অন্যান্য মতামত

১১ বছরে ই-ক্যাব: আস্থা সংকট, নেতৃত্ব বিতর্ক ও ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চ্যালেঞ্জ

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): বাংলাদেশ আজ যখন ‘ডিজিটাল রুপান্তর’ গড়ার স্বপ্ন দেখছে, তখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে দেশের ই-কমার্স খাত। এই খাতকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিতে এবং এগিয়ে নিতে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)- এর ভূমিকা ছিল অপরিহার্য। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় এক যুগ পূর্ণ করে, ই-ক্যাব আজ তার ১১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করছে। এই দীর্ঘ পথচলায় ই-ক্যাবের মিশন, অর্জিত সফলতা, আর্থিক স্বচ্ছতা, নেতৃত্বের অনিয়ম ও সীমাবদ্ধতা সবকিছুর একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরিঃ

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ই-ক্যাবের সূচনা ও অর্জিত সাফল্য
বাংলাদেশে ই-কমার্সের আনুষ্ঠানিক যাত্রা হয় ১৯৯০-এর দশকের শেষদিকে। অনেকের মতে, ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘মুন্সিজি’ ছিল দেশের প্রথম ই-কমার্স সাইট। এর পরে ২০০৫-০৬ সালের দিকে ক্লিকবিডি ডট কম ও সেলবাজার-এর মতো প্ল্যাটফর্ম আসে, যা অনলাইন কেনাবেচার ধারণাটিকে জনপ্রিয় করে তোলে। তবে, দেশে ই-কমার্সের উত্থান জোরালো হয় ২০১১ সালের পর থেকে, যখন আজকের ডিল এবং পরবর্তীতে এখনি ডট কম (যা বাগডুম ডট কম নামে পরিচিত হয়) এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো পূর্ণাঙ্গ পেশাদার ই-কমার্স সেবা নিয়ে আসে।

ঠিক এই পটভূমিতেই, দেশের উদীয়মান ই-কমার্স খাতের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলস্বরূপ, ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর গঠিত হয় ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৫ সালে স্বীকৃতি পায়। ই-ক্যাবের এই প্রতিষ্ঠার পর খাতটিতে এক নতুন গতির সঞ্চার হয়।

অর্থনৈতিক তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে এই খাতের বার্ষিক লেনদেনের আকার প্রায় ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে, এটি ২০২০ সালের ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজারকে ছাড়িয়ে দ্বিগুণের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বর্তমানে, প্রতিদিন গড়ে দেড় লাখ থেকে দুই লাখেরও বেশি অর্ডার প্রসেস হচ্ছে, যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৩ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে।

ই-ক্যাব-এর প্রধান ইতিবাচক কাজ এবং সফলতাগুলোর মধ্যে রয়েছে
নীতিমালা প্রণয়ন: সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে ‘ডিজিটাল কমার্স পলিসি ২০১৮’ এবং ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১’ প্রণয়নে কার্যকর সহায়তা প্রদান।

সামাজিক উদ্যোগ: ই-ক্যাবের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম’ (উই) প্ল্যাটফর্মটি লক্ষ লক্ষ নারী উদ্যোক্তাকে সংগঠিত করে তাদের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ক্রস বর্ডার ও গ্রামীণ সংযোগ: আলিবাবা-এর মতো গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় পণ্যের পথ তৈরি করা এবং ডাক বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ পণ্যকে জাতীয় বাজারে আনার উদ্যোগ নেয়া।

মিশন থেকে বিচ্যুতি: আর্থিক অসচ্ছলতা ও অনিয়মের চিত্র
ই-ক্যাবের মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি নৈতিক ও স্বচ্ছ ব্যবসায়িক ইকোসিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে এই মহৎ মিশন পূরণে বেশ কিছু গুরুতর দুর্বলতা প্রকাশ পায়-

স্বার্থের সংঘাত ও নেতৃত্বের বিতর্ক: অ্যাসোসিয়েশন পরিচালনার ক্ষেত্রে কার্যকরী কমিটিগুলোর ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। প্রায়শই বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধারদের হাতে নেতৃত্ব থাকায় স্বার্থের সংঘাত ছিল প্রকট। কমিটির সদস্যরা নিজেদের কর্পোরেট ব্যবসার স্বার্থ রক্ষায় অধিক মনোযোগ দেয়ায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সমস্যাগুলো যথাযথ অগ্রাধিকার পায়নি।

আর্থিক অসচ্ছলতা: কার্যকরী কমিটিগুলোর আর্থিক কার্যক্রমে পর্যাপ্ত স্বচ্ছতার অভাব ছিল। সদস্য ফি এবং অনুদানের ব্যয়ের বিস্তারিত তথ্য নিয়মিত প্রকাশ না করায় সাধারণ সদস্যদের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের জন্ম হয়।

আস্থা সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থতা: ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ সহ বড় কেলেঙ্কারির সময় ই-ক্যাব তার মিশন ও নৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে ব্যর্থ হয়। এর পাশাপাশি, বর্তমানেও লেনদেনের ৮২ শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশ ক্যাশ অন ডেলিভারি নির্ভর থাকা প্রমাণ করে যে ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেম উন্নয়নে সংগঠনটি সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতা কাটাতে পারেনি।

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা: ই-ক্যাব নির্বাচন বারবার স্থগিত হয়েছে, যা সদস্যদের মধ্যে হতাশা তৈরি করে। এই আইনি জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা ছিল ই-ক্যাবের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার প্রধান প্রমাণ, যার ফলস্বরূপ সরকারের হস্তক্ষেপে প্রশাসক নিয়োগ অনিবার্য হয়ে ওঠে।

সাম্প্রতিক পরিবর্তন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে ই-ক্যাবের অবস্থান
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে, ই-ক্যাবের পরিচালনাতেও পরিবর্তন আসে এবং প্রশাসক নিয়োগের ধারা বজায় থাকে। এই সময়কালে প্রশাসকের মূল মনোযোগ ছিল সংগঠনের রুটিন কাজগুলো সচল রাখা। তবে নেতৃত্ব স্থানীয় সদস্যদের হাতে না থাকায়, নীতি নির্ধারণ বা সরকারের সঙ্গে জোরালো নেগোসিয়েশনের গতি মন্থর ছিল। সদস্যদের প্রধান প্রত্যাশা ছিল দ্রুত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। এই সময়কালটি সংগঠনের জন্য একটি ‘ট্রানজিশনাল পিরিয়ড’ হিসেবে চিহ্নিত হয়।

১১তম বছরে প্রত্যাশা ও সামনের দিনের করণীয়
ই-ক্যাবকে এখন তার মিশন ও নৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বস্ত হয়ে সকল উদ্যোক্তার জন্য কাজ করতে হবে। দ্রুত একটি স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে দক্ষ ও সৎ নেতৃত্বের হাতে সংগঠনের ভার তুলে দেয়াই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভবিষ্যতের জন্য সংগঠনের তিনটি প্রধান করণীয় হতে পারে-

১. আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা: সংগঠনের তহবিল সংগ্রহ ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং ‘স্বার্থের সংঘাত’ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।

২. ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সরাসরি প্রণোদনা: ৪ লক্ষাধিক এফ-কমার্স উদ্যোক্তাকে মূল স্রোতে আনতে তাদের জন্য সহজ অর্থায়ন এবং প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা।

৩. ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধি: ক্যাশ অন ডেলিভারি নির্ভরতা কমাতে এবং অনলাইন পেমেন্টকে উৎসাহিত করতে ট্রাস্ট মেকানিজম তৈরি করা।

এই পদক্ষেপগুলো নিশ্চিত করতে পারলে, ই-ক্যাব কেবল একটি বাণিজ্যিক সমিতি হিসেবে নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে নতুন করে আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবে।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *