প্রতিবেদন

রোবট বানিয়ে স্বর্ণপদক নিয়ে এলো বাংলাদেশি তরুণীরা

ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড সায়েন্স, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিযোগিতা-২০২৪’ (ডব্লিউএসইইসি) এ প্রযুক্তি বিভাগে ‘প্রহরী’ নামে বিশেষ ধরনের রোবট তৈরি করে স্বর্ণপদক জিতেছে বাংলাদেশি নারীদের রোবটিক্স দল কোড ব্ল্যাক। ডব্লিউএসইইসি’তে বিশেষত গণিত, শক্তি এবং প্রকৌশল, পদার্থবিদ্যা, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগে প্রতিযোগিতা হয়। এতে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়ে থাকেন।

গত ১৯ মে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় অনুষ্ঠিত ‘ডব্লিউএসইইসি-২০২৪’ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণ করে নারীদের একটি রোবটিক্স দল কোড ব্ল্যাক। কোড ব্ল্যাক’র সদস্য পাঁচজন এবং দলনেতা হলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস ফাবিন। দলের ম্যানেজার নুসরাত জাহান সিনহা। প্রজেক্ট ম্যানেজার তাহিয়া রহমান। সানিয়া ইসলাম সারা (সফটওয়্যার) ও নুসরাত জাহান নওরিন (হার্ডওয়্যার) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজে পড়াশোনা করছেন। মেন্টর হিসেবে রয়েছেন টিম অ্যাটলাস’র সানি জুবায়ের।

‘ডব্লিউএসইইসি-২০২৪’ প্রতিযোগিতায় সরাসরি অংশগ্রহণ করেন জান্নাতুল ফেরদৌস ফাবিন, সানিয়া ইসলাম সারা ও নুসরাত জাহান নওরিন। তাহিয়া রহমান ও নুসরাত জাহান সিনহা ভার্চুয়্যালি অংশগ্রহণ করেন। দেশের রোবটিক্স দল টিম অ্যাটলাস’র সানি জুবায়েরের হাত ধরে ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কোড ব্ল্যাক।

ইন্দোনেশিয়ান ইয়াং সায়েন্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইওয়াইএসএ) ‘ডব্লিউএসইইসি-২০২৪’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। জাকার্তার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, থাইল্যান্ড, মেক্সিকো, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের ১৮টি দেশ থেকে ৩১০টি দল এতে অংশ নেয়। প্রতিযোগিতার বাছাই পর্বে কোড ব্ল্যাকের সদস্যরা তাদের প্রকল্পের বিষয়ে বিভিন্ন আইডিয়া ও রোবটের কনফিগারেশনের বিষয়ে তথ্য তুলে ধরেন। এই পর্বে নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের জাকার্তায় গত ১৩ থেকে ১৭ মে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।

বাবা-মায়েদের মধ্যে একটি সাধারণ ইচ্ছা থাকে যে তাদের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে, আর মেয়ে ডাক্তার। আমরা সেই গতানুগতিক চিন্তাধারা ভাঙতে চাই।

জান্নাতুল ফেরদৌস ফাবিন

জান্নাতুল ফেরদৌস ফাবিন বলেন, “উদ্দেশ্য ছিল নারী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ ও নিবেদিত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যাতে তারা রোবোটিক্স এবং স্টেমের (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত বিষয়) অন্যান্য ক্ষেত্রে অনুশীলন করতে পারেন। মেয়েরা প্রায়ই তাদের পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে প্রশ্নের সম্মুখীন হয় এবং স্টেমের এসব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়। এসব প্রকল্পের জন্য সাধারণত রাতভর দলগত কাজের প্রয়োজন হয়। কিন্তু মেয়েদের সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকতে দেয়া হয় না। তাই আমরা মেয়েদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম গঠনের কথা ভাবি।”

নুসরাত জাহান সিনহা বলেন, “সমস্ত বাধা অতিক্রম করে স্টেমের ক্ষেত্রগুলোতে নারীদের অগ্রগতিকে উৎসাহিত করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আমরা নিয়মিত কর্মশালা ও ইভেন্টের আয়োজন করি যাতে আমাদের সদস্যদের বাস্তব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শেখাতে পারি। এর মাধ্যমে তাদেরকে প্রযুক্তি, রোবোটিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এবং আইওটি-তে সক্রিয় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে পারি।”

তাহিয়া রহমান বলেন, “এটি আমার প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ছিল। প্রত্যাশা কম ছিল। কিন্তু আমরা এখানে সবকিছু অর্জন করেছি। যখন আমি স্বর্ণপদক ঘোষণার সময় আমাদের দলের নাম দেখলাম, তখনকার অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনার অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ।”

প্রজেক্ট প্রহরী
প্রহরী একটি উদ্ধারকারী রোবট, যা দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া, অনুসন্ধান ও উদ্ধার কাজের জন্য তৈরি করা হয়েছে। রোবটটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অগ্নি নির্বাপণ। অত্যাধুনিক ইমেজ প্রসেসিং এবং এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) সাহায্যে এটি বাস্তব সময়ে ভিজ্যুয়াল ডেটা বিশ্লেষণ, বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ ও বিপজ্জনক অবস্থার মূল্যায়ন করতে পারে। এটি বৈরী পরিবেশে নির্ভুলভাবে চলাচল করতে পারে।

রোবটটি জীবিতদের শনাক্ত করতে, বিপজ্জনক অবস্থার মূল্যায়ন করতে এবং দক্ষতার সঙ্গে বৈরী পরিবেশে চলাচলের জন্য বিভিন্ন সেন্সর ব্যবহার করে। এ ছাড়াও এটি উদ্ধার অভিযানের সময় অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। পল্লীকবি জসিমউদ্দিনের নকশী কাঁথার মাঠ বই থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে রোবটটি তৈরি করা হয়েছে।

‘প্রহরী’ নামে রোবট তৈরি করে স্বর্ণপদক জিতেছে বাংলাদেশি নারীদের রোবটিক্স দল কোড ব্ল্যাক

এ বিষয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস ফাবিন বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আরও বেশি ঘটছে। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড সবচেয়ে সাম্প্রতিক ও গুরুতর উদাহরণ। একজন অগ্নি নির্বাপণকর্মীকে বাইরের দিক থেকে আগুন নেভানো শুরু করতে হয়। তিনি আগুনের মধ্যে ঢুকতে পারেন না, কিন্তু আমাদের রোবট ‘প্রহরী’ সেটি পারে। এটি আগুনের মধ্যে ঢুকে যতটা সম্ভব ধোঁয়া শোষণ করে এবং প্রথমে আগুনের উৎস বন্ধ করার চেষ্টা করে।”

রোবটটির দেহের বাইরের অংশ এর বাইরের শরীর অ্যালুমিনিয়ামের সংমিশ্রণ দিয়ে তৈরি। এটি ১২৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা সহ্য করতে সক্ষম। চারপাশের সর্বশেষ অবস্থা জানার জন্য এটির সঙ্গে ৩৬০ ডিগ্রি কোণে ঘুরতে পারে এমন একটি ক্যামেরা যুক্ত করা হয়েছে। এর আল্ট্রাসনিক সেন্সর সামনে কোনো বাধা থাকলে সেটিও শনাক্ত করতে পারে। এটি টানা আট ঘণ্টা কাজ করতে পারে।

কোড ব্ল্যাক
দেশজুড়ে কোড ব্ল্যাকের ৫০ জনেরও বেশি সাধারণ সদস্য রয়েছেন। তারা প্রতিটি বড় ইভেন্টের আগে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে পৃথক একটি দল গঠন করেন। তাদের সদস্যদের বিভিন্ন রোবোটিক্স ও প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এর আগে ২০২২ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স অ্যান্ড ইনোভেশন ফেস্টে স্বর্ণপদক জিতেছে তারা।

আর ২০২২ ও ২০১৯ সালে ওয়ার্ল্ড রোবট অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়ে জিতেছে ব্রোঞ্জ পদক। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার পাশাপাশি দলটি কৃষিকাজে প্রযুক্তির অগ্রগতি নিয়ে কাজ করছে। তাদের গবেষণাগার রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীতে।

পল্লীকবি জসিমউদ্দিনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ বই থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে রোবটটি তৈরি করা হয়েছে

কোড ব্ল্যাক-প্রহরী

কোড ব্ল্যাক প্রসঙ্গে জান্নাতুল ফেরদৌস ফাবিন বলেন, “নারী দল হওয়ার সুবিধা ও অসুবিধাগুলোতে কিছুটা মিল আছে। সুবিধাটি হলো আমরা গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মেয়েরা আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমরা প্রায়ই সামাজিক মাধ্যমে নেতিবাচক ও ঘৃণামূলক মন্তব্যের সম্মুখীন হই, হয়তো শুধু মেয়েদের দল হওয়ার কারণে। শুরুতে এটি আমাদের খুব হতাশ করেছিল। কিন্তু এখন আমরা সেগুলো উপেক্ষা করতে শিখেছি। বাংলাদেশি বাবা-মায়েদের মধ্যে একটি সাধারণ ইচ্ছা থাকে যে তাদের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে, আর মেয়ে ডাক্তার। আমরা সেই গতানুগতিক চিন্তাধারা ভাঙতে চাই। আমরা চাই তারা বিশ্বাস করুক আর স্বপ্ন দেখুক যে তাদের মেয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বড় জয় অর্জন করবে। কারণ, তারা (নারী) সত্যিই তা পারে।”

২০১৯ সালে প্রহরীর আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু হয়। সময়ে সময়ে এর সঙ্গে নতুন নতুন ফিচার যুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে এটি প্রহরীর চতুর্থ সংস্করণ এবং এটি সম্পন্ন করতে দুই মাস লেগেছে। এই প্রকল্পের জন্য ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক সমর্থন দিয়েছে। রোবটটি তৈরি করতে পাঁচ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। খরচের একটি অংশ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। পাওয়ার স্পন্সর ও কিছু ভোগ্যপণ্য দিয়ে সহায়তা করেছে আরএফএল।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *