ভূমিকম্প! মাটি থমকে নেই, আমাদের প্রস্তুতিই প্রশ্নবিদ্ধ
এইচ এম ইমাম হাসান: বাংলাদেশে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে একের পর এক ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে অন্তত পাঁচটি কম্পন। ক্ষয়ক্ষতি বড় না হলেও এই ঘনঘন কম্পন স্বস্তির নয়; বরং আমাদের সামনে এক গভীর বাস্তবতা স্পষ্ট করে দিয়েছে। বাংলাদেশ বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে আছে এবং এই ঝুঁকির বিপরীতে আমাদের প্রস্তুতি মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়।
ভারতীয়, ইউরেশীয় ও বার্মা টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থানকারী বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। ১৮৯৭ সালের বিধ্বংসী আসাম ভূমিকম্প এবং ১৯৫০ সালের তিব্বত-আসাম ভূকম্পন এই অঞ্চলের ইতিহাসে গুরুতর স্মৃতি হয়ে আছে। তবুও বারবার সতর্কতা সত্ত্বেও আমাদের নগরায়ণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন নিরাপত্তার ন্যূনতম মানগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ মহানগর একটি বড় ভূমিকম্পের জন্য বিপজ্জনকভাবে অপ্রস্তুত।
সাম্প্রতিক কম্পনগুলো দেখিয়ে দিয়েছে আমরা কতটা ভঙ্গুর। ভূমিকম্প-সহনশীল নয় এমন ভবন, নজরদারিহীন নির্মাণ, সংকীর্ণ সিঁড়ি, জটলা-ভরা গলি, দুর্বল অবকাঠামো সব মিলিয়ে লাখো মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার কাছে বা ঢাকার ভেতরে কোনও বড় ভূমিকম্প হলে হাইতির ২০১০ সালের বিপর্যয়ের তুলনায়ও বড় মানবিক ট্র্যাজেডি ঘটতে পারে।
আমি সাংবাদিকতা ও জনসংযোগ উভয় ক্ষেত্রেই কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, ভূমিকম্পের পর অনেক সময় ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে বড় সমস্যা তৈরি করে ভুল তথ্য, আতঙ্ক এবং যোগাযোগের ব্যর্থতা। কম্পন হঠাৎ আসে এটাই তার স্বভাব। কিন্তু বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় তথ্য বিভ্রাটের কারণে। আজ যখন দেশের মানুষ খবরের জন্য টেলিভিশন বা রেডিওর আগে সামাজিক মাধ্যমে ছুটে যায়, তখন ডিজিটাল স্পেসটি আমাদের দুর্বলতার পাশাপাশি বড় সম্ভাবনাও তৈরি করে। সাম্প্রতিক কম্পনগুলোর পর ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়া গুজব, বিদেশি ভিডিওর পুনঃপ্রচার এবং ভয় সৃষ্টিকারী ভবিষ্যদ্বাণী পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
এই কারণেই জরুরি সময়ে সঠিক বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে পেশাদারভাবে ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। সরকারি সংস্থা, বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমকে সমন্বিতভাবে দ্রুত, স্পষ্ট ও নির্ভরযোগ্য বার্তা প্রচার করতে হবে। এসএমএস অ্যালার্ট থেকে শুরু করে লাইভ আপডেট সবই। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। জাপান, তুরকি ও ইন্দোনেশিয়ার উদাহরণ দেখায় সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য অসংখ্য প্রাণ বাঁচায়।
শুধু তথ্য নয়, অবকাঠামোও এখন বড় প্রশ্ন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বেশিরভাগ ভবনই ভূমিকম্প-সহনশীল নয়। অনেক ভবন নির্মিত হয়েছে পর্যাপ্ত প্রকৌশল তত্ত্বাবধান ছাড়াই, আবার অনেকগুলো বছর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখনই রেট্রোফিটিং (ভবন শক্তিশালীকরণ) শুরু না করলে বড় বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হবে না। বিশেষত স্কুল, হাসপাতাল, কারখানা যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে থাকে এসব স্থাপনায় অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
মানুষের আচরণগত প্রস্তুতিও অতি দুর্বল। সাম্প্রতিক কম্পনের সময় অনেকেই দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমেছেন, কেউ লিফট ব্যবহার করেছেন, কেউ আবার ভবনের সামনে বৈদ্যুতিক তারের নিচে দাঁড়িয়েছেন, যে ভুলগুলো একটি ছোট কম্পনকেও প্রাণঘাতী করতে পারে। তাই ভূমিকম্প সচেতনতা শুধু সেমিনার বা বার্ষিক দিবস নয় এটি হওয়া উচিত নিয়মিত নাগরিক অভ্যাস। অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স সব জায়গায় মহড়া চালু করতে হবে।
বৈজ্ঞানিক সক্ষমতাও বৃদ্ধি করা জরুরি। ভূতত্ত্ব জরিপ অধিদপ্তর, আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং বিশ্ববিদ্যালয়-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিক যন্ত্র, উন্নত ভূকম্পন মানচিত্র এবং ডেটা বিশ্লেষণ সুবিধা দিতে হবে। ভারত-মিয়ানমারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক তথ্য বিনিময় ভূমিকম্প পূর্বাভাস ও ঝুঁকি বিশ্লেষণে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
ডিজিটাল সচেতনতাকে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ১৩ কোটির বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর দেশে অনলাইন সম্প্রদায় সত্য ও গুজব উভয়ই দ্রুত ছড়িয়ে দিতে পারে।
তাই ছোট ভিডিও, ইনফোগ্রাফিক, লাইভ সেশন, আর কমিউনিটি-লেবেলড কনটেন্টের মাধ্যমে স্পষ্ট ও নির্ভুল নির্দেশনা প্রচার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যেমন- ‘ড্রপ, কভার, হোল্ড’, কম্পন থামার পর কীভাবে ভবন পরীক্ষা করতে হবে, কোথায় নিরাপদ সমাবেশস্থল ইত্যাদি। ভূমিকম্প অপ্রত্যাশিত, কিন্তু প্রস্তুতি কখনোই অপ্রত্যাশিত হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশ সাইক্লোন প্রস্তুতিতে যেভাবে বৈপ্লবিক উন্নতি করেছে এবার একই উদ্যমে আমাদের ভূমিকম্প প্রস্তুতিকেও নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে হবে।
সাম্প্রতিক কম্পনগুলো প্রকৃতির সতর্কবার্তা রোষ নয়। এগুলো আমাদের সুযোগ দিচ্ছে সামনে কীভাবে হাঁটব তা ঠিক করে নেয়ার। ভূমিকম্প যে কোনও সময় আসতে পারে কিন্তু আমরা প্রস্তুত কি না, সেটিই আসল প্রশ্ন। প্রস্তুতি শুধু সরকার, বিজ্ঞানী বা প্রকৌশলীর দায়িত্ব নয়। এটি প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টের পরিবার, প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থী, প্রতিটি কারখানার শ্রমিক এবং প্রতিটি হাসপাতালে থাকা রোগীর নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত আমাদের সঠিক সিদ্ধান্ত। মাটি আবার কাঁপবে এটাই বাস্তবতা কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি থেমে থাকা চলবে না।
এইচ এম ইমাম হাসান- ডেপুটি ম্যানেজার (পাবলিক রিলেশনস), বেসিস এবং সাবেক স্টাফ রিপোর্টার, দ্য ডেইলি অবজারভার





