স্বাক্ষাতকার

সেমিকন্ডাক্টরে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে পিছিয়ে আমরা: এনায়েতুর রহমান

ভূঁইয়া মোহাম্মদ ইমরাদ: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যুগে ভবিষতের প্রযুক্তিগত চাহিদা পুরণের তাগিদেই বাড়ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। তবুও সেমিকন্ডাক্টরে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে পিছিয়ে আমরা-এমনটাই জানান বাংলাদেশের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের পথিকৃৎ উল্কাসেমি এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ এনায়েতুর রহমান।

মোটাদাগে দুইটি কারণকে চিহ্নিত করেন এনায়েতুর রহমান। একদিকে, সেমিকন্ডাক্টর নির্ভর কারিক্যুলাম ও শিক্ষক সংকট। অপরদিকে, সেমিকন্ডাক্টর সংক্রান্ত জ্ঞানের অপ্রতুলতা। এমনটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হওয়ায়, সারা পৃথিবীতে সেমিকন্ডাক্টরে দক্ষ জনশক্তির অনেক চাহিদা”।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-র বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। এর মধ্যে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি শিক্ষায় পড়ছে মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৪৪ শতাংশ। এদিকে বুয়েট, রুয়েট, কুয়েট, চুয়েট এর পাশাপাশি ১৭টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে দেশে, যেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৫৭ হাজারের বেশি। এ ছাড়া রয়েছে ৬টি বিশেষায়িত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) কোর্স রয়েছে। ইইই কর্মক্ষেত্র অনেক বড়। তবে ইইই’তে গ্রাজুয়েট করা শিক্ষার্থীদের সেমিকন্ডাক্টরের পরিবর্তে পাওয়ার সেক্টরে যাওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই ‘ভেরি-লার্জ-স্কেল ইন্টিগ্রেশন’ (ভিএলএসআই) সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার বা ট্যুল। এদিকে কারিক্যুলামে ভিএলএসআই সংক্রান্ত কোর্স না থাকার পাশাপাশি রয়েছে শিক্ষক সংকটও। অর্থাৎ সব দিক থেকে শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহের খাতায় নাম লিখিয়েছে সম্ভাবনাময় এই খাতটি।

সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে উল্কাসেমি’র পদক্ষেপ নিয়ে জানতে চাইলে এনায়েতুর রহমান জানান, “এই পর্যন্ত সাড়ে চারশ দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করেছে উল্কাসেমি। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এই সংখ্যা অনেক কম। তাই শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনবলে রুপান্তরের জন্য উল্কাসেমি বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং। এই পর্যন্ত বুয়েট, রুয়েট, শাবিপ্রবি, হাবিপ্রবি, ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বরিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ কয়েকটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে উল্কাসেমি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষণের হার বৃদ্ধিতে নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।”

তিনি আরও জানান, “২০২২ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের ভিএলএসআই নিয়ে পড়াশোনায় উৎসাহ জোগাতে দেশে ভিএলএসআইথন প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে উল্কাসেমি এবং যার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বাংলাদেশে। গত বছর ডিসস্বের মাসে অনুষ্ঠিত ‘ভিএলএসআইথন ২.০’তে দেশের শীর্ষস্থানীয় ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৩৫ জন তরুণ প্রতিযোগীদের ৮২টি দল এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। রেজিস্টার ট্রান্সফার লেভেল (আরটিএল) ডিজাইন এবং অ্যানালগ ডিজাইন-এই দুটি ক্যাটাগরিতে অংশগ্রহণ করেন প্রতিযোগীরা। চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রতিটি ক্যাটাগরি থেকে তিনটি টিম চ্যাম্পিয়ন, প্রথম রানার আপ এবং দ্বিতীয় রানার আপ হিসেবে পুরস্কৃত হন।”

অনেকেই ভেবে থাকেন, সেমিকন্ডাক্টরে কেবল ইইই’র শিক্ষার্থীরাই ভালো করতে পারে। এই ধারণা সঠিক নয় এমনটি মনে করেন এনায়েতুর রহমান। তিনি বলেন, “কেবল ইইই নয়, সিএসই, এপ্লায়েড ফিজিক্স, ফিজিক্স এর শিক্ষার্থীরাও ভালো করতে পারবে সেমিকন্ডাক্টর চীপ ডিজাইনে। কেবল থাকতে হবে পরিশ্রম করার অদম্য মনোবল এবং উদ্ভবনী চিন্তাশক্তি। অনেক ক্ষেত্রে ভিএলএসআই কেন্দ্রিক কারিক্যুলাম না থাকায় ঝামেলায় পরেন শিক্ষার্থীরা। তাদের কথা বিবেচনা করে পড়াশোনার সুবিধার্থে উল্কাসেমি শুরু করেছে উল্কা ভ্লগ। সেখানে ইন্ডাস্ট্রিতে নির্দিষ্ট ডিপার্টমেন্টের কাজের ধরণ এবং এই কাজের জন্য কী কী বিষয়ে পড়াশোনা করা দরকার এসব ধারনা পাবে শিক্ষার্থীরা।”

তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঘুরে ঘুরে নানা সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও ক্যাম্পেইন করে সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে উল্কাসেমি। এই ধরণের সেমিনার ওয়ার্কশপ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভিএলএসআই নিয়ে আগ্রহ বাড়াতে সাহায্য করছে। এখন অনেকেই অনুধাবন করছে যে, সেমিকন্ডাক্টর শেখা দরকার এবং এই বিষয়ে খুবই বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দরকার। বর্তমানে কেবল ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরের ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের সেমিনার ওয়ার্কশপের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।

অনেকের ধারণা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাড়াচ্ছে বেকারত্ব। আসলে তা একেবারেই নয়-এমনটাই মনে করেন এনায়েতুর রহমান। যারা পরিশ্রম করে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছেন, তারাই নেতৃত্ব দিবেন আগামীতে। তাই শুধু গতানুগতিক শিক্ষা নিলেই হবে না, নিজেকে গড়ে তুলতে হবে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *