ই-কমার্স কি পাল্টে দেবে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): একবিংশ শতাব্দীর এই ডিজিটাল যুগে, ইন্টারনেট আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে। কেনাকাটার পদ্ধতিও এর বাইরে নয়। কাগজের টাকা, খুচরা বিক্রেতা আর সশরীরে দোকানে যাওয়ার চিরায়ত ধারণা ভেঙে দিয়ে ই-কমার্স বা ইলেকট্রনিক কমার্স এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশেও এর ঢেউ লেগেছে, যা গত এক দশকে ব্যবসা-বাণিজ্যের চেহারা পাল্টে দিতে শুরু করেছে। প্রশ্ন হলো, ই-কমার্স কি সত্যিই বাংলাদেশের প্রচলিত ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপ সম্পূর্ণ পাল্টে দেবে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের এর ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যতের সম্ভাবনা এবং সর্বোপরি দেশীয় নীতিমালা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।

বাংলাদেশের ই-কমার্স এর যাত্রা: এক নতুন ইতিহাস
বাংলাদেশে ই-কমার্সের আনুষ্ঠানিক যাত্রা হয় মূলত ২০১০ সালের পর থেকে, যখন ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়তে থাকে। শুরুর দিকে এটি ছিল বেশ সীমিত পরিসরে, কিছু ছোট উদ্যোগের মাধ্যমে। তখন অনলাইন কেনাকাটার প্রতি মানুষের আস্থা ছিল কম, কারণ পণ্য ডেলিভারি, অর্থ পরিশোধ এবং পণ্যের গুণগত মান নিয়ে ছিল নানা সন্দেহ। ২০১১ সালে বাংলাদেশে মার্কেট সাইজ ছিল নামমাত্র, অনুমান করা হয় বছরে মাত্র কয়েক কোটি টাকা। তখন প্রতিদিনের অর্ডার সংখ্যা ছিল হাতে গোনা, সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ১০০টি। দারাজ, আজকেরডিল অথবা ফ্লিপকার্টের মতো কিছু প্ল্যাটফর্ম এই অগ্রযাত্রার পথিকৃৎ ছিল।
প্রথম দিকে ই-কমার্সের মূল চ্যালেঞ্জ ছিল তিনটি: ১) মানুষের মধ্যে অনলাইন কেনাকাটার বিষয়ে সচেতনতার অভাব, ২) পণ্য ডেলিভারির জন্য নির্ভরযোগ্য লজিস্টিক ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং ৩) অনলাইন পেমেন্টের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব। তখন বেশিরভাগ লেনদেনই হতো ক্যাশ অন ডেলিভারি পদ্ধতিতে।
বর্তমান অবস্থা: এক অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি
গত এক দশকে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়েছে। বিশেষ করে ২০১৯ সালের পর থেকে এর প্রবৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় যখন স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থমকে গিয়েছিল, তখন ই-কমার্সই ছিল মানুষের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহের প্রধান মাধ্যম। এই সময়ে, অনলাইন কেনাকাটার প্রতি মানুষের আস্থা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
বর্তমানে বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজারের আকার অনেক বড় হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে এই বাজারের আকার ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এটি কেবল বাজারের আকারের বৃদ্ধিই নয়, বরং অনলাইন ক্রেতা এবং অর্ডারের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এখন প্রতিদিন সারা দেশে কয়েক লক্ষ অর্ডার প্রসেস করা হয়। বড় শহরগুলোতে এখন এক ঘণ্টার মধ্যে পণ্য ডেলিভারির সেবাও চালু হয়েছে।
এই প্রবৃদ্ধির পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে
ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা: বর্তমানে দেশের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে। সাশ্রয়ী মূল্যের স্মার্টফোন মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যাওয়ায়, এখন গ্রামের মানুষও অনলাইনে কেনাকাটার সুযোগ পাচ্ছে।
ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের প্রসার: মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ, রকেট, নগদ) এবং অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ের সহজলভ্যতা লেনদেনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। এর ফলে ক্যাশ অন ডেলিভারির ওপর নির্ভরশীলতা কমছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার: ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য শক্তিশালী বিপণন কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। অনেক উদ্যোক্তা এখন কোনও ওয়েবসাইট ছাড়াই শুধুমাত্র ফেসবুক পেজের মাধ্যমে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এটি বাংলাদেশে এফ-কমার্স নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
সরকারের সহযোগিতা: সরকার ই-কমার্সকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন নীতি ও উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন এবং ই-কমার্স নীতিমালা প্রণয়ন।
ই-কমার্স সংক্রান্ত দেশীয় নীতিমালা: কতটা সহায়ক
২০২১ সালে সরকার ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা, ২০২১ নামে একটি নীতিমালা জারি করে, যা ই-কমার্স খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। এই নীতিমালার মূল উদ্দেশ্য ছিল-
ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা: পণ্যের গুণগত মান, মূল্য এবং ডেলিভারি সময় সম্পর্কে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
রিফান্ড পলিসি: নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য ফেরত এবং রিফান্ড পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয়া।
মূল্য নিয়ন্ত্রণ: বিক্রেতারা যাতে পণ্য ডেলিভারি দেয়ার আগে পুরো মূল্য অগ্রিম নিতে না পারে, সেই বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া।
প্রতারণা প্রতিরোধ: বিভিন্ন লোভনীয় অফার দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে প্রতারণার জাল থেকে রক্ষা করা।
এই নীতিমালা ই-কমার্স খাতে প্রাথমিক স্তরের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে। বিশেষ করে, মূল্য অগ্রিম পরিশোধের বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করার ফলে সাম্প্রতিক সময়ে ই-কমার্স খাতে কিছু বড় প্রতারণার ঘটনা অনেকটাই কমে এসেছে। এটি ক্রেতাদের মধ্যে কিছুটা হলেও আস্থা ফিরিয়ে এনেছে।
নীতিমালায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
যদিও বর্তমান নীতিমালা কিছু ইতিবাচক ফল এনেছে, তবে এটি বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বিশ্বমানের ই-কমার্স হাব হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হলে নীতিমালায় আরও কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
১. ডেটা নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা: বর্তমান নীতিমালায় ডেটা সুরক্ষা সংক্রান্ত সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো ক্রেতাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে। এই তথ্যের সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী ডেটা সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা অপরিহার্য। এটি ক্রেতাদের আস্থা বাড়াবে এবং সাইবার অপরাধ কমাতে সাহায্য করবে।
২. ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ নীতি: অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করেন। তাদের জন্য সরকারি লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সহজ করা উচিত। একটি সহজ নিবন্ধন প্রক্রিয়া এবং কর সুবিধা তাদের ব্যবসায়িক সম্প্রসারণে সহায়তা করবে।
৩. লজিস্টিক ও ডেলিভারি ব্যবস্থার জন্য নীতিমালা: দ্রুত এবং কার্যকর ডেলিভারি ই-কমার্সের প্রাণ। সরকারিভাবে একটি সমন্বিত লজিস্টিক নীতি তৈরি করা উচিত, যা লজিস্টিক কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করবে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ডেলিভারি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।
৪. ডিজিটাল পেমেন্ট অবকাঠামো উন্নয়ন: ক্যাশ অন ডেলিভারির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে ডিজিটাল পেমেন্টকে আরও সহজ ও নিরাপদ করতে হবে। ব্যাংক এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো দরকার।
৫. ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স নীতিমালা: বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ই-কমার্স পণ্য তুলে ধরার জন্য একটি সহজ ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। এটি বাংলাদেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে সহায়তা করবে এবং দেশের রপ্তানি আয় বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।
৬. ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ: বর্তমানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ওপর অনেক চাপ থাকে। অনলাইন অভিযোগ দাখিল এবং দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি স্বায়ত্তশাসিত অনলাইন ডিসপিউট রেজোলিউশন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে।
এক নতুন বাণিজ্যিক বিপ্লব
ই-কমার্স কি বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেবে। উত্তর হলো, হ্যাঁ, তবে তা ধীরে ধীরে এবং একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এটি প্রচলিত ব্যবসাকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে দেবে না, বরং এটিকে আরও আধুনিক এবং কার্যকরী করে তুলবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এখন খুব সহজেই সারা দেশের ক্রেতার কাছে তাদের পণ্য পৌঁছে দিতে পারছেন, যা আগে কেবল বড় কোম্পানিগুলোর পক্ষেই সম্ভব ছিল। তবে, কেবল ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের প্রসারই যথেষ্ট নয়। এই খাতকে টেকসই করতে হলে একটি শক্তিশালী, গতিশীল এবং দূরদর্শী নীতিমালা প্রয়োজন।
যদি সরকার ডেটা সুরক্ষা, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহায়তা এবং লজিস্টিক অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে নজর দেয়, তাহলে ই-কমার্স কেবল একটি কেনাকাটার মাধ্যম হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এটি একটি নতুন অর্থনৈতিক মডেল হিসেবে দেশের অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই বিপ্লব কেবল শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে ই-কমার্স বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে, যেখানে ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা এবং ডিজিটাল কমার্স একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করবে।
লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব