবহৃত সম্পদ
বর্তমানে বাংলাদেশের চারটি সরকারি সংস্থা- বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল), বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল (বিসিসি), পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে সম্মিলিতভাবে প্রায় ৭৮,৪০০ কিলোমিটার ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছে। এর মধ্যে একটি বিশাল অংশ, যা প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত, এখনও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এটি কেবল একটি সংখ্যা নয়, এটি হাজার হাজার কোটি টাকার একটি জাতীয় সম্পদের অপচয়।
বিটিসিএল: তাদের রয়েছে ৩৯,৫০০ কিলোমিটার ফাইবার, যার প্রায় ৯০% মাটির নিচে রয়েছে। এর মধ্যে ১২ কিলোমিটারের মতো ন্যাশনওয়াইড ফাইবার ফাঁকা পড়ে আছে।
বিসিসি: তাদের রয়েছে ২৭,৬৯৫ কিলোমিটার ফাইবার, যা দেশের ২,৬০০ ইউনিয়নে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৪৮ কোরের মধ্যে মাত্র ২ কোর ব্যবহার করছে বেসরকারি অপারেটররা, অর্থাৎ ৪৬ কোর অব্যবহৃত।
পিজিসিবি: তাদের প্রায় ৮,০০০ কিলোমিটার ফাইবার আছে, যা বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের সঙ্গে যুক্ত। এর অধিকাংশই ব্যবহার করা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ রেলওয়ে: তাদের ৩,২০৫ কিলোমিটার নেটওয়ার্কের বেশিরভাগই ব্যবহার হচ্ছে না।
এই অব্যবহৃত ফাইবারগুলো ১২ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ‘লাইটআপ’ না হলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এটি দেশের জন্য একটি মারাত্মক ক্ষতি, যা আগামী ১০ বছরে হাজার কোটি টাকার ক্ষতির কারণ হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, ‘ফাইবার ব্যাংক’ উদ্যোগটি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
‘ফাইবার ব্যাংক’ কী এবং কীভাবে কাজ করবে
‘ফাইবার ব্যাংক’ হবে একটি সফট কনসোর্টিয়াম, যেখানে ফাইবার নেটওয়ার্কের মালিকানা চারটি সরকারি সংস্থার হাতেই থাকবে। এটি একটি কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে, যা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী সবচেয়ে কাছের এবং কার্যকর ফাইবারটি খুঁজে বের করে সংযোগ দেবে। এই প্রক্রিয়ায় কোনও স্থান বা দূরত্বের বৈষম্য থাকবে না। গ্রাহক ফাইবার ব্যবহারের জন্য একটি নির্দিষ্ট মূল্য পরিশোধ করবে এবং সেই রাজস্ব ফাইবার মালিক (যেমন- বিটিসিএল, বিসিসি, পিজিসিবি, রেলওয়ে), বিটিআরসি এবং রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। এর ফলে একটি ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি তৈরি হবে, যেখানে সবারই লাভ নিশ্চিত হবে। এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য হলো, ‘প্রাইস এবং ডিস্ট্যান্স কম্পিটিশন’কে উৎসাহিত করা। গ্রাহক তার প্রয়োজন অনুযায়ী সবচেয়ে সাশ্রয়ী এবং কার্যকর ফাইবারটি বেছে নিতে পারবে। এতে বাজার আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে এবং সেবার মান উন্নত হবে।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং সুফল
‘ফাইবার ব্যাংক’ উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একাধিক ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
আয় বৃদ্ধি: অব্যবহৃত ফাইবার লিজের মাধ্যমে প্রতি বছর ৫০০ কোটি টাকার বেশি আয় হতে পারে। এই আয় সরকারি সংস্থাগুলোর রাজস্ব বাড়াবে এবং নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করবে।
যৌথ রক্ষণাবেক্ষণ: বিটিসিএলের নেতৃত্বে যৌথ রক্ষণাবেক্ষণের খরচ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।
খরচ হ্রাস: বেসরকারি নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক ( এনটিটিএন) অপারেটরদের ব্যান্ডউইডথের খরচ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। এতে ইন্টারনেট সেবার মূল্য হ্রাস পাবে, যা সরাসরি গ্রাহকদের উপকৃত করবে।
প্রযুক্তিগত অগ্রগতি: এই উদ্যোগ দেশের সব মোবাইল টাওয়ারকে ফাইবার সংযোগের আওতায় আনবে। বর্তমানে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মোবাইল টাওয়ার এখনও ফাইবারাইজেশনের বাইরে। ফাইবার সংযোগের মাধ্যমে কম খরচে এবং দ্রুত ফাইভজি রোলআউট সম্ভব হবে।
ডিজিটাল বিভাজন হ্রাস: দেশের ৯৮ শতাংশ ঘরবাড়ি এখনও ফাইবারাইজেশনের বাইরে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে ১ জিবিপিএস বা তার বেশি গতির ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে, যা ডিজিটাল বিভাজন হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
চ্যালেঞ্জ এবং সামনের পথ
ফাইবার ব্যাংক উদ্যোগটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হলেও, এর সফল বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে-
সমন্বয়: চারটি ভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিটি সংস্থার নিজস্ব কর্মপ্রক্রিয়া, নীতিমালা এবং প্রশাসনিক কাঠামো রয়েছে।
প্রযুক্তিগত অবকাঠামো: ফাইবার ব্যাংকের জন্য একটি শক্তিশালী সফটওয়্যার ও ডেটা অ্যানালাইসিস সিস্টেম তৈরি করতে হবে, যা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী সবচেয়ে কাছের এবং কার্যকর ফাইবারটি সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারে।
মূল্য নির্ধারণ: একটি ন্যায্য এবং প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া তৈরি করা জরুরি, যাতে কোনও বৈষম্য না হয়।
রক্ষণাবেক্ষণ: অব্যবহৃত ফাইবারগুলো দীর্ঘদিন ফেলে রাখায় তার গুণগত মান কমে যেতে পারে। নিয়মিত এবং দক্ষ রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা আবশ্যক।
আইনি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো: এই নতুন মডেলের জন্য একটি সুস্পষ্ট আইনি এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামো প্রয়োজন, যা সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করবে।
বিশ্লেষণ ও অতিরিক্ত মন্তব্য
যদিও এই উদ্যোগটি সরকারি সম্পদ ব্যবহারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, এর বাস্তবায়ন এবং দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতা নিয়ে কিছু বিষয় উল্লেখ করা জরুরি-
সরকারি নিয়ম নীতি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা: ফাইবার ব্যাংক পরিচালনার জন্য নতুন নীতিমালার প্রয়োজন হতে পারে। বিটিআরসি-র মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে একটি স্পষ্ট, নিরপেক্ষ এবং প্রতিযোগিতামূলক কাঠামো তৈরি করতে হবে, যা বেসরকারি অপারেটরদের স্বার্থ রক্ষা করবে এবং কোনও একটি সংস্থার একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি হতে দেবে না। এটি বিদ্যমান টেলিকম লাইসেন্সিং এবং শুল্ক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও বিনিয়োগ: আন্তর্জাতিক টেলিকম নীতিমালা, বিশেষ করে ডেটা সুরক্ষা এবং আন্তঃসীমান্ত সংযোগের বিষয়ে, এই উদ্যোগের ওপর প্রভাব ফেলবে। বিদেশি বিনিয়োগ বা অংশীদারিত্বের জন্য আন্তর্জাতিক নীতিমালার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটি কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন।
বেসরকারি খাতের ভূমিকা: এই উদ্যোগের সফলতা বহুলাংশে নির্ভর করবে বেসরকারি টেলিকম অপারেটর (এনটিটিএন) এবং আইএসপিগুলোর অংশগ্রহণের ওপর। ফাইবার ব্যাংক তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করলেও, তাদের নিজস্ব বিনিয়োগ এবং ব্যবসার মডেলের ওপর এর প্রভাব কী হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। একটি ভারসাম্যপূর্ণ কাঠামো না হলে, এটি বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।
সাইবার নিরাপত্তা: একটি সমন্বিত জাতীয় নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ফাইবার ব্যাংকের মাধ্যমে ডেটা আদান-প্রদান সুরক্ষিত রাখতে শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তা কাঠামো এবং নিয়মিত নিরীক্ষণ ব্যবস্থা অপরিহার্য। যেকোনও ধরনের সাইবার হামলা বা ডেটা লঙ্ঘনের ঘটনা পুরো উদ্যোগের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করতে পারে।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন: চারটি ভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন একটি বিশাল প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ। এই উদ্যোগের দ্রুত সফলতার জন্য একটি শক্তিশালী এবং স্বায়ত্তশাসিত পরিচালনা পর্ষদ প্রয়োজন, যা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়িয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
মূল্য নির্ধারণের স্বচ্ছতা: ‘ প্রাইস এবং ডিসট্যান্স কম্পিটিশন’ এর কথা বলা হলেও, এই মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতি কীভাবে কাজ করবে তা সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হওয়া প্রয়োজন। এটি একটি স্বচ্ছ এবং উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন না হলে, বৈষম্য বা অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে।

ফাইবার ব্যাংক এর অর্থনৈতিক ও কারিগরি চ্যালেঞ্জ, আইনি কাঠামো এবং পরিবেশগত প্রভাব
ফাইবার ব্যাংক উদ্যোগের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক মডেল নিয়ে আরও গভীরে প্রবেশ করা আবশ্যক। ভাড়ার কাঠামো কেবল ‘কম মূল্য’র মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রতি কিলোমিটার বা ব্যান্ডউইডথ ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা যেতে পারে, যা বিভিন্ন সরকারি সংস্থার ফাইবারের জন্য ভিন্ন হতে পারে। একটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেল হিসেবে এটিকে দাঁড় করানো সম্ভব, যেখানে সরকার অবকাঠামো সরবরাহ করবে এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এর বাণিজ্যিকীকরণ ও পরিচালনায় সহায়তা করবে।
কারিগরি দিক থেকে, চারটি ভিন্ন সংস্থার ফাইবার নেটওয়ার্কের মান ও প্রযুক্তির ভিন্নতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই ভিন্নতাকে একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্মে আনা এবং লাস্ট মাইল সংযোগ নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর কারিগরি সমাধান জরুরি। আইনি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর ক্ষেত্রে, বিদ্যমান লাইসেন্সিং নীতিমালার সঙ্গে ফাইবার ব্যাংকের সম্পর্ক কী হবে, তা পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন। যদি ভবিষ্যতে কোনও বিরোধ দেখা দেয়, তার জন্য একটি সুস্পষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা থাকা জরুরি। পরিবেশগত দিকটিও বিবেচনা করা উচিত। ফাইবার স্থাপনের সময় এবং পরে এর রক্ষণাবেক্ষণে পরিবেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, যেমন: মাটির নিচে কেবল স্থাপনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, তা নিয়ে আলোচনা প্রতিবেদনটিকে আরও সার্বিক করে তুলবে।
সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য এবং প্রত্যাশা
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, “একটি ফাইবার যদি ১২ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে লাইটআপ না হয়, তাহলে এখানে পুরোপুরি সম্ভাবনা রয়েছে যে তা নষ্ট হয়ে যাবে। এখানে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে এই ফাইবার নেটওয়ার্ক করা হয়েছিল। এগুলো অব্যবহৃত থাকলে দেশের একটি মারাত্মক ক্ষতি আমি দেখছি আগামী ১০ বছরে এবং এটি হাজার কোটি টাকার ক্ষতি। এখন বিসিসি যদি নতুন কনসোর্সিয়াম ফাইবার ব্যাংক এর মাধ্যমে ভাড়া দেয়, সেখানে বিসিসি একটি রেভিনিউ পাবে, বিটিআরসি পাবে এবং একইসঙ্গে ফাইবারগুলো যে অ্যানুয়াল মেইন্টেন্যান্স করছে তারাও একটা রেভিনিউ পাবে। সুতরাং এখানে আমি একটা উইন-উইন সিচুয়েশন দেখছি। কোনো বৈষম্য হবে না। ফাইবার নেটওয়ার্ক একটি অমূল্য সম্পদ। অব্যবহৃত সম্পদ হিসেবে এই ফাইবার নেটওয়ার্কটি অমূল্য সম্পদ। যেখানে দেশের ৮০ শতাংশ মোবাইল টাওয়ার এখনও ফাইবারাইজেশনের বাইরে, যেখানে দেশের ৯৮ শতাংশ ঘরবাড়ি এখনও ফাইবারাইজেশনের বাইরে সেখানে এই অমূল্য সম্পদ নিয়ে বসে আছি।”
সাম্প্রতিক অগ্রগতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
‘ফাইবার ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি বর্তমানে বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সম্প্রতি, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চারটি প্রতিষ্ঠান- বিটিসিএল, বিসিসি, পিজিসিবি এবং বাংলাদেশ রেলওয়েকে একটি কনসোর্টিয়াম গঠনের জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর মাধ্যমে এই উদ্যোগটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে শুরু করেছে।
এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে, বিটিসিএল-এর নেতৃত্বে ১,০৫৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো বিটিসিএল-এর অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ককে আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণ করা, যা উপজেলা পর্যায়ে ১০০ জিবিপিএস পর্যন্ত ডেটা ট্রান্সমিশন গতি সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। এটি ফাইবার ব্যাংক এর জন্য একটি শক্তিশালী অবকাঠামোগত ভিত্তি তৈরি করবে।
গ্রাহক উপকারিতা এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতা
‘ফাইবার ব্যাংক’ উদ্যোগের ফলে গ্রাহকরা সরাসরি উপকৃত হবে। কম খরচে এবং দ্রুত গতির ইন্টারনেট সংযোগের কারণে ডিজিটাল শিক্ষা, টেলিকমেডিসিন এবং ই-কমার্স এর মতো সেবাগুলো আরও সহজে মানুষের কাছে পৌঁছাবে। এটি জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে এবং নতুন ডিজিটাল সেবা খাতগুলোকে উৎসাহিত করবে।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, এই উদ্যোগটি দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে সরাসরি অবদান রাখতে পারে। এটি কেবল সরকারি সংস্থার জন্য রাজস্ব তৈরি করবে না, বরং নতুন ডিজিটাল উদ্যোগ এবং স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকেও শক্তিশালী করবে। এর ফলে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও ত্বরান্বিত হবে।
বৈশ্বিক মডেল এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সম্ভাবনা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ফাইবার অবকাঠামো ভাগাভাগির মডেল সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সুইডেনের ‘সেন্ট্রাল ফাইবার’ মডেল যেখানে স্থানীয় সরকার বা বেসরকারি সংস্থা নেটওয়ার্ক স্থাপন করে এবং বিভিন্ন আইএসপিকে তা ব্যবহারের সুযোগ দেয়। এই মডেলটি বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করে।
নিউজিল্যান্ডের ‘আল্ট্রা-ফাস্ট ব্রডব্যান্ড’ প্রকল্প, যেখানে সরকার এবং বেসরকারি খাতের যৌথ বিনিয়োগে একটি জাতীয় ফাইবার নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়, তা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে। এই মডেলগুলো থেকে বাংলাদেশ শিখতে পারে কীভাবে একটি বৃহৎ পরিসরের সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে একটি জাতীয় নেটওয়ার্ক স্থাপন ও পরিচালনা করা যায়।
‘ফাইবার ব্যাংক’ যদি দেশের অব্যবহৃত ফাইবার নেটওয়ার্কগুলোকে আন্তর্জাতিক গেটওয়ে এবং সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশনগুলোর সঙ্গে যুক্ত করতে পারে, তবে তা প্রতিবেশী দেশগুলোতে ব্যান্ডউইডথ রপ্তানির নতুন সুযোগ তৈরি করবে। এর মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় বৃদ্ধি পাবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।
‘ফাইবার ব্যাংক’ উদ্যোগটি শুধু একটি বাণিজ্যিক পরিকল্পনা নয়, বরং বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরের একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। দেশের হাজার হাজার কিলোমিটার অব্যবহৃত ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, ডিজিটাল বিভাজন হ্রাস এবং উন্নত টেলিকম সেবা নিশ্চিত করার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তা অনস্বীকার্য। এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রতি বছর ৫০০ কোটি টাকার বেশি আয় এবং বেসরকারি অপারেটরদের ব্যান্ডউইডথের খরচ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা দেশের ডিজিটাল ইকোসিস্টেমকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
তবে, এর সফলতার জন্য প্রয়োজন কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। সরকারি নিয়ম নীতি এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ আইনি কাঠামো তৈরি করা জরুরি। চারটি ভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন, সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা রক্ষা করা এই উদ্যোগের মূল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে যদি একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক এবং প্রযুক্তিগত কাঠামো গড়ে তোলা যায়, তাহলে ফাইবার ব্যাংক কেবল একটি অর্থনৈতিক মডেল হয়ে থাকবে না, এটি দেশের ডিজিটাল রুপান্তর রূপরেখা বাস্তবায়নে একটি দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করবে। এই ফাইবার ব্যাংক, যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে এটি অব্যবহৃত জাতীয় সম্পদকে গতিশীল করে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।
লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব