রোলার কোস্টারে ই-বাণিজ্য: করের চাপে লক্ষাধিক অনিবন্ধিত উদ্যোক্তা
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতটি বর্তমানে শক্তিশালী আর্থিক প্রবৃদ্ধি এবং গভীর আস্থাহীনতার এক অদ্ভুত দ্বিমুখী বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একসময়কার ভুয়া অফার ও বড় প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের ধাক্কা সামলে যখন ডিজিটাল লেনদেনে প্রায় ৬৪ শতাংশের এক শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, তখনই এই খাতের মূল চালিকাশক্তি, অর্থাৎ লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ভ্যাট ও পুঁজির অভাবে টিকে থাকার কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত।
ডিজিটাল রুপান্তরের অর্থনীতির অন্যতম এই ইঞ্জিনটি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে। একদিকে যেমন শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কাঠামো দিয়ে ক্রেতার আস্থা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তেমনই অন্যদিকে লজিস্টিকসের দুর্বলতা, অতিরিক্ত করের বোঝা এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের অভাব একটি পূর্ণাঙ্গ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল ইকোসিস্টেম তৈরির পথে বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
অর্থনৈতিক চালচিত্র: ৬৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ও এফ-কমার্সের মূল শক্তি
ই-কমার্স লেনদেনে এক বছরের ব্যবধানে ৬৪ শতাংশের এক নজিরবিহীন বৃদ্ধি দেখা দিয়েছে, যা খাতটির স্থিতিশীলতা এবং ক্রেতার বর্ধিত ডিজিটাল লেনদেনের অভ্যাসকে প্রমাণ করে। এই প্রবৃদ্ধির কারণে বর্তমানে বাজারের আকার প্রায় ৯১,২৬০ কোটি টাকা ছুঁয়েছে। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এই শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি প্রমাণ করে যে আস্থা পুনরুদ্ধার হয়েছে এবং ডিজিটাল অর্থনীতি গতিশীলতা ফিরে পেয়েছে।
এসএমই ও এফ-কমার্সের বিপুল অবদান
ই-কমার্স খাতে মোট প্রতিষ্ঠানের ৯০ শতাংশেরও বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা নির্ভর। প্রায় ৩ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষেরও বেশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, যার ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ নারী ফেসবুক কমার্স ব্যবহার করে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট ই-কমার্স বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ আসে এই ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো থেকে, যার বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই অনানুষ্ঠানিক খাতটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে।
লক্ষাধিক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার টিকে থাকার সংগ্রাম ও চ্যালেঞ্জ
এই বিপুল সংখ্যক এফ-কমার্স উদ্যোক্তার জন্য সবচেয়ে বড় বাধাগুলো হলো-
উচ্চ ভ্যাট ও করের বোঝা: পণ্য বিক্রির কমিশনের ওপর ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করায় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মুনাফার মার্জিন মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়েছে।
পুঁজি ও অর্থায়ন সংকট: ব্যাংক ঋণ বা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগের সহজলভ্যতা নেই। প্রাথমিক পুঁজি কম থাকায় প্রায় ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ নতুন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রথম দুই বছরের মধ্যে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারেন না।
লজিস্টিকস দুর্বলতা: লজিস্টিকস অবকাঠামো দুর্বল এবং ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ক্যাশ অন ডেলিভারি নির্ভরতা বিক্রেতাদের ওপর বিপুল আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে।
ক্রেতার আস্থাহীনতা: ইভ্যালির মতো ঘটনার ধাক্কায় ক্রেতাদের আস্থাহীনতা এখনও একটি ঝুঁকি।
ডিবিআইডি/ইউবিআইডি: নিয়ন্ত্রণের পথে সহজীকরণের প্রস্তাবনা
ই-কমার্স খাতে শৃঙ্খলা আনতে ডিজিটাল বিজনেস আইডেনটিটি (ডিবিআইডি) বা ইউনিক বিজনেস আইডেনফিকেশন নম্বর (ইউবিআইডি) নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয়া হলেও, লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জন্য এটি যেন নতুন আমলাতান্ত্রিক বোঝা না হয়, সে বিষয়ে নিম্নোক্ত প্রস্তাবনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ-
অটো-জেনারেটেড ডিবিআইডি: উদ্যোক্তা তার জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর দিলেই টিআইএন-এর মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডিবিআইডি পেয়ে যাবেন। এটি প্রক্রিয়াটিকে জটিলতার হাত থেকে রক্ষা করবে।
প্রণোদনা হিসেবে ব্যবহার: প্রথম বছরে প্রণোদনার মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ডিবিআইডি-এর অন্তর্ভুক্ত করা হলে, পরবর্তী বছর থেকে তদারকি ও ডেটা সংগ্রহ কার্যকর হবে।
ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট ব্যবহার: মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস এবং এসক্রো ডেটা ব্যবহার করে উদ্যোক্তাদের একটি বিশ্বাসযোগ্যতা স্কোর তৈরি করা যেতে পারে। এই স্কোর অনুযায়ী তাদের আর্থিক প্রণোদনা বা ঋণ সুবিধা দেয়া যেতে পারে।
ওয়ান-স্টপ সেবা: সরকারের উচিত সহজ প্রক্রিয়ায় কম নথিপত্র এবং নামমাত্র ফি-এর বিনিময়ে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা।
মতামত: ডিবিআইডি/ইউবিআইডি-এর মতো কঠোর ব্যবস্থার চেয়ে সহযোগিতা ও প্রণোদনার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ উদ্যোক্তাকে আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির আওতায় আনতে উৎসাহিত করা জরুরি।
নীতিগত পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ গতিপথ
ই-কমার্স খাতের স্থিতিশীলতার জন্য সরকারের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য-
আস্থা পুনরুদ্ধার: বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেতাদের অর্থ সুরক্ষার জন্য এসক্রো সার্ভিস বাধ্যতামূলক করেছে, যা প্রতারণা কমাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে।
ভ্যাট পুনর্বিবেচনা: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ওপর চাপানো ১৫ শতাংশ ভ্যাট হার পুনর্বিবেচনা করার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশনা দিয়েছে।
নতুন আইন: এফ-কমার্স উদ্যোক্তাদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য একটি এসএমই ডিজিটাল কমার্স অ্যাক্ট প্রণয়নের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
ক্রস-বর্ডার কমার্স: নারী উদ্যোক্তাদের তৈরি দেশীয় পণ্য রপ্তানি বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়েতে সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার নীতিগত সহায়তা দিতে পারে।
এসএমই উদ্যোক্তাদের পণ্যের চাহিদা ও বাজারের বিভাজন
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মোট অনলাইন টার্নওভারের (৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ই-কমার্স বাজার) সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে কয়েকটি ক্যাটাগরি-
ফ্যাশন ও পোশাক: এটি সবচেয়ে বড় খাত, যা মোট টার্নওভারের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে (দেশীয় বুটিক আইটেম ও জুয়েলারি)।
হস্তশিল্প ও ঐতিহ্যবাহী পণ্য: এই উপ-খাতটির অংশীদারিত্ব প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ (আঞ্চলিক খাদ্যপণ্য, নকশিকাঁথা)।
খাদ্য ও মুদি পণ্য: প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ টার্নওভার আসে হোম-মেড ফুড ডেলিভারি ও রেডি-টু-ইট আইটেম থেকে।
প্রসাধনী ও বিউটি প্রোডাক্ট: এই খাতটি প্রায় ১০ থেকে ১২ শতাংশ বাজারের অংশ (অর্গানিক ও হার্বাল বিউটি প্রোডাক্ট)।
অতিরিক্ত সাজেশন: ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা কেন্দ্রিক টেকসই উন্নয়নের রোডম্যাপ
স্তরভিত্তিক ভ্যাট কাঠামো: বার্ষিক ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভারের জন্য শূন্য ভ্যাট বা সর্বোচ্চ ২ শতাংশ টার্নওভার ট্যাক্স চালু করা এবং এই নীতিটি যেন কমপক্ষে ৫ বছরের জন্য স্থিতিশীল থাকে।
পুঁজি সহজীকরণ: ডিজিটাল লেনদেনের ভিত্তিতে জামানতবিহীন ঋণের জন্য ডিজিটাল ক্রেডিট স্কোরিং পদ্ধতি তৈরি করা।
বাজারজাতকরণে এআই প্রশিক্ষণ: ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ডিজিটাল মার্কেটিং ও ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট উন্নত করার জন্য বাংলা ভাষায় এআই-চালিত টুলস এবং প্রশিক্ষণ চালু করা।
লজিস্টিকস ও অবকাঠামো সংস্কার: গ্রামীণ এলাকায় ডেলিভারি চার্জ কমানোর জন্য সরকার কুরিয়ার কোম্পানিগুলোকে সীমিত সময়ের জন্য ভর্তুকি প্রদান করতে পারে।
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতটি ৬৪ শতাংশ বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখালেও, এর ভিত্তি অর্থাৎ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা নীতিগত এবং পরিচালনগত চ্যালেঞ্জের মুখে। এই প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে হলে অবশ্যই তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। উচ্চ ভ্যাট হার কমিয়ে নীতিগত নমনীয়তা আনা, জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করা এবং ডিবিআইডি-এর মতো প্রক্রিয়াকে স্বয়ংক্রিয় ও প্রণোদনামূলক উপায়ে কার্যকর করা জরুরি। ডিজিটাল রুপান্তর ভিশন পূরণের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর (এআই ও ব্লকচেইন) সমাধান, সহজ অর্থায়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করাই হবে দেশের ডিজিটাল অর্থনীতিকে বৈশ্বিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ।





