প্রতিবেদন

ক্যাশলেস বাংলাদেশ কি শুধুই স্বপ্ন? চ্যালেঞ্জ ও সমাধানের খোঁজ

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): একুশ শতকের এই আধুনিক বিশ্বে ডিজিটাল বিপ্লব আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে স্পর্শ করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অগ্রগতির এই যুগে, নগদ অর্থের ব্যবহার সীমিত করে একটি নগদহীন (ক্যাশলেস) সমাজ গড়ার ধারণাটি বিশ্বজুড়ে ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে। উন্নত দেশগুলো অনেক আগেই এই পথে হেঁটেছে এবং এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোও এই প্রক্রিয়ায় শামিল হচ্ছে। বাংলাদেশও এই যাত্রার ব্যতিক্রম নয়।

‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের লক্ষ্যে নগদহীন লেনদেনকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, উন্নত দেশগুলোর মতো কেন আমরা এখনও এই ব্যবস্থাকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারছি না? এই নিবন্ধে আমরা ক্যাশলেস সমাজ বলতে কী বোঝায়, এর বৈশ্বিক চিত্র, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

ক্যাশলেস কী, এর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
ক্যাশলেস বা নগদহীন বলতে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝানো হয় যেখানে কোনও ধরনের নগদ টাকা বা মুদ্রার সরাসরি ব্যবহার ছাড়াই সকল আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন হয়। এই লেনদেনগুলো সাধারণত ইলেকট্রনিক মাধ্যম, যেমন- ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম এবং বিভিন্ন ডিজিটাল ওয়ালেটের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ক্রেডিট কার্ডের প্রচলনের মাধ্যমে এই বিপ্লবের সূচনা হয়। এরপর ইন্টারনেটের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন ব্যাংকিং জনপ্রিয়তা লাভ করে। একুশ শতকে স্মার্টফোনের ব্যাপক ব্যবহার মোবাইল ব্যাংকিং এবং ডিজিটাল ওয়ালেটকে একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে আসে।

বর্তমানে বিশ্বের বহু দেশ প্রায় সম্পূর্ণ নগদহীন সমাজের দিকে এগিয়ে গেছে। সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড এবং ডেনমার্কের মতো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো এই ক্ষেত্রে অগ্রগামী। উদাহরণস্বরূপ, সুইডেনে প্রায় ৮০ শতাংশ লেনদেন ডিজিটাল মাধ্যমে হয় এবং অনেক দোকানে নগদ টাকা গ্রহণই করা হয় না। চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরের মতো এশিয়ার দেশগুলোতেও মোবাইল পেমেন্টের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

আন্তর্জাতিক মডেল: নিজস্ব পদ্ধতির কৌশল ও বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা
বিভিন্ন দেশ তাদের নিজস্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী নগদহীন লেনদেনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে, যা বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে।

সুইডেন ‘Swish’: সুইডেন কোনও একক সরকারি অ্যাপের পরিবর্তে ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগে তৈরি ‘Swish’ অ্যাপটিকে জনপ্রিয় করেছে। এই অ্যাপটি ব্যবহারকারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকে, যা লেনদেনকে সহজ এবং নিরাপদ করে তোলে।

চীন ‘Alipay’ ও ‘WeChat Pay’: চীন সরকার বা ব্যাংকের পরিবর্তে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর হাত ধরে নগদহীন লেনদেনে বিপ্লব এনেছে। ‘Alipay’ ও ‘WeChat Pay’-এর মতো অ্যাপগুলো শুধু পেমেন্টেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিল পরিশোধ, টিকিট বুকিং থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সব কাজে ব্যবহৃত হয়।

ভারত ‘UPI’: ভারত একটি সরকারি উদ্যোগ ‘UPI (Unified Payments Interface)’-এর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক এবং পেমেন্ট অ্যাপকে একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসেছে। এর মাধ্যমে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে বা এক অ্যাপ থেকে অন্য অ্যাপে সহজে টাকা পাঠানো যায় এবং ক্ষুদ্র লেনদেনের খরচ প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ
নগদহীন বাংলাদেশ গড়ার পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো হলো ডিজিটাল বিভাজন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং সামাজিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতা।
জনসংখ্যার পরিসংখ্যান: বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটির বেশি। এর মধ্যে প্রায় ১৮ কোটিরও বেশি মোবাইল সংযোগ রয়েছে, কিন্তু অনেকেরই একাধিক সিম কার্ড রয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৩ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছেন, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৭ থেকে ৮ কোটি মানুষ নিয়মিতভাবে স্মার্টফোন ব্যবহার করেন।

আর্থিক সেবার বাইরে থাকা জনগোষ্ঠী: বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এখনও আর্থিক সেবার বাইরে রয়েছেন। এরা সাধারণত নগদ লেনদেনের ওপর নির্ভরশীল এবং ডিজিটাল আর্থিক সেবার বাইরে থাকার প্রধান কারণগুলো হলো- স্মার্টফোন ব্যবহারের জ্ঞান ও আর্থিক সামর্থ্যের অভাব, ইন্টারনেট সংযোগের দুর্বলতা এবং আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থাহীনতা।

নীতিগত দুর্বলতা এবং সমাধানের পথ
নগদহীন সমাজের পথে সরকারের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বা ‘ক্যাশলেস বাংলাদেশ’ উদ্যোগের পাশাপাশি কিছু নীতিগত দুর্বলতা এখনও দৃশ্যমান। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব একটি বড় সমস্যা। লেনদেনের উচ্চ চার্জ এবং সুদের হার অনেক সময় গ্রাহকদের নিরুৎসাহিত করে।

সমাধানের উপায়: এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে ক্যাশলেস ব্যবস্থার আওতায় আনতে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন- প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট এবং বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করতে সরকারকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করে বয়স্কদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে ডিজিটাল আর্থিক সাক্ষরতা কার্যক্রম শুরু করতে হবে এবং লেনদেনের চার্জ সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসার জন্য রেগুলেটরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্যাশলেস লেনদেনের ব্যবহার
নগদহীন সমাজের পথে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলভাবে ক্যাশলেস পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করেছে।

বেতন ও সরকারি ভাতা: বর্তমানে পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন বেসরকারি খাতের শ্রমিকদের বেতন সরাসরি তাদের মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস অ্যাকাউন্টে দেয়া হচ্ছে। এই ব্যবস্থা ব্যবহারের ফলে নগদ অর্থ পরিবহনে নিরাপত্তা ঝুঁকি কমেছে এবং শ্রমিকদেরও সময় সাশ্রয় হচ্ছে। একটি আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, এর মাধ্যমে বছরে কয়েকশ কোটি টাকার নগদ অর্থ পরিবহনের খরচ সাশ্রয় হচ্ছে। একইভাবে, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, এবং প্রতিবন্ধী ভাতাসহ বিভিন্ন সরকারি অনুদান সরাসরি সুবিধাভোগীর অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়, যা লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছে।

শিক্ষা খাতে: অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টিউশন ফি, পরীক্ষার ফি এবং অন্যান্য চার্জ ডিজিটাল মাধ্যমে গ্রহণ করছে। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপবৃত্তিও সরাসরি শিক্ষার্থীদের মোবাইল অ্যাকাউন্টে দেয়া হচ্ছে, যা দুর্নীতির সুযোগ কমিয়েছে।

ভ্যাট ও ট্যাক্স প্রদান: জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এখন অনলাইনে ভ্যাট, ট্যাক্স এবং শুল্ক পরিশোধের ব্যবস্থা চালু করেছে। এর ফলে করদাতারা ঘরে বসেই সহজে তাদের কর পরিশোধ করতে পারছেন, যা রাজস্ব সংগ্রহে গতি এনেছে।

জমির খাজনা: বর্তমানে ভূমি উন্নয়ন কর বা জমির খাজনা অনলাইনে পরিশোধের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটি গ্রামীণ অর্থনীতিতে ডিজিটাল লেনদেনকে উৎসাহিত করছে।

অন্যান্য সেবা: বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং পানির বিল পরিশোধের জন্য ডিজিটাল পেমেন্ট একটি সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া- পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ট্রেনের টিকিট, বাসের টিকিট এবং সিনেমার টিকিট অনলাইনে কাটা যায়। রেস্তোরাঁ, শপিংমল এবং মুদি দোকানেও কিউআর কোড বা পিওএস মেশিনের মাধ্যমে ডিজিটাল পেমেন্ট গ্রহণ করা হচ্ছে।

ক্যাশলেস সোসাইটির বাস্তবতা: বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে একটি সম্পূর্ণ নগদহীন সমাজ রাতারাতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যার জন্য প্রয়োজন আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, প্রযুক্তিগত অবকাঠামো এবং জনগণের সচেতনতা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা: বাংলাদেশ ব্যাংক একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম বাংলা কিউআর (Bangla QR) চালু করেছে, যা বিভিন্ন ব্যাংক এবং মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস এর মধ্যে লেনদেন সহজ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৭ সালের মধ্যে দেশের ৭৫ শতাংশ লেনদেন নগদহীন করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যা থেকে বোঝা যায় যে সরকার এই বিষয়ে কতটা আন্তরিক।

বিশেষজ্ঞদের মতামত: বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ডিজিটাল লেনদেনের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি করা সবচেয়ে জরুরি। এর জন্য সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং লেনদেনকে আরও সহজ ও সাশ্রয়ী করা প্রয়োজন। তারা পরামর্শ দেন যে, লেনদেনের চার্জ কমানোর জন্য রেগুলেটরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

ফিনটেক খাতের ভূমিকা, মানবিক দিক ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
নগদহীন সমাজের পথে কেবল সরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, বেসরকারি খাতের ভূমিকাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।ফিনটেক খাতের উদ্ভাবন: দেশের ফিনটেক স্টার্টআপগুলো নতুন নতুন সেবা নিয়ে আসছে এবং ঐতিহ্যবাহী ব্যাংকগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাজারকে আরও গতিশীল করছে। মোবাইল ব্যাংকিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেমেন্ট গেটওয়ে, ক্রেডিট স্কোরিং প্ল্যাটফর্ম এবং ক্ষুদ্র ঋণের জন্য ফিনটেক অ্যাপগুলো এই বিপ্লবের অংশ।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও ক্ষুদ্র ঋণের সুযোগ: ডিজিটাল লেনদেনের রেকর্ড ব্যবহার করে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামীণ বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মানুষের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ বা অন্যান্য আর্থিক সেবা চালু করতে পারে। এটি তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখবে।

মানবিক ও সামাজিক প্রভাব: ডিজিটাল লেনদেন সাধারণ মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে। একজন দিনমজুর তার বেতন সরাসরি মোবাইলে পেয়ে নিরাপদ বোধ করছেন। একজন ছোট মুদি দোকানদার কিউআর কোড ব্যবহার করে তার ব্যবসার হিসাব রাখতে পারছেন। সবচেয়ে বড় কথা, নারীদের মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বাড়াচ্ছে, যা সমাজের ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখছে।

নগদ টাকার ভূমিকা ও ভারসাম্য: ক্যাশলেস ব্যবস্থার সুফলের পাশাপাশি নগদ টাকারও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। জরুরি পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ বা ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলেও নগদ টাকা দিয়ে লেনদেন করা যায়। এটি একটি নির্ভরযোগ্য ব্যাকআপ ব্যবস্থা, যা সব ধরনের মানুষের জন্য স্বস্তি নিয়ে আসে। একটি সম্পূর্ণ ক্যাশলেস সমাজ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। তাই, ক্যাশলেস ব্যবস্থার প্রসার ঘটানোর পাশাপাশি নগদ লেনদেনেরও একটি সহনশীলতা বজায় রাখা প্রয়োজন।

ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লব: ক্যাশলেস লেনদেন হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের একটি অপরিহার্য অংশ। এটি ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং এবং অন্যান্য ডিজিটাল অর্থনীতির মূল ভিত্তি। ভবিষ্যতে ব্লকচেইন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে লেনদেনকে আরও নিরাপদ করা যেতে পারে। এআই ব্যবহার করে জালিয়াতি সনাক্তকরণ, ক্রেডিট স্কোরিং তৈরি করা এবং আর্থিক সেবাগুলোকে আরও ব্যক্তিগতকৃত করার সুযোগ রয়েছে। তবে এর পাশাপাশি ডেটা সুরক্ষার ঝুঁকিও বাড়বে, যা মোকাবিলায় একটি শক্তিশালী ডেটা সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা জরুরি।

একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা: ক্যাশলেস বাংলাদেশের রোডম্যাপ
নগদহীন সমাজের যাত্রা সফল করতে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা জরুরি।
আন্তঃসংযোগ নিশ্চিতকরণ: সকল মোবাইল ব্যাংকিং এবং ব্যাংকগুলোর মধ্যে সহজ আন্তঃযোগাযোগ নিশ্চিত করতে একটি অভিন্ন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। বর্তমানে বাংলা কিউআর-এর বাস্তবায়নের পথে যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে (যেমন: বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চার্জের ভিন্নতা, প্রচারের অভাব), তা দূর করতে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

চার্জ কমানো: ক্ষুদ্র ও খুচরা লেনদেনের জন্য চার্জ শূন্য বা ন্যূনতম করা, যাতে সকল স্তরের মানুষ ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহিত হয়।
সাইবার নিরাপত্তা জোরদার: সাইবার প্রতারণা থেকে গ্রাহকদের রক্ষা করতে শক্তিশালী ডেটা সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এবং এর কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা।

ব্যাপক সচেতনতা: শুধু ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার শেখানো নয়, বরং আর্থিক ঝুঁকি, বাজেট ও ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের বিষয়েও মানুষকে সচেতন করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি ব্যাংক এবং ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত উদ্যোগে গ্রামে গ্রামে এই ধরনের সচেতনতা অভিযান চালানো যেতে পারে।

নগদহীন সমাজ থেকে দূরে থাকা বাংলাদেশের জন্য আর কোনো বিকল্প নয়। যদিও এই পথে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সরকার এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই বাধাগুলো দূর করা সম্ভব। প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নত করা, ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ানো, এবং লেনদেনের খরচ কমানো- এই তিনটি ক্ষেত্রে মনোযোগ দিলে বাংলাদেশ দ্রুত একটি নগদহীন অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে পারবে। নগদহীন সমাজ কেবল একটি আর্থিক পরিবর্তন নয়, এটি একটি জীবনযাত্রার পরিবর্তন। এটি স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা এবং প্রবৃদ্ধির একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *