প্রতিবেদন

বিটিসিএল-এর চ্যালেঞ্জিং ট্রিপল-কোয়াড প্লে: সেবার সমন্বয়ে বিপ্লবের সম্ভাবনা

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): একবিংশ শতকের ডিজিটাল দুনিয়ায় নাগরিক জীবনে সংযোগের অর্থ কেবল ফোন বা ইন্টারনেট নয়, এটি এখন বিনোদন, শিক্ষা ও ব্যবসার একটি সমন্বিত প্যাকেজ। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ঠিক এই লক্ষ্যেই হাত বাড়িয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি দেশে প্রথমবারের মতো মোবাইল ভার্চ্যুয়াল নেটওয়ার্ক অপারেটর (এমভিএনও), ট্রিপল প্লে ও কোয়াড প্লে’র মতো বহুমুখী সেবা চালুর যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে এক বিপ্লবী পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব এর ঘোষণা অনুযায়ী, এই প্যাকেজগুলোর মাধ্যমে এক সংযোগের অধীনেই গ্রাহকরা পাবেন মোবাইলে ভয়েস, ডেটা, উচ্চগতির ইন্টারনেট এবং স্ট্রিমিং সেবা।

তবে এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে নীতিমালা, সক্ষমতা, গ্রাহকসেবার দুর্বলতা এবং তীব্র বাজার প্রতিযোগিতা- এই চারটি প্রধান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বিটিসিএলকে।

বিটিসিএল’র সমন্বিত সেবার নকশা ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
এই উদ্যোগ মূলত উন্নত বিশ্বের টেলিকম মডেল দ্বারা অনুপ্রাণিত। কোয়াড প্লে (Quad Play) মডেল হলো চারটি প্রধান সেবার সমন্বয়- মোবাইল সিম, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, ল্যান্ডফোন/আইপি ফোন এবং আইপিটিভি/ওটিটি। বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে ইউরোপীয় বাজারে, টেলিকম কোম্পানিগুলো এই সমন্বিত প্যাকেজগুলোর মাধ্যমে গ্রাহক ধরে রাখতে এবং গড় রাজস্ব বাড়াতে সফল হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, ইউকে এবং ফ্রান্সের বাজারে এই মডেলগুলো গ্রাহকদের খরচ সাশ্রয়ে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে, চীন টেলিকম এবং দক্ষিণ কোরিয়ার অপারেটররা শুধু ট্রিপল প্লে নয়, বরং ‘স্মার্ট হোম সলিউশন’ (যেমন: সিসিটিভি, এআই ওটিটি) যুক্ত করে কোয়াড প্লে’র ধারণাকে আরও সম্প্রসারিত করেছে, যা বিটিসিএল’র জন্য অনুসরণীয় হতে পারে।

মোবাইল ভার্চ্যুয়াল নেটওয়ার্ক অপারেটর (এমভিএনও) হলো একধরনের মোবাইল অপারেটর, যাদের নিজস্ব কোনও নেটওয়ার্ক অবকাঠামো নেই, বরং তারা অন্যান্য অপারেটরের নেটওয়ার্ক ভাড়া নিয়ে নিজস্ব নামে সিম, ডেটা ও ভয়েস-সুবিধা দিয়ে থাকে। ট্রিপল প্লে বলতে এক সংযোগের মাধ্যমে উচ্চগতির ইন্টারনেট, ভয়েস কল ও ভিডিও স্ট্রিমিং সেবাকে বোঝায়। আর এই তিনটির সঙ্গে মোবাইল সিম কার্ড সেবা যুক্ত হলে, তাকেই কোয়াড প্লে বলা হয়।

বিটিসিএল তাদের এই নতুন প্যাকেজে এমভিএনও সিম, আনলিমিটেড ভয়েস ও ডেটা, এন্টারটেইনমেন্ট ও ডিভাইস এই চারটি প্রধান উপাদান যুক্ত করছে। এমভিএনও মডেল অনুযায়ী, অন্য মোবাইল অপারেটরের কাছ থেকে ব্যান্ডউইডথ লিজ নিয়ে বিটিসিএল ব্র্যান্ডের মোবাইল সিমের মাধ্যমে ভয়েস ও ডেটা সেবা দেয়া হবে। এ ছাড়া, ‘আলাপ’ আইপি ফোন অ্যাপ এবং এমভিএনও সিমের মাধ্যমে শর্তসাপেক্ষে আনলিমিটেড ভয়েস এবং জীপন (জিপন- গিগাবিট প্যাসিভ অপটিক্যাল নেটওয়ার্ক) বা আইএসপি সংযোগের মাধ্যমে আনলিমিটেড ডেটা দেয়া হবে।

বিনোদনের ক্ষেত্রে দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মের (Over-The-Top) বান্ডেল সরবরাহ এবং নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য মাত্র ৫০০ টাকা মাসিক কিস্তিতে স্মার্টফোন হ্যান্ডসেট সরবরাহের উদ্যোগও এই পরিকল্পনার অংশ। সেবা চালুর প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে গত ২৭ আগস্ট বিটিসিএল ও টেলিটকের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ১৫ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে, যাদের মূল লক্ষ্য তিন মাসের মধ্যে পরীক্ষামূলক বান্ডল সেবা চালু করা।

অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও প্রতিযোগিতার বাস্তবতা
এই উদ্যোগ সফল হলে ডিজিটাল বৈষম্য হ্রাসে সরাসরি ভূমিকা রেখে ডিজিটাল রুপান্তর গড়ার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পদক্ষেপ হতে পারে। তবে, রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক সক্ষমতা এবং গ্রাহকসেবার মান নিয়ে খাত সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন রয়েছে।

বিটিসিএল–এর সর্বশেষ প্রকাশিত পরিচালকমণ্ডলীর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে কোম্পানিটি প্রায় ৬৭ কোটি টাকা মুনাফা করলেও তা মূলত অ-পরিচালন আয় (যেমন: ব্যাংকের স্থায়ী আমানত) থেকে এসেছে, সরাসরি গ্রাহকসেবা থেকে নয়। বছরের পর বছর সরকারের কাছে বকেয়া পাওনা পরিশোধ না করার ইতিহাস এবং সেবার মানের দুর্বলতা প্রমাণ করে যে, নতুন করে বিপুল বিনিয়োগ করার আগে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকসেবাকেন্দ্রিক ব্যবসায়িক মনোভাবে পরিবর্তন আনাটা জরুরি। বাংলাদেশের টেলিকম বাজার অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক, যেখানে লাভজনক অবস্থায় আছে মাত্র দুটি বেসরকারি অপারেটর।

এ প্রসঙ্গে প্রযুক্তি নীতিমালা পরামর্শক আবু নাজম মো. তানভীর হোসেন বলেন, যেখানে টেলিটকসহ সব মোবাইল অপারেটরের সেবার সক্ষমতা গ্রাহক চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল এবং অ্যাকটিভ শেয়ারিং নীতি কার্যকর হচ্ছে না, সেখানে এমভিএনও এর সম্ভাবনা আশাব্যঞ্জক নয়। ট্রিপল প্লে ও কোয়াড প্লে’র মতো সেবা মোবাইল অপারেটররা ইতোমধ্যে বিভিন্ন বান্ডল অফারের মাধ্যমে দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বিষয়টা যদি নিছক প্যাকেজিংয়ের পার্থক্য হয়, তবে বিটিসিএল আলাদা করে এমভিএনও চালু না করেও টেলিটকের সেবা চুক্তির মাধ্যমে প্যাকেজ করে দিতে পারে।

খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এমভিএনওর মতো সেবা চালু করতে গেলে বিটিসিএলকে বেসরকারি মোবাইল অপারেটরদের মতো মার্কেটিং, ব্র্যান্ডিং, সেলস এবং সর্বোপরি, গ্রাহকসেবার মতো বিষয়গুলোতে দক্ষতা বাড়াতে হবে। কিন্তু বর্তমানে সরকারি কোম্পানিগুলোর সেবার মান নিয়ে গ্রাহকদের নানা অভিযোগ বিদ্যমান।

নীতি ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ: নিয়ন্ত্রক সংস্থার বক্তব্য
বিটিসিএল তার শক্তিশালী ফাইবার অপটিক ব্যাকবোন এবং বিদ্যমান জীপন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে লক্ষাধিক গ্রাহককে সেবা দেয়ার সক্ষমতা রাখলেও, এই বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে কয়েকটি মৌলিক নীতিগত বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে।

প্রথমত, এই সেবা চালুর জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা বা গাইডলাইন এখনও তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) প্রণীত ‘টেলিকমিউনিকেশনস নেটওয়ার্ক অ্যান্ড লাইসেন্সিং পলিসি–২০২৫’-এর গেজেটে এমভিএনও লাইসেন্সের কথা বলা হলেও, বিটিআরসি’ চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী স্পষ্ট করেছেন যে, এমভিএনও এর জন্য আলাদা নির্দেশিকা হবে এবং ট্রিপল প্লে সেবায় যেহেতু টিভি/ওটিটির বিষয় জড়িত, তাই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়েরও একটি বড় বিষয় আছে, যা বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন।

দ্বিতীয়ত, বিপুল বিনিয়োগের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। বিটিসিএল এমভিএনও সেবা কত টাকায় কিনবে, আর তা কত টাকায় গ্রাহকের কাছে বিক্রি করবে, সেসব ঠিক করতে হবে। কারণ, কোনও পক্ষই নিজেদের ক্ষতি চাইবে না এবং গ্রাহকের ওপরও বাড়তি চাপ দেয়া যাবে না। টেলিযোগাযোগ নামেই অধিদপ্তর হলেও বাস্তবে ‘ঢাল-তলোয়ারহীন’ সরকারি কোম্পানিগুলোর বকেয়া পরিশোধ না করে নতুন বিনিয়োগ করার আগে গ্রাহক সেবাকেন্দ্রিক ব্যবসায়িক মনোভাব আনা বেশি জরুরি বলে প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা মনে করেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সাইবার নিরাপত্তা ও ডেটা সার্বভৌমত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিটিসিএল-এর ওপর দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল ডেটা সুরক্ষার গুরুদায়িত্ব বর্তায়। এই বৃহৎ সমন্বিত নেটওয়ার্ক সিস্টেমে যেকোনও ধরনের সাইবার হামলা বা ডেটা লঙ্ঘনের ঘটনা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। গ্রাহকদের আস্থা অর্জনের জন্য বিটিসিএলকে নিশ্চিত করতে হবে যে ডেটা সুরক্ষায় তারা আন্তর্জাতিক মানের প্রোটোকল অনুসরণ করছে।

বিটিসিএল এর এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ, যা ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তিতে গতি আনবে। তবে, এই সুবিধা চালুর বিষয়টি নির্ভর করে বাজারের আকার, বাস্তবতাসহ বিভিন্ন নির্ণায়কের ওপর। বেসরকারি মোবাইল অপারেটর সূত্রগুলোও নির্দেশিকার অভাবে এমভিএনওর জন্য আগ্রহ দেখালেও সাড়া দিতে পারছে না। বিটিসিএলকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে গ্রাহকদের জন্য এমভিএনও সেবা ন্যায্য মূল্যে কেনা ও বিক্রি করা হচ্ছে, যেন গ্রাহকের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে। সরকারের নীতি প্রণয়নকারী সংস্থাগুলোর দ্রুত সমন্বয় ও নির্দেশিকা প্রণয়ন, বিটিসিএলের আর্থিক ও সক্ষমতাগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং সর্বোপরি, গ্রাহকসেবাকেন্দ্রিক ব্যবসায়িক মনোভাব গ্রহণ- এই বিষয়গুলোর ওপরই নির্ভর করছে এই উদ্ভাবনী পদক্ষেপের চূড়ান্ত সফলতা।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *