ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বাজারে বৈষম্য দূর করতে নীতিমালা সংশোধনের আহ্বান
ক.বি.ডেস্ক: ট্যারিফ এর নামে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ব্যান্ডউইডথের ক্রয়-বিক্রয় ও রেভিনিউ শেয়ারের বৈষম্য বাতিল করে গ্রাহক পর্যায়ে সুলভে মানসম্মত ইন্টারনেট সেবার পরিবেশ সৃষ্টিতে নীতিমালা সংশোধন এবং এ ক্ষেত্রে রাজস্ব আহরণের চেয়ে বিটিআরসি’কে পুরোপুরি স্বাধীন কমিশন হিসেবে দায়িত্ব পালনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। মুষ্টিমেয় কিংবা গোষ্ঠীগত সুবিধা দেয়ার নীতিমালা সংশোধন না করলে বৈষম্য থেকেই নৈরাজ্যে সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।।
আজ রবিবার (২৭ অক্টোবর) জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত “ব্যান্ডউইডথ ও ইন্টারনেটের বৈষম্যমূলক বাজার ব্যবস্থাপনা নিরসনে করণীয়” শীর্ষক আলোচনা সভায় এমন অভিব্যক্তি তুলে ধরেন বক্তারা।
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বিটিআরসি’র সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের পরিচালক লেফট্যানান্ট কর্নেল রেজাউর রহমান, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস) প্রভাষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, আইএসপিএবি সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া, আইআইজিবি সভাপতি আমিনুল হাকিম, আইআইজিবি যুগ্ম সচিব মক্তবুর রহমান, রবি আজিয়েটার রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার শাহ মো. ফজলে খোদা।
এ সময় আরও বক্তব্য রাখেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির, বেসিস’র সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর, প্রতিযোগিতা কমিশনের সাবেক পরিচালক খালেদ আবু নাসের, প্রযুক্তিবিদ মোস্তফা মোহাম্মাদ হোসেন, আর্থ কমিউনিকেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল হোসেন, বাজার বিশ্লেষক কাজী আব্দুল হান্নান এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। আলোচনার বিষয় উপস্থাপন করেন সংগঠনটির গবেষণা সদস্য মো. রানা ইসলাম।
বাংলাদেশের আইটিসি অপারেট না থাকলে আমি হলফ করে বলতে পারি আগামীকাল থেকে ইন্টারনেটের মূল্য আরও বেড়ে যাবে
আমিনুল হাকিম- সভাপতি আইআইজিবি
রেজাউর রহমান বলেন, “বৈষম্য নিরসনে বিটিআরসি কাজ শুরু করেছে। আমাদের ত্রিমাত্রিক ভাবে কাজ করতে হয়। সরকার, অপারেটর ও গ্রাহক এই তিন মাথাকে সমন্বয় করেই আমরা কাজ করি। সরকারি-বেসরকারি ব্যবসার এপেক্স এবং ক্যাপেক্স এক না থাকায় ব্যান্ডউইডথ মূল্যে ভিন্নতা রয়েছে। আগামীতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্যও ট্যারিফ বেঁধে দেয়া হবে। ব্যান্ডউইডথের মূল্যের ক্ষেত্রে এখন রেট পুণর্বিবেচনার সময় এসেছে। তবে এজন্য সময় লাগবে। কিন্তু কতটা সময় লাগবে তা বলতে পারছি না।”
প্রভাষ চন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, “আমরাও বৈষম্যের শিকার হয়ে আমাদেরকেও আইটিসি থেকে ২ শতাংশ বেশি রেভিনিউ শেয়ার করতে হয়। ব্যান্ডউইডথের মূল্য কমালেও কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আমরা চাই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়।”
নাজমুল করিম ভূঁইয়া বলেন, “ইন্টারনেট এখন মৌলিক অধিকার। কিন্তু সেই ইন্টারনেট নিয়ে কতশত প্রতারণা হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। ১/১১ এর পর আইএসপিকে দুর্বল করে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মোবাইলের জন্য ব্যান্ডউইডথ কেনার ক্ষেত্রে মূল্য ধরে না হলেও আইএসপিকে কিনতে হয় ৩৬৫ টাকায়। অথচ সাবমেরিন ক্যাবল ব্যান্ডউইডথ কিনে এনে ফেলে রেখিছি। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে লাভবান করতে এসব করা হচ্ছে। লাইসেন্স আপগ্রেডেশনের কারণে ১০০ বৈধ আইএসপি অবৈধ হয়ে গেছে। ২৫০০ বিজিপিএস ট্রাফিক রিফিল করতে আমরা বিদেশে টাকা পাচার করছি।”
আমিনুল হাকিম বলেন, “সাধারণত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন একচেটিয়া ব্যবসা করতে না পারে সেজন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানকে সেবায় আনা হয়। আইটিসি কম মূল্যে ইন্টারনেট দেয়ায় সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি মূল্য কমাতে বাধ্য হয়। কিন্তু কোম্পানিটি সরকারি পৃ্ষ্ঠপোষকতায় থেকেও মুনাফার দিকে বেশি মনোযোগী। ফলে তাদের ব্যান্ডউইডথ পড়ে থাকছে। বাংলাদেশের আইটিসি অপারেট না থাকলে আমি হলফ করে বলতে পারি আগামীকাল থেকে ইন্টারনেটের মূল্য আরও বেড়ে যাবে।”
মক্তবুর রহমান বলেন, “বিটিআরসি’র নীতিমালা খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ইন্টারনেট যে নেটওয়ার্ক ইকো সিস্টেম আছে সেখানে মোবাইল অপারেটর ও আইএসপি উভয়েই আইএসপি। এখানে দ্বৈত নীতিমালা আছে। একইভাবে দুই সরকারি প্রতিষ্ঠান যেভাবে রেভিনিউ শেয়ার করে তার সঙ্গে বেসরকারিদের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। বাংলাদেশে ৫০০ টাকায় যে ইন্টারনেট দেয়া হয় এমনটা সারা বিশ্বে পাওয়া যাবে না। কন্টেন্ট বা সিডিএনের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ খরচ হলেও আইএসপি তা বিক্রি করতে পারে না। এই দিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার। কেননা আমাদের বোঝা দরকার ইন্টারনেট কোন পণ্য নয় সেবা। পণ্য কিনে আমরা সেবা মিলি সেকেন্ড হিসেবে সেবা দেই।”
শাহ মো. ফজলে খোদা বলেন, “বোতলজাত পানির মধ্যে শুধু পানি আমাদের কাছে ব্যান্ডউইডথ। এই ব্যান্ডউইডথ যখন ইন্টারনেট হিসেবে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে নানা খরচ রয়েছে। ওভারহেডের ২.৩ শতাংশ হচ্ছে আমাদের ব্যান্ডউইডথ কস্ট। এর ওপর রয়েছে করের বোঝা। গ্রাহকদের কাছে আমরা মাসে ১৪৫ টাকা রেভিনিউ পায়। এটা প্রতিবেশী দেশের চেয়ে কম। তাই এখন ইন্টারনেটের মূল্য কমাতে হলে টিকে থাকাই অসম্ভব। ভ্যালু চেইন রিভিজিট করে এই মূল্যে আরও গ্রাহক বান্ধব হবে।”
আমি তো মনে করি, তারা দেশের পাশাপাশি বিদেশে ব্যবসা করবে। আইটিসি থেকে তাদের মূল্য কেন বেশি হয় তা বোধগম্য নয়
সুমন আহমেদ সাবির- প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ
সুমন আহমেদ সাবির বলেন, “কম মূল্য ও কোয়ালিটি অনুযায়ী প্রত্যেকেরই চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রেভিনিউ শেয়ার সবার জন্য সমান করলে ইন্টারনেটের মূল্য কমবে। সাবমেরিন ক্যাবলের ব্যান্ডউইডথ কেন পড়ে আছে। তাই এর ব্যবহার বাড়াতে মূল্য কমানোর সঙ্গে মান বাড়াতে হবে। আমি তো মনে করি, তারা দেশের পাশাপাশি বিদেশে ব্যবসা করবে। আইটিসি থেকে তাদের মূল্য কেন বেশি হয় তা বোধগম্য নয়। এ ছাড়াও রেগুলেশনের কারণে ৩০ শতাংশ ব্যান্ডউইডথ বাজে খরচ করছি। এক্ষেত্রে অনেকগুলো লেয়ার রয়েছে। এটা কমা দরকার। রেভিনিউ শেয়ার না থাকলে এই খাতে চুরিও কমতো।”
ফাহিম মাশরুর বলেন, “দেশের এক তৃতীয়াংশ লোক নিয়মিত ডিজিটাল সেবা পেলেও এটি প্রতিবেশী দেশের তুলনায় পিছিয়ে। এখানে আমাদের সকলেরই ব্যর্থতা রয়েছে। কেননা এখনো আমাদের মানুষ ইন্টারনেট বলতে ফেসবুক, টিকটক বুঝি। তাই দেশের মানুষের জন্য কন্টেন্ট তৈরি করতে হবে। ডাটা অ্যাভেইলেবল না হলে ইন্টারনেট বাজার বাড়বে না। ইনফো সরকার থ্রি ব্যর্থ হওয়ায় গ্রামেগঞ্জে সুলভ ইন্টারনেট তথা ব্রডব্যান্ড পৌঁছেনি। এর ফলে গ্রাম ও শহরের মানুষের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের বৈষম্য তৈরি হয়েছে। গুগল, ফেসবুক এর জন্য সিডিএন স্থাপনে প্রোটেকশন ওনারশিপ থাকা দরকার। এক দেশ এক রেট ব্রডব্যান্ড-মোবাইল অপারেটর সবার জন্য সমান হওয়া উচিত।”
খালেদ আবু নাসের বলেন, “সাধারণ বাজারের মতো এখানেও একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। নিজেদের আইনের অধীনেই এই অসম প্রতিযোগিতা দূর করতে পারে বিটিআরসি। কেন দূর করছে না, তা আমাদের বোধগম্য নয়।”
মোস্তফা মোহাম্মাদ হোসেন বলেন, “জাতীয় সুরক্ষার অজুহাতে সিডিএন আইএসপিদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়ায় দেশের ইন্টারনেট বাজার ভারসাম্য হারাচ্ছে। বিটিআরসি যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। সিডিএনকে ঠিকমতো চালু করা হলে ইন্টারনেটের খরচ অনেক কমে যাবে।”
ইনফো সরকার থ্রি ব্যর্থ হওয়ায় গ্রামেগঞ্জে সুলভ ইন্টারনেট তথা ব্রডব্যান্ড পৌঁছেনি। এর ফলে গ্রাম ও শহরের মানুষের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের বৈষম্য তৈরি হয়েছে
ফাহিম মাশরুর- সাবেক সভাপতি বেসিস
কামাল হোসেন বলেন, “আমরা সরকারি আইআইজি প্রতিষ্ঠানের কাছে ট্যারিফ নির্ধারণ করে রেভিনিউ শেয়ারে বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। দেশী ব্রডব্যান্ড আইএসপিকে সেবা দিতে গিয়ে নির্দিষ্ট ট্যারিফ মানতে হচ্ছে। কিন্তু এনএস অপারেটরদের জন্য কোনো ট্যারিফ নেই। বিটিআরসি থেকে এক দেশ এক রেট পুরোপুরি মানা হচ্ছে না। ফলে আমাদের বাজার প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছি। তাই এখানে সমন্বয় করে আমাদের স্বাধীন করা হোক।”
কাজী আব্দুল হান্নান বলেন, “রাষ্ট্র রাজস্ব আয়ে হিডেন পলিসি ব্যবহার করে। ফলে সিন্ডিকেট ও মধ্যসত্বভোগী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। সেটি ডিমের বাজারের সঙ্গে ইন্টারনেটের বাজারেও রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র মুখে বললেও এসব জায়গায় কখনোই কিছু করে না। রাজস্ব বোর্ডই মূলত কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ করে।”
আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, “ইতিমধ্যেই আপনাদের দাবিগুলো আমরা উপদেষ্টাকে পাঠিয়েছি। আশা করি, বৈষম্য ঘুচতে ডিজিটাল লুটপাট নিয়ে কী হয়েছে তাও এবার আপনারা তুলে ধরবেন। চেতনা বিক্রি করে যারা ইন্টারনেট তথা ডিজিটাল সেবার বিভিন্ন সূচকে আফগানিস্তান থেকে দেশকে পিছিয়ে রেখেছে তাদের বিষয়ে সোচ্চার থাকবেন।”
মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “অবিলম্বে ইন্টারনেট খাতের বৈষম্য দূর করতে বিটিআরসিকে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দুর্গম এলাকায় মুষ্টিমেয় কিছু মানুষকে ইন্টারনেট দেয়ার নামে এসওএফ ফান্ড থেকে টাকা দিয়ে টাওয়ার নির্মাণ করার চেয়ে গ্রামে-গঞ্জে সুলভ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছানো এবং গ্রাহকদের সচেনতায় এই অর্থ ব্যয় করার দাবি জানাই।”