বিশ্বজুড়ে ক্লাউডফেয়ার বিভ্রাট: ডিজিটাল অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা ও বাংলাদেশের করণীয়
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): সম্প্রতি ইন্টারনেট পরিকাঠামো প্রদানকারী সংস্থা ক্লাউডফেয়ার-এর নেটওয়ার্কে সৃষ্ট একটি বড় ধরনের বিভ্রাট বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ ওয়েবসাইট এবং অনলাইন পরিষেবাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনা ডিজিটাল নির্ভরতার এক নতুন চিত্র তুলে ধরেছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এর তাৎক্ষণিক ও পরোক্ষ প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
বর্তমান বিপর্যয়ের মূল চিত্র
মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর)-এর বিকালে (ইউটিসি সময় অনুযায়ী) এই বিভ্রাট শুরু হয়, যখন ক্লাউডফেয়ারের বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে সমস্যা দেখা দেয়। ক্লাউডফেয়ার বিশ্বের কোটি কোটি ওয়েবসাইটের জন্য কন্টেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক (সিডিএন), ডিএনএস পরিষেবা এবং নিরাপত্তা সুরক্ষা প্রদান করে। ফলস্বরূপ, এই একক ব্যর্থতা বিশ্বজুড়ে একটি ক্যাসকেডিং এফেক্ট সৃষ্টি করে।
ক্লাউডফেয়ারের স্ট্যাটাস পেজ অনুযায়ী, এই সময়ে ব্যাপক হারে “Widespread 500 errors” দেখা যায় এবং তাদের ড্যাশবোর্ড ও এপিআই পরিষেবাগুলোও অচল হয়ে পড়ে। বিভ্রাটের কারণে চ্যাটজিপিটি, এক্স, স্পটিফাই এবং ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ কয়েনবেস সহ হাজার হাজার প্ল্যাটফর্ম সাময়িকভাবে অচল হয়ে যায়।
অর্থনৈতিক তথ্য ও পরিসংখ্যানগত ক্ষতি
এই কয়েক ঘণ্টার বিভ্রাট বৈশ্বিক ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিশাল আকারের ক্ষতি বয়ে আনে। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ও আর্থিক পরিষেবাগুলোর ডাউনটাইমের কারণে মিনিট প্রতি লক্ষ লক্ষ ডলারের লেনদেন এবং বিক্রয় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। উৎপাদনশীলতার ব্যাপক ক্ষতি ঘটে এবং বিভ্রাটের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্লাউডফেয়ারের শেয়ারের মূল্যে পতন দেখা যায় (প্রি-মার্কেট ট্রেডিং-এ শেয়ারের মূল্য ৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়)।
অতীতের নজির: ইন্টারনেটের ভঙ্গুর ইতিহাস
এই বিভ্রাটটি ক্লাউডফেয়ারের নেটওয়ার্কে প্রথমবার নয়। এর আগেও একাধিকবার এই ধরনের বড় ঘটনা ঘটেছে। জুন ২০২২ এর বিভ্রাটে একটি ত্রুটিপূর্ণ নেটওয়ার্ক কনফিগারেশন পরিবর্তনের কারণে ক্লাউডফেয়ারের নেটওয়ার্কের একটি ছোট অংশ বন্ধ হয়ে যায়, যা বৈশ্বিক অনুরোধের প্রায় ৫০ শতাংশ প্রভাবিত করেছিল। এই ধরনের পুনরাবৃত্ত ঘটনা প্রমাণ করে যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বড় আকারের বিভ্রাটগুলো সাইবার আক্রমণ নয়, বরং অভ্যন্তরীণ কনফিগারেশন ত্রুটি, সফটওয়্যার বাগ বা ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার ফল।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: করণীয় ও স্থানীয় উদ্যোগ
বৈশ্বিক ক্লাউড পরিকাঠামোর এই চরম দুর্বলতা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। এই পরিস্থিতিতে দেশীয় ওয়েবসাইট ও অনলাইন পরিষেবাগুলোর স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে নীতিগতভাবে আমাদের স্থানীয় পরিকাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, “মূল সমাধানটি হলো দেশীয় ডোমেইন এবং হোস্টিং পরিকাঠামোকে উৎসাহিত করা। দেশের সাইবার পরিকাঠামোকে সুরক্ষিত রাখতে হলে এই ধরনের বৈশ্বিক একক নির্ভরতা কমানো অপরিহার্য। ডট বাংলা ও ডট বিডি ডোমেইন ব্যবহারকে উৎসাহিত করা সেই দিকেই একটি প্রথম ও সঠিক পদক্ষেপ।”
ডট বাংলা ও ডট বিডি ডোমেইন ব্যবহারের মাধ্যমে স্থানীয় পরিকাঠামোকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। ক্লাউডফেয়ারের মতো বহুজাতিক সংস্থার সমস্যা ডিএনএস ও নিরাপত্তা নিয়ে হলেও, স্থানীয় ডোমেইন ব্যবহারের প্রবণতা বাড়লে ব্যবহারকারীরা স্থানীয় হোস্টিং এবং ডিএনএস পরিকাঠামো ব্যবহারের দিকেও ঝুঁকবেন। এর ফলস্বরূপ, একটি বিকেন্দ্রীভূত ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠবে, যা কোনও একটি বৈশ্বিক সংস্থার ব্যর্থতায় সম্পূর্ণরূপে অচল হবে না।
এই লক্ষ্যে, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) সম্প্রতি ডট বাংলা ও ডট বিডি ডোমেইনের জন্য রিসেলার নিয়োগ দেয়া শুরু করেছে। রিসেলাররা যাতে ডিসকাউন্টেড প্রাইসে এই ডোমেইনগুলো বিক্রি করতে পারে, সে বিষয়ে বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয়ভাবে ডোমেইন ব্যবহারকে আরও জনপ্রিয় করতে ডট বাংলা ও ডট বিডি-এর বেজ প্রাইস কমানোর বিষয়েও বিটিসিএল চিন্তাভাবনা করছে।
এই উদ্যোগগুলি স্থানীয় ডিজিটাল অর্থনীতিকে মজবুত করবে এবং বৈশ্বিক বিভ্রাটের প্রভাব থেকে বাংলাদেশের অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে আংশিকভাবে হলেও সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করবে।





