প্রতিবেদন

”ব্লকচেইন প্রযুক্তি” নিরাপদ স্থায়ীত্বের জন্য একটি সম্ভাবনাময় পদক্ষেপ!

সমুদ্রের গভীরতা যেমন সহজে অনুমান করা যায় না, ঠিক তেমনি ব্লকচেইন’কে বিট করা বিশ্বের যেকোনো আধুনিক শক্তিশালী প্রযুক্তি বা সর্বকালের সেরা শক্তিশালী হ্যাকারের পক্ষেও সম্ভব না, যা অসম্ভব। আমরা White hacking or Black hacking যাই বলি না কেনো, ব্লকচেইন’কে বিট করা এককথায় প্রায় অসম্ভব।

গত ১৮০০ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে মানব সভ্যতা বিভিন্ন দিক থেকে প্রযুক্তি উন্নয়নের ছোয়া পেতে শুরু করেছে, যেমন ১৮৩৯ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ও ফটোগ্রাফার উইলিয়াম হেনরি ফক্স ফটোগ্রাফিক ছবি স্থাপন করতে সক্ষম হন। এরপর ক্যামেরার উন্নয়ন চলতে থাকে। আধুনিক প্রযুক্তি শুরু হয় ১৮শ শতাব্দীর শেষ দিকে যখন স্টিম ইঞ্জিন উন্নয়ন করা হয়। তখন থেকে হাইটেক প্রযুক্তি এবং আধুনিক উপকরণ উন্নয়ন করা হয়েছে।

১৯০০ শতাব্দীর শুরুটাতে রেডিও এবং টেলিভিশন প্রযুক্তির উন্নয়ন শুরু হয়। ১৯শতকের দিকে ১৯৬০ এর দশকের শেষে প্রাথমিক কমপিউটার প্রোগ্রামিং ভাষা ব্যবহার করে একটি সিস্টেম লগইন করে একটি কমান্ড ব্যবহার করেছিলেন। এই কমান্ডটি ব্যবহার করে সিস্টেম এডমিনিস্ট্রেটর সব ব্যবহারকারী এবং সিস্টেম কন্ট্রোল করতে পারতেন। এই ঘটনাটি একটি প্রাথমিক White হ্যাকিং হিসাবে গণ্য করা হয়। যদিও হ্যাকিং বিষয়টি খুবই পুরাতন। ধীরে ধীরে প্রযুক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি একটা সময় ডেটা নিরাপত্তা এবং ডেটা সংরক্ষণ বিষয়টি প্রযুক্তিবিদদের মাথায় চলে আসে।

শুরু হয় গেলো তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে কর্মযজ্ঞ। নিরাপত্তার বেস্টনিকে শক্তিশালী কিভাবে করা যায় শুরু হয় প্রতিযোগিতা কিন্তু একের পর এক নিরাপত্তার বলয় ভেঙে ফেলে। ফলে বেশির ভাগ সিস্টেম বা তথ্য ভান্ডারকে হ্যাকার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়ে উঠে। যে প্রযুক্তিকে হ্যাকার বিট করতে পারে নাই, ভবিষ্যতে পারবেও না যেখানে হ্যাকার শতভাগ ব্যর্থ। এই প্রযুক্তি নাম হচ্ছে ব্লকচেইন টেকনোলজি। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি ব্লকচেইন টেকনোলজি যেখানে তথ্য শতভাগ নিরাপদ এবং হ্যাকিং প্রায় অসম্ভব। ব্লকচেইন নিয়ে এবারের প্রতিবেদনটি লিখেছেন… মো. সুমন মিয়া

ব্লকচেইন প্রযুক্তি কি?
ব্লকচেইন প্রযুক্তি একটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক প্রযুক্তি যা ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার তৈরি করে। ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার একটি প্রযুক্তি যা ব্লকচেইন প্রযুক্তির উন্নয়ন করে তোলে। এটি ব্লকচেইনের মতো একটি ডিস্ট্রিবিউটেড ডেটা স্টোরেজ হিসাবে কাজ করে, যা ক্রিপ্টোগ্রাফিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এনক্রিপ্ট করা থাকে। ব্লকচেইন এর গঠনপ্রণালী হলো একটি ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার প্রণালী, যেখানে ডেটা ব্লক নামে পরিচিত একটি নির্দিষ্ট স্ট্রাকচার বা গঠন অনুযায়ী সংরক্ষিত হয়।

প্রত্যেক ব্লকে সংগ্রহিত হয় পূর্বের সমস্ত ব্লকের তথ্য এবং পরের ব্লকে সংযুক্ত হয় নতুন তথ্য। এভাবে ব্লকগুলি একসঙ্গে পূর্ববর্তী ব্লকগুলো একটি আরেকটি ওপর নির্ভরশীল হয় এবং একটি সম্পূর্ণ লেজার তৈরি হয়। এই গঠন প্রণালীতে সকল নেটওয়ার্ক পার্টিসিপেন্ট নির্দিষ্ট কাজ করে মানে একজন কাজ শেষ করে তাদের নোড বা নেটওয়ার্কের মধ্যে পরস্পরের মধ্যে তথ্য শেয়ার করে। এভাবে সকল নেটওয়ার্ক পার্টিসিপেন্টের মধ্যে ডেটা ডিস্ট্রিবিউট করা হয়। এটাই হচ্ছে ডিসট্রিবিউটেড লেজার।

ব্লকচেইন একটি ডিসট্রিবিউটেড প্রযুক্তি যা ব্লকচেইনের নেটওয়ার্ক একত্রিত সদস্যদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী কাজ করে যা কমপিউটার নেটওয়ার্কের মতো কাজ করে। স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলাম যে, ব্লকচেইন একটি শক্তিশালী ক্রিপ্টোগ্রাফিক প্রযুক্তি সেই সঙ্গে সুরক্ষিত তাই এটা বিট করা প্রায় অসম্ভব!

ব্লকচেইনকে বিট করা কেনো প্রায় অসম্ভব?
ব্লকচেইনের ক্রিপ্টোগ্রাফিক প্রযুক্তি যা খুব শক্তিশালী এবং সুরক্ষিত হওয়ায় এটি বিট করা প্রায় অসম্ভব। ক্রিপ্টোগ্রাফিক প্রযুক্তি যা ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার তৈরি করে। এই লেজারটি একটি অসাধারণ মানের প্রমাণ বিধি ব্যবহার করে সংরক্ষিত হয়। এই প্রমাণ বিধি হল ব্লকচেইনে সংরক্ষিত তথ্যের হ্যাশ। একটি ব্লকচেইন সম্পূর্ণ উচ্চ স্তরের ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এটি আরও অনেক বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে। ব্লকচেইনের একটি ব্লক সম্পূর্ণ একটি নির্দিষ্ট স্ট্রাকচার অনুসারে তৈরি করা হয় এবং পূর্ববর্তী ব্লকের সঙ্গে সংযোগ রক্ষিত থাকে। প্রতিটি ব্লক একটি হ্যাশ উপস্থাপন করে যেটা পূর্ববর্তী ব্লকের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে থাকে এবং একটি ব্লকের হ্যাশ পরবর্তী ব্লকের হ্যাশের সঙ্গেও সংযোগ রক্ষা করে থাকে।

আরও একটি বিষয় হলো, ব্লকচেইন প্রযুক্তিটি ডিস্ট্রিবিউটেড হওয়ায় একটি ব্লক সংশোধন করার জন্য সমস্ত নেটওয়ার্কের অনুমতি প্রয়োজন। একটি ব্লকে সংশোধন করার জন্য একটি হ্যাকার প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ নেটওয়ার্কের অনুমতি অধিগ্রহণ করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব। এর আরেকটি সুবিধা হচ্ছে, কম ব্যান্ডউইডথ এবং স্টোরেজ ব্যবহার করে ডেটা স্টোর এবং ট্রান্সফার করা যেতে পারে।

ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে কি তথ্য শতভাগ নিরাপদ?
ব্লকচেইন প্রযুক্তি শতভাগ নিরাপদ কারণ, ব্লকচেইন তথ্য সংরক্ষণের জন্য একটি প্রযুক্তি যেখানে একটি ডিস্ট্রিবিউটেড নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সমস্ত তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। একটি ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে সমস্ত কমপিউটারে একই সংখ্যক কপি থাকে। সকল তথ্য সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে Centralized কোনো সার্ভার নেই এটা সম্পুর্ন Decentralised। ব্লকচেইন তথ্য সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য ডিস্ট্রিবিউটেড নেটওয়ার্ক ব্যবহৃত হয়, যা প্রতিটি কমপিউটার একই সংখ্যক কপি ধারণ করে এবং প্রতিটি কমপিউটার ডেটা প্রস্তুত এবং সংগ্রহ করে এবং একবার একটি ব্লক যুক্ত করা হলে, এটি নির্দিষ্ট একটি হ্যাশ সংখ্যা দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয় এবং আগের সমস্ত ব্লকের সঙ্গে যুক্ত হয়।

ব্লকচেইন কোন কোন দেশে ব্যবহার হচ্ছে?
ব্লকচেইন প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী এবং এটি বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে, কিছু দেশ ব্লকচেইন ব্যবহার করে বিশেষভাবে তাদের প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধান বের করা হচ্ছে। কিছু দেশে ব্লকচেইন একটি অভিনব উদ্যোগ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন ইস্তোনিয়া যেখানে ব্লকচেইন দ্বারা ই-রেজিস্ট্রেশন, ই-ভোটিং এবং অন্যান্য সেবাগুলো সরবরাহ করা হচ্ছে।

জাপান, সিঙ্গাপুর এবং সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশগুলো এক্সপেরিমেন্ট করেছে। ব্লকচেইন ব্যবহার করে দক্ষিণ কোরিয়া, ডাচল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, কানাডা ও ব্রিটেন এমনকি আরও অনেক দেশে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়াও কিছু দেশ ব্লকচেইন ব্যবহার করে স্বতন্ত্র ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং টোকেনের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন চালাচ্ছে, যেমন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, ভেনেজুয়েলা অন্যতম। আরও কিছু দেশ ব্লকচেইন ব্যবহার করে সেটিকে তাদের সমস্যার সমাধান করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে, ব্লকচেইন এখনও একটি নতুন প্রযুক্তি এটি উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো উচ্চ পর্যায়ের গবেষণা চালু রেখেছে।

ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহারে সাধারণ মানুষ কি উপকার পেতে পারে?
ব্লকচেইন একটি সামাজিক প্রযুক্তি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার প্রধানত দুটি যেমন : স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনে। এ ছাড়া কৃষি পন্য, বানিজ্যিক লেনদেনের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। ব্লকচেইন ব্যবহার করে স্বেচ্ছাসেবক যুবকরা ব্যবহারকারীদের সঙ্গে বিনা মূল্যে তথ্য শেয়ার করতে পারেন। এ ছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং আইনজীবির বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের জন্য কাজ করে।

ব্লকচেইন একটি সফটওয়্যার নয়, বরং একটি প্রযুক্তি বা সিস্টেম। ব্লকচেইন একটি বিশেষ ধরণ যা সমস্ত ট্রানজেকশন এবং ডেটা সংরক্ষণ করে থাকে। এটি একটি নিরাপদ এবং জটিল সিস্টেম যা উচ্চমানের নিরাপত্তা সরবরাহ করে। ব্লকচেইন ব্যবহার করা হয় অর্থ লেনদেন, পরিবহন ব্যবস্থা ছাড়াও অন্যান্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজে।

শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি ব্লকচেইন প্রযুক্তি যেখানে তথ্য শতভাগ নিরাপদ এবং একটি সুরক্ষিত ও নিরাপদ ডিজিটাল প্রযুক্তি, যা একটি বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়িক এবং সাধারণ মানুষের কাছে একটি নিরাপদ পদক্ষেপ হিসাবে চলতে পারবে। আরও একটি বিষয় পরিস্কার যে, ব্লকচেইন একটি সফটওয়্যার নয়, বরং একটি প্রযুক্তি বা সিস্টেম। ব্লকচেইন এমন একটা সিস্টেম যা একটি উচ্চমানের নিরাপত্তা সরবরাহ করবে এবং আদর্শ পদক্ষেপ হিসেবে মানব সভ্যতাকে দিন দিন উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

লেখক: মো. সুমন মিয়া, নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার-বিডিকম অনলাইন লিমিটেড এবং লিস্টেট মাইক্রোটিক টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *