প্রতিবেদন

যন্ত্রের সঙ্গে কথোপকথন

হাফিজ আকবর আহমেদ: মানুষের হাত ছাড়াই রাস্তায় ছুটে চলা ‘চালক ছাড়া গাড়ি’ আর ভবিষ্যতের কোনও প্রযুক্তি নয়, এটি এখন বাস্তব। উন্নত সেন্সর, উচ্চক্ষমতার প্রসেসর, ক্যামেরা, রাডার-লিডার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সমন্বয়ে তৈরি এই গাড়ি নিজের চারপাশ বুঝতে পারে, রাস্তার নিয়ম জানে, বাধা এড়ায় এমনকি মুহূর্তে সিদ্ধান্তও নিতে পারে। যেন যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের কথোপকথনেরই এক নতুন রূপ। চালক ছাড়া গাড়ির প্রযুক্তিকে সাধারণভাবে বলা হয় অটোনোমাস ভেহিকল সিস্টেম (এভিএস) বা সেলফ-ড্রাইভিং কার। এটি মূলত মানুষের চোখ, কান ও মস্তিষ্কের কাজগুলো প্রযুক্তিগতভাবে পুনর্নির্মাণ করে।

সেন্সর, ক্যামেরা, রাডার ও লিডারের সমন্বয়ে পরিবেশ পর্যবেক্ষণ
চালক ছাড়া গাড়ির কার্যপ্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল এটির সেন্সর নেটওয়ার্ক। একটি উন্নত অটোনোমাস গাড়িতে থাকে
লিডার: হাজার হাজার লেজার রশ্মি চারদিকে ছুড়ে থ্রিডি মানচিত্র তৈরি করে। রাস্তার বাধা কোথায়, কত দূরে সব নির্ভুলভাবে নির্ণয় করে। অন্ধকার বা জটিল এলাকায়ও কাজ করে।
রাডার: দূরের জিনিস শনাক্ত করতে সক্ষম। বৃষ্টি, কুয়াশা, ধুলার সময়েও গাড়িকে তথ্য দেয়। সামনে থাকা গাড়ির গতি, দূরত্ব ও দিক বুঝে।
হাই-রেজ্যুলেশন ক্যামেরা: রাস্তার লেন, ট্রাফিক সিগন্যাল, সাইনবোর্ড, জেব্রা ক্রসিং শনাক্ত করে। পথচারী, সাইকেল, মোটরবাইক ও অন্যান্য যানবাহন পৃথক করতে পারে।
আল্ট্রাসনিক সেন্সর: ৩–৮ মিটারের মধ্যে নিকটবর্তী বাধা শনাক্ত করে। পার্কিং বা লো-স্পিড ড্রাইভিংয়ে বিশেষভাবে কার্যকর। এই সব সেন্সরের তথ্য একত্র হয়ে গাড়িকে নির্ভুলভাবে তার চারপাশ দেখতে সাহায্য করে।

সংগৃহীত ডেটার বিশ্লেষণ: গাড়ির মস্তিষ্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ
সেন্সরগুলোর বিশাল তথ্য একত্র হয় গাড়ির কম্পিউটিং ইউনিটে, যাকে বলা হয় এআই ড্রাইভ কমপিউটার। এখানে বস্তু শনাক্তকরণ, গতি ও দূরত্ব বিশ্লেষণ, রাস্তার অবস্থা বোঝা, সম্ভাব্য বিপদ অনুমান সব কিছু মিলিসেকেন্ডের মধ্যে ঘটে। এই প্রসেসরগুলোর ক্ষমতা এতই বেশি যে তারা প্রতি মুহূর্তে কয়েক গিগাবাইট ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারে। মানুষ যে পরিমাণ তথ্য ১ মিনিটে বোঝে, এআই তা কয়েক সেকেন্ডেই করে ফেলে।

লোকালাইজেশন: গাড়ি নিজের অবস্থান কোথায় বুঝে
মানুষ রাস্তা চিনতে পারে, মোড় দেখে সিদ্ধান্ত নেয়। গাড়িকে সেটিই শেখানো হয়েছে। কীভাবে লোকালাইজেশন হয়- উচ্চমানের জিপিএস সিগন্যাল, এইচডি ম্যাপ, লিডার ও রাডারের ডেটা, ক্যামেরার দৃশ্যমান তথ্য এই চারটি মিলিয়ে গাড়ি নির্ধারণ করে সে রাস্তার কোন লেনে আছে, কোন মোড় কাছাকাছি এবং গন্তব্যের পথে সে ঠিক কোথায়। একটি চালক ছাড়া গাড়ির লোকালাইজেশন ভুল হলে এটি চলতেই পারবে না। তাই প্রতিটি সেকেন্ডে তার অবস্থান আপডেট হয়।

পাথ প্ল্যানিং: কোন পথে যাবে, কোথায় থামবে সব সিদ্ধান্ত এআই নেয়
এটিকে বলা হয় পাথ প্ল্যানিং বা রুট প্ল্যানিং অ্যালগরিদম। এখানে এআই ঠিক করে- কখন লেন পরিবর্তন করবে, কোন গতিতে চলবে, সামনের গাড়ি ব্রেক করলে কী করবে, পথচারী রাস্তা পার হলে কি থামবে, বৃষ্টি বা কুয়াশায় গতিবিধি ধীর করবে কিনা। অ্যালগরিদম মানুষের মতোই আচরণ করে, তবে আরও বেশি নিরাপদভাবে। মানুষের মতো ক্লান্তি, ভুল বা মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সমস্যা নেই।

কন্ট্রোল সিস্টেম: গাড়িকে চালানোর বাস্তব কাজ
সিদ্ধান্ত নেয়ার পরে গাড়ির কন্ট্রোল সিস্টেম কার্যকর হয়। এটি স্টিয়ারিং ঘোরায়, ব্রেক দেয়, অ্যাক্সিলারেশন বাড়ায়, ক্লান্তিহীনভাবে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয় সবকিছু সম্পূর্ণ অটোমেটেড।

মেশিন লার্নিং: অভিজ্ঞতা থেকে নিজের দক্ষতা বাড়ানো
চালক ছাড়া গাড়ি যত বেশি রাস্তায় চলে, তত বেশি তথ্য সংগ্রহ করে। এই তথ্য দিয়ে এআই নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিবেশ শনাক্তকরণ, বিপদ অনুমান, ড্রাইভিং স্টাইল আরও নিখুঁত করে তোলে। এটিকে বলা হয় ধারাবাহিক শেখা।

চালক ছাড়া গাড়ির ভবিষ্যৎ: আমাদের জীবন কতটা বদলে দেবে?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাস্তায় দুর্ঘটনা কমবে, মানুষের যাতায়াত আরও আরামদায়ক হবে, দ্রুত ও স্মার্ট পরিবহন ব্যবস্থা তৈরি হবে এবং ড্রাইভিং-এর ঝুঁকি ও ক্লান্তি অনেক কমে যাবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ইতিমধ্যে টেস্ট রান শুরু হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যবহারও দ্রুত বাড়ছে। প্রযুক্তির নতুন যুগে মানুষের সহচর চালক ছাড়া গাড়ি।

এক সময় যন্ত্রের সঙ্গে কথোপকথন ছিল কল্পনা, আজ তা বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেন্সর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উচ্চক্ষমতার কম্পিউটিং ও স্মার্ট সফটওয়্যার প্রযুক্তির মিশেলে চালক ছাড়া গাড়ি এখন নিজেই ‘দেখে, বোঝে ও সিদ্ধান্ত নেয়’। মানুষের চালানো গাড়িতে যেমন অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ, এখানেও তেমনি এআই প্রতিনিয়ত শিখছে, উন্নত হচ্ছে এবং আরও নিখুঁত হয়ে ওঠছে। এটাই ভবিষ্যতের পরিবহন আর এই পথেই এগিয়ে চলছে বিশ্ব।

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *