স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সকল খাতেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটাতে হবে
ক.বি.ডেস্ক: স্মার্ট বাংলাদেশের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে মানুষের সেবা প্রাপ্তির বিষয়টি যেন সহজ হয়। আমাদের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে কী কী সমস্যা রয়েছে সেসব চিহ্নিত করে সেসব সেবাকে প্রযুক্তির রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে রূপান্তর ঘটানো। এজন্য প্রয়োজন আইওটি, এআই, মেশিন লার্নিংয়ের মতো প্রযুক্তির ব্যবহার। শুধু তথ্যপ্রযুক্তি খাত নয়, দেশের সকল খাতেই এসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
রাজধানীর আইসিসিবিতে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী (৯-১০ জুন) জেসিআই স্মার্ট বাংলাদেশ সামিট, এক্সপো ও সিওয়াইই অ্যাওয়ার্ড ২০২৩ এর সমাপনী দিনে গতকাল (শনিবার) আয়োজিত ৫টি সেশনে বক্তারা এসব কথা বলেন।
ইন্ডাস্ট্রিতে উদ্ভাবন
স্মার্ট ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে, উৎপাদন বাড়াতে এবং পণ্যে নতুন নতুন উদ্ভাবন দিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বিকল্প নেই বলে মনে করেন ব্যবসায়ী ও প্রযুক্তিখাতের প্রতিনিধিরা। আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রথমে ‘ইগনাইটিং ইনোভেশন অ্যান্ড কোলাবোরেশন ফর স্মার্টার ইন্ডাস্ট্রি’ সেশনে এসব কথা বলেন প্যানেলিস্টরা।
তারা বলেন, উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে থাকলে আমরা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো, তেমনি বিশ্ববাজারে নিজেদের পণ্য তুলে ধরতে পারবো না। এ জন্য এখন পণ্য উৎপাদন ও ব্যবসা পরিচালনায় এআই, মেশিন লার্নিংসহ আধুনিক সব প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
সেশনটিতে অংশ নেন একে খান অ্যান্ড কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান আবুল কাশেম খান, হাতিল ফার্নিচারের চেয়্যারম্যান সেলিম এইচ রহমান, ইন্টেলিজেন্স মেশিনসের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ অলি আহাদ, অর্চাড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এজাজ মোহাম্মদ, বাংলাদেশ অ্যাপারেলস ইয়ুথ লিডিরশিপ অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক কাজী ফাহাদ, ডেলোট্টি গ্রুপের মুইজ তাসনিম ত্বাকী এবং বেক্সিমকো টেক্সটাইলসের হেড অব রিটেইল হাদী চৌধুরী। সঞ্চালনা করেন ফার সিরামিকস এর পরিচালক ইরফান উদ্দিন।
ফিন্যান্সিং দ্য ফিউচার : ক্যাপিটাল মার্কেট
প্রযুক্তিনির্ভর পুঁজিবাজারে প্রবেশ করতে পারলে আমাদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ আরও বাড়বে। এআই, মেশিন লার্নিংয়ের মতো প্রযুক্তি দিয়ে ক্যাপিটাল মার্কেটের বিনিয়োগকে বিচার-বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে এই বাজার শক্তিশালী হবে বলে তুলে ধরেন বক্তারা। দ্বিতীয় দিনের দ্বিতীয় সেশন ‘ফিন্যান্সিং দ্য ফিউচার : ক্যাপিটাল মার্কেট’ আয়োজনে এসব কথা বলেন প্যানেলিস্টরা। সেশনে পুঁজিবাজারে ভবিষ্যতের ফিন্যান্সিং, পুঁজিবাজারের প্রযুক্তিগত রূপান্তর ও স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট এবং ভবিষ্যাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই পুঁজিবাজারের জন্য শক্তিশালী বিনিয়োগকারী বিষয়ে আলোচনা হয়।
ইডিজিই ভেঞ্চারস লিমিটেডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা আসিফ খানের সঞ্চালনায় সেশনে প্যানেলিস্ট হিসেবে অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যামাজন হেডকোয়ার্টারের সল্যুশনস আর্কিটেক্ট লিডার মোহাম্মদ জামান, ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান আরিফ খান, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসির কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ।
তরুণদের চোখে স্মার্ট বাংলাদেশ
স্মার্ট বাংলাদেশ কেমন হতে যাচ্ছে সেসব বিষয় নিয়ে দিনের তৃতীয় সেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেশনে অংশ নেন ফোর্বস আন্ডার থার্টির তালিকায় স্থান করে নেয়া নয় তরুণ। তাদের প্রায় সবার কাছে জানতে চাওয়া হয় স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১ সালে দেশে কোন ধরনের প্রযুক্তিগত পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটতে পারে। এখন যে অবস্থায় আছে, সেটি থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে কোন ধরনের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
আলোচকরা জানান, স্মার্ট বাংলাদেশের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে মানুষের সেবা প্রাপ্তির বিষয়টি যেন সহজ হয়। আমাদের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে কী কী সমস্যা রয়েছে সেসব চিহ্নিত করে সেসব সেবাকে প্রযুক্তির রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে রূপান্তর ঘটানো। এজন্য প্রয়োজন আইওটি, এআই, মেশিন লার্নিংয়ের মতো প্রযুক্তির ব্যবহার। তারা বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটা দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই অবকাঠামো উন্নয়ন। সেই সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের নীতিমালা প্রণয়ন এবং সেটি সহজ করা।
সেশনটি সঞ্চালনা করেন বন্ডস্টেইন টেকনোলজির সহপ্রতিষ্ঠাতা জাফির শাফি চৌধুরী। আলোচক ছিলেন এগ্রোশিফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা দীপ্তা সাহা, যাত্রীর সহপ্রতিষ্ঠাতা আজিজ আরমান, মার্কোপোলো এআইয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা রুবাইয়েত ফারহান, টার্টেল ভেঞ্চার স্টুডিওর সহপ্রতিষ্ঠাতা সারাবান তহুরা তুরিন, মাইঅ্যালাইসের প্রতিষ্ঠাতা শুভ রহমান, ক্রিমস্ট্যাকের সহপ্রতিষ্ঠাতা মীর সাকিব, বন্ডস্টেইনের সহপ্রতিষ্ঠাতা মীর শাহরুখ ইসলাম এবং মার্কোপোলো এআইয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা তাসফিয়া তাসবিন।
স্মার্ট এডুকেশন
বর্তমান বিশ্বে চাকরির বাজার বিশ্লেষণ করে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন খাতটি নিয়ে কাজ করা সরকারি, বেসরকারি খাতের সংশ্লিষ্টরা। আয়োজনে ‘স্মার্ট এমপ্লয়মেন্ট শেপিং দ্য ফিউচার অব লার্নিং ইন দ্য স্মার্ট এরা’ সেশনে এমন আহ্বান জানান। সেশনটি সঞ্চালনা করেন এটিএসির কান্ট্রি ডিরেক্টর শুভাশিষ ভৌমিক।
এটুআই’র স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড ইনোভেশন স্পেশালিস্ট এইচএম আসাদ-উজ-জামান বলেন, এরইমধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে সরকার চায় শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত করতে দক্ষতার বিষয়গুলো যুক্ত করছে। উচ্চশিক্ষায় গত কয়েক বছরে ইউজিসি এর একটি বড় পরিবর্তন এনেছে। যা সামনের দিনে আরও আনবে। তবে এর জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থায় এখন সবচেয়ে বেশি উচ্চারণ হচ্ছে কোলাবোরেশন ও পার্টনারশিপ। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইনোভেশন নেই বলে বলা হয়, যা সঠিক নয়। তবে প্রযুক্তিগত ইনোভেশন হয়তো কম, কিন্তু বছরের প্রথম দিনে বই পৌছে যাচ্ছে। এটাও একটা ইনোভেশন। তবে এখানে প্রযুক্তির ব্যবহার করে করা গেলে আরও সহজ হবে। সরকারের দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি খাতেরও এক্ষত্রে অবদান রাখতে হবে। তিনি এসময় শিক্ষা বিস্তারে মূলধারার সঙ্গে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান। এ জন্য প্রতিনিয়ত আপডেট সায়েন্টিফিক ডেটা সংগ্রহের কথা জানান।
হুয়াওয়ের দক্ষিণ এশিয়ার ক্লাউড সল্যুশনের পরিচালক এস এম জুবায়ের আল মাসুদ বলেন, শিক্ষার্থীরা এখন অনেকটাই জেনে বুঝে আসছেন। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন এখন স্কিললড শিক্ষা। তিনি শিক্ষারক্ষেত্রে শহরের মতো গ্রামের শিক্ষার্থীদের সমান সুবিধা দিতে নেটওয়ার্কিং সিস্টেমকে আরও জোরালো করার কথা বলেন। সে সঙ্গে ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার বাড়ানো, ভালো মানের কনটেন্ট তৈরির ওপর জোর দেন।
টেন মিনিট স্কুলের সহপ্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লাহ আবইয়াদ বলেন, টেনমিনিট স্কুল সবসময় স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলে। একটা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে টেন মিনিট স্কুল দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়। এটা কীভাবে আরও উন্নত করা যায় তা নিয়ে কাজ চলছে। এক্ষেত্রে এআই ব্যবহার করার প্রবণতা বাড়াতে হবে।
দ্য রোল অব রিয়েল এস্টেট
স্মার্ট বাংলাদেশ সামিট ও এক্সপোতে শেষ সেশন অনুষ্ঠিত হয় বিকালে। সেশনে আলোচনা হয় টেকসই রিয়েল এস্টেট নিয়ে। সেশনটি সঞ্চালনা করেন বিল্ডিং টেকনোলজি ও আইডিয়ার নির্বাহী পরিচালক (ব্র্যান্ড) আয়েশা সিদ্দিকা।
আলোচক ছিলেন অনন্ত রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট তামান্না রাব্বানি, র্যাংগস প্রোপার্টিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশিদ রহমান, বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ আর খান এবং বিল্ডিং ফর ফিউচারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীরুল হক প্রবাল।
এফ আর খান বলেন, সাধারণভাবে যে ইট তৈরি হয় সেটি করতে হয় জমির উপরিভাগের মাটি থেকে। মূলত কৃষিজমি থেকে তৈরি করা হয় ইট। যা পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আমরা বিষয়টি অনেক আগেই বুঝেছি। ফলে গত পাঁচ বছর থেকে আমরা এখন আর সেসব ইট ব্যবহার করি না। এখন আমরা বালি ও কনক্রিটের তৈরি ইট ব্যবহার করি। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকায় মাটি পোড়ানো ইট ব্যবহার কমে বন্ধ করা হবে।
মাশিদ রহমান বলেন, র্যাংগস সবসময় কাজ করে টেকসই ও ইকোফ্রেন্ডলি বিল্ডিং নিয়ে কাজ করে। সেই সঙ্গে তারা পাশের ভবনের চেয়ে অন্তত কয়েক ডিগ্রি কম তাপমাত্রাার ভবন তারা তৈরি করেন। ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যসম্মত ভবন তৈরি করতে সরকারের নীতিমালার পাশাপাশি প্রত্যেক ভবনে সোল্যার প্যানেলের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার কথা বলেন।
অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যে আয়মান সাদিক
দিনের পাঁচটি সেশন শেষে অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দেন টেন মিনিট স্কুলের সহপ্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক। এ সময় তিনি নিজেদের দক্ষতা উন্নয়ন করতে তরুণদের আহ্বান জানান। তরুণ এই উদ্যোক্তা ও জনপ্রিয় স্পিকার আয়মান অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার দক্ষতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি তরুণদের যোগাযোগ দক্ষতা তৈরির ওপর জোর দিতে বলেন। যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারলে যে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া সহজ হয়।
রিফুয়েল সেশনে সোলায়মান সুখন
মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে জনপ্রিয় ও পরিচিত মুখ সোলায়মান সুখন কয়েক মিনিটের জন্য রিফুলেয় সেশন নেন। এ সময় তিনি নতুন বিশ্বব্যবস্থায় নিজেদের দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি নতুনের সঙ্গে খাপখাইয়ে নেওয়ার বিষয়ে কথা বলেন। তিনি সক্ষমতা উন্নয়নে তরুণদের নতুন নতুন প্রযুক্তি শেখার ওপর জোর দিতে বলেন তিনি।
চরকি অন্তর্জাল টিম
অ্যাকশন থ্রিলার মুভি অন্তর্জালের প্রমোশন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন চরকির টিম। অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা সাহা মিম ও অভিনেতা ইনাম সিনেমাটি নিয়ে কথা বলেন এ সময়। চরকির টিম এ সময় সাইবার ওয়ার্ল্ড নিয়ে নির্মিত সিনেমা অন্তর্জাল দেখার আমন্ত্রণ জানান। অভিনেত্রী মিম এ সময় সিনেমার তার চরিত্র ও কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেন।
বিশ্বব্যাপী তরুণদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জেসিআই বাংলাদেশ এর আয়োজনে ও এটুআই’র সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয় ‘জেসিআই স্মার্ট বাংলাদেশ সামিট, এক্সপো ও সিওয়াইই অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’। সহযোগিতায় বেসিস, বিজিএমইএ, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ডেইলি স্টার, এটুআই, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, আইসিটি বিভাগ এবং ইউএনডিপি। ইভেন্ট পার্টনার বাক্কো, আইএসপিএবি ও ই-ক্যাব।