অদৃশ্য হুমকি: যেভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নারীর কর্মসংস্থানকে ঝুঁকিতে ফেলছে

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যা একসময় কেবল বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর বিষয় ছিলো, আজ আমাদের বাস্তবতাকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। এটি এক নতুন শিল্প বিপ্লবের সূচনা, যেখানে অ্যালগরিদম কেবল শারীরিক শ্রম নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক কাজগুলোকেও প্রতিস্থাপন করছে। এই প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সমর্থকরা এর মাধ্যমে সুবিধা, দক্ষতা এবং উদ্ভাবনের প্রতিশ্রুতি দিলেও, এর আড়ালে লুকিয়ে আছে এক নীরব বিপদ- বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশ, যেমন বাংলাদেশের নারীদের কর্মসংস্থানের ওপর একটি বিশাল হুমকি। এই অদৃশ্য হুমকিকে যথাযথভাবে মোকাবিলা না করতে পারলে, এটি আমাদের সমাজের লিঙ্গ সমতার দীর্ঘদিনের অর্জনগুলোকে ম্লান করে দিতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশের উদ্বেগ
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উদ্বেগজনক প্রবণতার ওপর আলোকপাত করেছে। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়- বিশ্বব্যাপী নয় দশমিক ছয় শতাংশ নারীর ঐতিহ্যবাহী চাকরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা রূপান্তরিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি মাত্র তিন দশমিক পাঁচ শতাংশ। যদিও প্রতিবেদনটি মূলত উচ্চ-আয়ের দেশগুলোকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়েছে, কিন্তু এর ঢেউ ইতিমধ্যেই আমাদের অঞ্চলেও আছড়ে পড়ছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য, যেখানে গত কয়েক দশকে কর্মক্ষেত্রে নারীদের একটি নীরব বিপ্লব ঘটেছে, এই পরিসংখ্যান গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। কর্মসংস্থানে নারীর এই নীরব বিপ্লব কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেই নয়, সামাজিক রূপান্তরের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এখন প্রশ্ন হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি এই ইতিবাচক ধারাকে ব্যাহত করবে?
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অপরিসীম অবদান
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নারীরা দীর্ঘদিন ধরেই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তৈরি পোশাক কারখানার সেলাই ফ্লোর থেকে শুরু করে প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক কাজ পর্যন্ত, নারীরা দেশের জিডিপি, রপ্তানি আয় এবং সামাজিক পরিবর্তনে অসামান্য অবদান রেখেছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু তৈরি পোশাক খাতেই ৪৫ লাখেরও বেশি শ্রমিকের মধ্যে ষাট শতাংশ এর বেশি নারী। তাদের কঠোর পরিশ্রম বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ ছাড়া নারীরা ক্ষুদ্রঋণ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং আইসিটির মতো ক্ষেত্রগুলোতেও নিজেদের প্রমাণ করেছেন, যা অন্যদেরকে প্রচলিত সীমানা ছাড়িয়ে নতুন দিগন্তে পা রাখতে উৎসাহিত করছে। এটি কেবল অর্থনৈতিক অবদানই নয়, সমাজে নারীর মর্যাদা ও আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক হয়েছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগমনে নারীর কর্মসংস্থানে ঝুঁকি
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যখন সচিবালয়ের কাজ, প্রশাসনিক কাজ, গ্রাহক পরিষেবা এবং এমনকি কিছু সৃজনশীল ক্ষেত্রের মতো ঐতিহ্যবাহী নারী-প্রধান কাজগুলোতে প্রবেশ করতে শুরু করেছে, তখন আশঙ্কা করা হচ্ছে যে নারীরা এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আইএলও যেমন উল্লেখ করেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সরাসরি চাকরি বিনাশ করে না, বরং এটি কাজগুলোকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলে। এটি পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলোকে স্বয়ংক্রিয় করে তোলে, যা মানবিক বিচার এবং মানসিক বুদ্ধিমত্তার জন্য আরও জায়গা তৈরি করে। কিন্তু সমস্যা হলো, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, অনেক নারীই রুটিনভিত্তিক, পুনরাবৃত্তিমূলক এবং কম জটিল কাজগুলোতে নিযুক্ত, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেমগুলো অত্যন্ত নির্ভুলতা ও ক্লান্তিহীনভাবে সম্পাদন করতে সক্ষম।
উদাহরণস্বরূপ, একটি ব্যাংকের ব্যাক-অফিস ক্লার্ক, একটি পোশাক কারখানার ডেটা এন্ট্রি অপারেটর, অথবা এমনকি একটি কল সেন্টার এজেন্টের মতো পদগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। পুরুষদের বিপরীতে, যারা সাধারণত প্রযুক্তিগত, তত্ত্বাবধায়ক বা মাঠ পর্যায়ের কাজগুলোতে বেশি জড়িত থাকেন, নারীরা হয়তো যথাযথ প্রশিক্ষণ বা পুনরায় দক্ষতা অর্জন ছাড়া নতুন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবেন। এই চ্যালেঞ্জগুলো তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগকে আরও সংকুচিত করতে পারে।
ডিজিটাল বিভেদ ও অসম সুযোগের ফাঁদ
বাংলাদেশের নারীরা এখনও ডিজিটাল বিভেদ এবং শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগের অভাবে ভুগছেন। পুরুষরা প্রায়শই পেশাগত নেটওয়ার্ক এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ক্যারিয়ারের সিঁড়িতে সহজে ওঠতে পারলেও, নারীরা পারিবারিক ও সামাজিক বাধ্যবাধকতার কারণে নিম্ন পদে সীমাবদ্ধ থাকেন। তারা প্রায়শই ঘর ও অফিসের কাজের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় বা সংস্থান পান না। এই প্রবণতা চলতে থাকলে, কর্মসংস্থানে বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্য- যা ইতিমধ্যেই বিশাল একটি গভীর খাদে পরিণত হতে পারে।
নারী শিক্ষার অগ্রগতি, স্বাস্থ্যসেবা এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ এখনও মাত্র ছত্রিশ শতাংশ, যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে এটি আশি শতাংশের এর বেশি। অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির অভাবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আরও বেশি নারীকে আনুষ্ঠানিক কাজ থেকে ঠেলে অনৈচ্ছিক বা অনানুষ্ঠানিক ভূমিকায় নিয়ে যেতে পারে, যা তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে সীমিত করবে।
গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে নারীরা সম্প্রতি উদ্যোক্তা এবং ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে শুরু করেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেখানে আশীর্বাদ এবং অভিশাপ উভয়ই হতে পারে। একদিকে এটি বিপণন, নকশা এবং ব্যবসায়িক বিশ্লেষণের জন্য স্মার্ট সরঞ্জাম সরবরাহ করে, অন্যদিকে এটি ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার মানও বাড়িয়ে তোলে- যে দক্ষতাগুলো অনেক গ্রামীণ নারী এখনও পুরোপুরি অর্জন করতে পারেননি।

ভবিষ্যতের পথে: নারী ক্ষমতায়নে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার
তবে, সব আশা হারায়নি। আইএলও যেমন পরামর্শ দিয়েছে, প্রশ্নটা এই নয় যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজের প্রকৃতি পরিবর্তন করবে কিনা- এটা নিশ্চিতভাবেই করবে। আসল প্রশ্ন হলো আমরা কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য ব্যবহার করতে পারি, নাকি তাদের কোণঠাসা করে ফেলব? এর উত্তরই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। সরকার, নিয়োগকর্তা এবং সুশীল সমাজকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দ্রুত ও সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।
১. লিঙ্গ-সংবেদনশীল ডিজিটাল শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি: আমাদের লিঙ্গ-সংবেদনশীল ডিজিটাল শিক্ষা এবং দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির প্রয়োজন, বিশেষ করে গ্রামীণ ও আধা-শহুরে এলাকায়। সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এমন লক্ষ্যভিত্তিক প্রশিক্ষণ তৈরি করা যেতে পারে যেমন- লজিস্টিকস, ই-কমার্স, স্বাস্থ্যসেবা বা ডিজিটাল পরিষেবা স্থানান্তরিত হতে সাহায্য করবে। এই প্রশিক্ষণগুলো অবশ্যই এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে যাতে নারীরা তাদের পারিবারিক দায়িত্বের পাশাপাশি সেগুলো সহজেই গ্রহণ করতে পারেন।
২. নৈতিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাস্তবায়ন ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো: নৈতিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে একটি শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো থাকতে হবে। এটি এমন পক্ষপাতিত্ব প্রতিরোধ করবে যা নারীদের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলে বা গতানুগতিক ধারণাগুলোকে শক্তিশালী করে। নিয়োগকর্তাদের অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক নিয়োগ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে এবং নমনীয় কাজের ব্যবস্থা প্রদান করতে হবে যা নারীদের ঘরে ও কর্মক্ষেত্রে উভয় ক্ষেত্রেই তাদের দ্বৈত ভূমিকা পালনে সহায়তা করে। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
৩. নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ: সবশেষে, নারীদেরকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আলোচনার কেন্দ্রে রাখতে হবে-ডেভেলপার, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী এবং ভবিষ্যতের ডিজাইনার হিসাবে। নারীদেরকে কেবল নীতির নিষ্ক্রিয় প্রাপক হিসাবে বিবেচনা না করে, পরিবর্তনের সক্রিয় এজেন্ট হিসাবে দেখা শুরু করার সময় এসেছে। তাদের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ডিজাইন এবং প্রয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, যা নারী-বান্ধব সমাধান তৈরি করবে।
অর্থনৈতিক রূপান্তরের এই বিশাল দাবাবোর্ডে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে রানী বলা ভুল হবে না- এটি শক্তিশালী, গতিশীল এবং খেলা-পরিবর্তনকারী। কিন্তু ন্যায়সঙ্গত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশল ছাড়া, আমরা লাখ লাখ সক্ষম, কঠোর পরিশ্রমী নারীকে কেবল কর্মহীন নারীতে পরিণত করার ঝুঁকিতে আছি।
আমাদের দেশ আজ এক ঐতিহাসিক মোড়ে দাঁড়িয়ে। আমরা কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বিদ্যমান বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলতে দেব, নাকি আমরা এই সুযোগে এগিয়ে এসে নারী ক্ষমতায়নকে কেন্দ্র করে অগ্রগতির নিয়মগুলো নতুন করে লিখব? এই প্রশ্নের উত্তর কেবল আমাদের কন্যা ও বোনদের ভাগ্যই নির্ধারণ করবে না, বরং আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের আত্মাকেও সংজ্ঞায়িত করবে। সময় এসেছে সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নেয়ার এবং নিশ্চিত করার যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-এর সুবিধাগুলো সবার জন্য, বিশেষ করে নারীর জন্য, সমানভাবে উপলব্ধ হয়।
লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব