স্মার্ট কৃষি এবং বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইওটি প্রয়োগে সাফল্য
কৃষিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব তথা ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে বেশ আগেই। এসব প্রযুক্তিগত সুফল সম্প্রতি কৃষিতে জাগরণ সৃষ্টি করেছে। ধীরে ধীরে এটি আরও বিস্তৃত হচ্ছে। বর্তমানে বহু অনলাইন পরিষেবা বাড়ছে। এসবের প্রভাবে কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। অনেক তরুণ শিক্ষিত যুবকরাও যুক্ত হয়েছে আধুনিক কৃষির সঙ্গে উদ্যোক্তা হয়ে। আর তাই ডিজিটাল কৃষির বাস্তবায়নে ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের লক্ষ্য পূরণে অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) সেন্সর ও ক্লাউড বেজড অটোমেটেড এগ্রিকালচারাল সিস্টেম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরকৃবি) বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রুত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আইওটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার অন্যতম ভিত্তি স্মার্ট কৃষির বাস্তবায়ন শুরু হওয়া ব্যাপারটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। ইউনাইটেড নেশনস’র ডিজিটাল স্প্রিংস প্রোজেক্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার নগর, গ্রাম ও কৃষিতে প্রযুক্তি অবলম্বন করে স্মার্ট সেবাগুলো প্রদানের লক্ষ্য সেট করেছে। এটি মূলত জনগণের জীবনযাত্রার উন্নতিতে একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করতে উদ্যোগ নেয়।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার অন্যতম ভিত্তি স্মার্ট কৃষির বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় আইওটি সেন্সর ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরকৃবি) এই এগ্রিকালচারাল গ্রোথ মনিটরিং সম্পর্কিত নতুন উদ্ভাবন কৃষি সেক্টরে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে মানুষের পক্ষে কাজ করা অনেক জটিল ও সময় সাপেক্ষ বিষয়গুলো মাঠের তথ্য নিয়ে কাজ করে ফসল ব্যবস্থাপনাকে অনেক সহজ করে দেবে। এই তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষকরা উন্নত পরিচর্যা প্রদান করতে সক্ষম হবে এবং উন্নত উৎপাদনত্ব সহায়ক তথ্য পাবে।
যেমন: স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনায় মাটির তথ্য তথা মাটির আদ্রতা, তাপমাত্রা, পিএইচ লেভেল, ইসি, পুষ্টিগুণ (নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম, ফসফরাস) পরিমাপ ও বিশ্লেষনের মাধ্যমে ফসলের স্বাস্থ্য নির্ণয় পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। ব্যবহৃত সেন্সরের মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির তথ্য সংগ্রহ করে উন্নত কৃষি প্রযুক্তি সাহায্যে মাটির থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, উপযুক্ত পুষ্টি প্রদান করার জন্য পরামর্শ প্রদান করা সম্ভব হবে যাতে উচ্চ ফলনশীল উৎপাদন সম্ভব হবে।
আইওটি সেন্সর এবং স্মার্ট সেন্সরবেজড ক্যামেরা ব্যবহার করে এটি ভূমি-সম্পর্কিত তথ্য ব্যবহারের মাধ্যমে স্মার্ট পানি ব্যবস্থাপনা সিস্টেম ব্যবহার করে কৃষকরা সঠিক সময়ে প্রয়োজন অনুসারে পানি প্রবাহন এবং ব্যবস্থাপনা করতে সক্ষম হবে, যা প্রথাগত ম্যানুয়াল সিস্টেমকে স্বয়ংক্রিয় করবে। এসব ব্যবস্থায় কৃষকরা তাদের খামারের প্রক্রিয়াগুলো নিরীক্ষণ করতে এবং দূর থেকে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
স্মার্ট কৃষির এই উদ্ভাবন জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সী (জাইকা) বাংলাদেশ অফিসের চীফ রিপ্রেজেন্টেটিভ ইচিগুচি তমোহিদ এর নেতৃত্বে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল গত ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি) পরিদর্শন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. গিয়াসউদ্দীন মিয়া প্রতিনিধি দলকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি বিভাগে চলমান আইওটি প্রয়োগের মাধ্যমে স্মার্ট কৃষির বাস্তবায়ন শীর্ষক প্রকল্পসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সমূহ পরিদর্শন করেন।
এ সময় উক্ত উদ্ভাবন তথা গৃহিত গবেষনা প্রকল্পের টেকনিক্যাল কার্যক্রম ও ফাংশন ব্যাখ্যা করেন গবেষকদলের মূখ্য গবেষক কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি বিভাগের প্রধান ড. গনেশ চন্দ্র সাহা অংকন। প্রতিনিধি দল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত এ গবেষণা উদ্ভাবনে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের আশ্বাস প্রদান করেন।
ড. গনেশ চন্দ্র সাহা অংকন বলেন, ‘বর্তমানে আমি এবং বশেমুরকৃবি একাডেমিয়া, ইন্ডাস্ট্রি ও সরকারের মধ্যে সক্রিয় যোগসূত্র স্থাপন করার মাধ্যমে স্মার্ট কৃষির স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির একটি শক্তিশালী অংশ হিসেবে আইওটি বিভিন্ন সেক্টরে ব্যবহৃত হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প ইত্যাদি সেক্টরে আইওটি একে অপরের সঙ্গে সংযোগ করে সুস্থ এবং স্মার্ট সমাজ তৈরি করতে সাহায্য করে। কৃষি সেক্টরেও আইওটি ব্যবহার একটি আদর্শ উদাহরণ।
এই সেক্টরে, আইওটি সেন্সর ও ডিভাইস ব্যবহার করে কৃষকদের সঙ্গে কৃষি প্রক্রিয়াগুলো সহায়ক তথ্য সরবরাহ করে। এটি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয়, যেমন মাটির প্রস্তুতির জন্য সেন্সর, আবহাওয়া পূর্বানুমান এবং বৃষ্টির পরিমাণের উপর ভিত্তি করে সি ভিটার কন্ট্রোল, পুরোনো প্রযুক্তিগত উপকরণ এবং কীটপত্তি নিয়ন্ত্রণের জন্য স্মার্ট উপায়ে সেবা প্রদান করা’।
তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউজিসি’র অর্থায়নে এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর স্মার্ট ভিলেজ অ্যান্ড স্মার্ট সিটি স্টাডিজ এর কারিগরি সহায়তায় এই প্রকল্প তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর কৃষির একটি সফল উদাহরণ। এটি ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়া গবেষণা সহযোগিতা, কৃষিতে নতুন স্টার্টআপ দক্ষ মানব সম্পদ ও উদ্ভাবনী জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
কৃষি সেক্টর উন্নত করার সঙ্গে সঙ্গে দেশের আরও বিভিন্ন সেক্টর উন্নত হচ্ছে, যা একটি সমৃদ্ধ এবং সাশ্রয়ী সমাজ তৈরি করতে সাহায্য করছে। সফলতার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এখন একটি মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত কৃষিপ্রধান দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে চেষ্টা করছে জোর গতিতে। কৃষিপ্রধান চীন এখন কৃষি প্রযুক্তিতে পরিপূর্ণ। আমরাও এগোতে শুরু করেছি একটু একটু করে। বহুমুখী কৃষিপণ্য উৎপাদন ও কৃষির সাফল্যের জন্য বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ একটি রোল মডেল। উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্যময় কৃষিপণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের জন্য একটি হাব হয়ে উঠতে পারে। এর জন্য দরকার স্মার্ট কৃষির সফল বাস্তবায়ন।
উল্লেখ্য ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্য দিনবদলের উপাখ্যান ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন উপস্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সেই স্বপ্ন এখন আর স্বপ্ন নয়, দেশের সব মানুষের কাছে ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে। ইন্টারনেট পৌঁছেছে সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি ইউনিয়নে। বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১২ কোটি।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়েছে, প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। প্রত্যেকের হাতে এখন অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন, এ সময়ে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে চার গুণের বেশি। দুনিয়ার সব প্রান্তের খবর মুহূর্তেই এসে যাচ্ছে হাতের মুঠোয়। শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাইলফলকে বাংলাদেশ; নতুন আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছে দেশ।
গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, বৈদ্যুতিক অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে গ্রামীণ ও কৃষি অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান। কৃষি উৎপাদনে বেড়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার। বর্তমান অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় বাংলাদেশকে সুখী, সমৃদ্ধ, সোনার বাংলা করতে হলে, প্রয়োজন শস্যের গুণগত মান এবং পরিমাণ বৃদ্ধি করা এবং ব্যবহৃত কৃষি-শ্রমিককে প্রশিক্ষিত করে চতুর্থ শিল্প প্রযুক্তির ব্যবহার সহজ প্রাপ্য করা। বর্তমান বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের মত আইওটি প্রয়োগ করে তাবৎ কৃষি তথ্য-উপাত্তের মানোন্নয়ন এবং একটি সম্পূর্ণ স্মার্ট কৃষিব্যবস্থা (স্মার্ট ফার্মিংয়ের) প্রবর্তনের মাধ্যমে যা অর্জন করা সম্ভব।
লেখক: ড. গনেশ চন্দ্র সাহা অংকন, বিভাগীয় প্রধান কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি) এবং গবেষকদলের মূখ্য গবেষক।