বাজেটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট: ই-কমার্স খাতে উদ্যোক্তা এবং ভোক্তার ওপর এর প্রভাব পড়বে

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অনলাইনে পণ্য বিক্রয় কমিশনের ওপর ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই ভ্যাট (ভ্যালু এডেড ট্যাক্স) দেশের ই-কমার্স, ডিজিটাল কমার্স, অনলাইনে পণ্য বিক্রয়, এসএমই ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের এবং সার্বিকভাবে ভোক্তাদের ওপর এর প্রভাব পড়বে। এবারের বাজেটে প্রস্তাবনাগুলো অনলাইনে পণ্য বিক্রি বা ই-কমার্স খাতের জন্য কিছু সমস্যা ও নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনতে পারে। বিশেষ করে যখন দেশের তরুণ উদ্যোক্তা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১১৩। এর (গ) অনুযায়ী “অনলাইনে পণ্য বিক্রয় কমিশনের ওপর ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে”। এটি ই-কমার্স খাত এবং এর সঙ্গে জড়িত সকল অংশীজনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পরিবর্তন। এর অর্থ হলো- ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো (যেমন- দারাজ, ফুডপান্ডা বা অন্যান্য মার্কেটপ্লেস হিসেবে প্ল্যাটফর্মগুলো বা ছোট ফেসবুকভিত্তিক শপ যারা কোনো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কমিশন দেয়) বিক্রেতাদের কাছ থেকে যে কমিশন বা সার্ভিস চার্জ নেয়, তার ওপর এখন থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। আগে এই হার ছিল ৫ শতাংশ। অর্থাৎ, কমিশনের ওপর ভ্যাট তিনগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উদাহরণস্বরুপ
যদি একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম কোনও পণ্যের বিক্রিমূল্যের ১০% কমিশন হিসেবে নেয়:
আগে (৫% ভ্যাট): ১০০ টাকার পণ্যে ১০ টাকা কমিশন। এই ১০ টাকার ওপর ৫% ভ্যাট = ০.৫০ টাকা।
এখন (১৫% ভ্যাট): ১০০ টাকার পণ্যে ১০ টাকা কমিশন। এই ১০ টাকার ওপর ১৫% ভ্যাট = ১.৫০ টাকা।
এই পরিবর্তনের ফলে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যয় বাড়বে এবং তারা এই অতিরিক্ত ভ্যাটের বোঝা বিক্রেতা বা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপর চাপাতে পারে, যা অনলাইন কেনাকাটা এবং ই-কমার্স ব্যবসার সামগ্রিক কাঠামোতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
এ ছাড়াও প্রস্তাবিত বাজেটের ৫০, ৭২, ৭৩, ৭৪, ৯০ এবং ১০৮ এ উদ্যোক্তা এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু পজিটিভ কথাও বলা হয়েছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ১৫ হাজার নতুন উদ্যোক্তা তৈরি এবং ২৫ হাজার উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের কথা বলা হয়েছে, নারী উদ্যোক্তাদের প্রান্তিক পর্যায়ে সিএমএসএমই খাতের ১০ হাজার উদ্যোক্তাকে ১০০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ১২৫ কোটি টাকার তহবিল এবং স্টার্টআপের জন্য ১০০ কোটি টাকার আলাদা তহবিল গঠনের কথা বলা হয়েছে।
ই-কমার্স খাতের সম্ভাব্য সমস্যা ও নেতিবাচক প্রভাব
ভ্যাট বৃদ্ধি এবং ব্যয় বৃদ্ধি: অনলাইনে পণ্য বিক্রয় কমিশনের ওপর ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে উন্নীত করা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং বিক্রেতা উভয়ের জন্য একটি বড় বোঝা। প্ল্যাটফর্মগুলো হয় এই অতিরিক্ত খরচ বিক্রেতাদের ওপর চাপাবে, নয়তো নিজেদের মুনাফা কমিয়ে দেবে। উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবসার কার্যকারিতা প্রভাবিত হবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর চাপ: ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) এবং নারী উদ্যোক্তারা যারা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তাদের পণ্য বিক্রি করেন, তারা এই বর্ধিত ভ্যাটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ, তাদের মুনাফার মার্জিন সাধারণত কম থাকে এবং অতিরিক্ত ভ্যাট তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমিয়ে দেবে। এটি নতুন উদ্যোক্তা তৈরি এবং তাদের টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
স্টার্ট-আপ এবং নতুন উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিতকরণ: যেখানে সরকার তরুণ উদ্যোক্তা এবং স্টার্ট-আপদের জন্য তহবিল ঘোষণা করছে, সেখানে কমিশনের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধি নতুন অনলাইন ব্যবসা শুরু করার আগ্রহকে নিরুৎসাহিত করতে পারে। স্টার্ট-আপগুলো সাধারণত প্রথম দিকে লাভের মুখ দেখে না এবং অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা তাদের টিকে থাকাকে কঠিন করে তুলবে।
অনলাইন ব্যবসার ব্যয় বৃদ্ধি: অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পণ্য বিক্রি করা ব্যয়বহুল হয়ে ওঠবে। এর ফলে অনেক ক্ষুদ্র বিক্রেতা অনলাইন থেকে সরে এসে আবার ঐতিহ্যবাহী অফলাইন ব্যবসার দিকে ঝুঁকতে পারেন, যা ডিজিটাল রুপান্তরের অগ্রযাত্রাকে কিছুটা ব্যাহত করবে।
পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও ভোক্তার ওপর প্রভাব: বিক্রেতারা অতিরিক্ত ভ্যাটের বোঝা গ্রাহকদের ওপর চাপাতে বাধ্য হতে পারেন, যার ফলে অনলাইনে পণ্যের মূল্য বাড়বে। এটি ভোক্তাদের জন্য অনলাইন কেনাকাটাকে কম আকর্ষণীয় করে তুলবে এবং সামগ্রিকভাবে ই-কমার্স বাজারের প্রবৃদ্ধি হ্রাস করতে পারে।
কর অব্যাহতির যৌক্তিকীকরণ: কিছু নির্দিষ্ট খাতে কর অব্যাহতির মেয়াদ বৃদ্ধি না করা এবং হ্রাসকৃত কর হার বাতিল করা হলে, ই-কমার্স সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যবসা যদি সেই খাতের আওতাভুক্ত হয়, তাহলে তাদেরও করের বোঝা বাড়বে। যদিও প্রান্তিক খামারি ও উদ্যোক্তাদের ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত রাখা হয়েছে, কিন্তু এর বেশি আয়কারী উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারা?
ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম- যারা কমিশনের ওপর ভ্যাট দেবেন, তাদের লাভের অংশ কমবে অথবা তাদের অপারেটিং ব্যয় বাড়বে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি অনলাইন বিক্রেতা- তাদের পণ্য বিক্রির খরচ বাড়বে, যা মুনাফার মার্জিন কমাবে এবং টিকে থাকা কঠিন করবে। নারী উদ্যোক্তা- যারা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সক্রিয়, তাদের জন্য ব্যবসা পরিচালনা আরও চ্যালেঞ্জিং হবে। স্টার্ট-আপ ই-কমার্স ব্যবসা- প্রাথমিক পর্যায়ে বিনিয়োগ এবং ব্যয় বেশি থাকায় এই অতিরিক্ত ভ্যাট তাদের জন্য একটি বড় বাধা এবং ভোক্তারা- বর্ধিত ব্যয়ের বোঝা শেষ পর্যন্ত তাদের ওপরই বর্তাবে, কারণ পণ্যের মূল্য বাড়তে পারে।
এ থেকে উত্তরণের উপায় এবং সরকারের সহযোগিতা-
ই-কমার্স খাতের এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে এর ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সরকার ও ই-কমার্স খাতের সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি
ভ্যাট হার পুনর্বিবেচনা বা বিকল্প ব্যবস্থা
ভ্যাট হার কমানো: অনলাইনের পণ্য বিক্রি কমিশনের ওপর ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে পুনরায় ৫ শতাংশ বা তারও কম হারে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত।
ধাপভিত্তিক ভ্যাট: ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বিক্রির পরিমাণ অনুযায়ী বা আয়ের ওপর ভিত্তি করে ধাপে ধাপে ভ্যাট আরোপের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যাতে ছোট উদ্যোক্তাদের ওপর প্রাথমিক চাপ কমে।
নির্দিষ্ট থ্রেশহোল্ড: ক্ষুদ্র অনলাইন বিক্রেতাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট বার্ষিক টার্নওভারের নিচে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়ার ব্যবস্থা করা।
উদ্যোক্তা তহবিল ও প্রশিক্ষণের সঠিক ব্যবহার
স্টার্ট-আপ তহবিল ও যুব উদ্যোক্তা ঋণের সহজলভ্যতা: ১০০ কোটি টাকার স্টার্ট-আপ তহবিল এবং যুব উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণের সিলিং ৫ লাখ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাবনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্য এই তহবিলগুলোকে সহজ শর্তে এবং দ্রুত প্রাপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
দক্ষতা বৃদ্ধি ও কারিগরি প্রশিক্ষণ: ১৫ হাজার নতুন উদ্যোক্তা তৈরি এবং ২৫ হাজার উদ্যোক্তাকে দক্ষতামূলক ও কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানের পরিকল্পনা ই-কমার্স খাতের জন্য বিশেষায়িত হওয়া উচিত। ডিজিটাল মার্কেটিং, ই-কমার্স অপারেশন, লজিস্টিকস এবং কাস্টমার সার্ভিস বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে।
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা: ১২৫ কোটি টাকার তহবিল নারী উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্যবসা পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট সহায়তা ও প্রশিক্ষণে ব্যয় করা উচিত। তাদের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কর্পোরেট ক্রেতাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের যে পরিকল্পনা (৩ হাজার নারী উদ্যোক্তা) আছে, তার দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
অবকাঠামোগত ও নীতিগত সহায়তা
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উন্নয়ন:ই-কমার্স পরিচালনার জন্য ডিজিটাল অবকাঠামোগত উন্নয়ন অব্যাহত রাখা। সিম্পলিফাইড কর ব্যবস্থা: ই-কমার্স খাতের জন্য একটি সহজ, স্বচ্ছ এবং সহায়ক কর ব্যবস্থা তৈরি করা, যা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য জটিলতা কমাবে। লজিস্টিকস উন্নয়ন: ই-কমার্স পণ্য পরিবহনে লজিস্টিকস ব্যয় কমানো এবং ডেলিভারি প্রক্রিয়াকে আরও দক্ষ ও দ্রুত করা। সচেতনতা বৃদ্ধি: ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার প্রদত্ত সুবিধা এবং বিধিমালা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালানো।
আর্থিক ক্ষমতায়ন ও ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন এর মধ্যে সমন্বয়
নীতি সমন্বয়: সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে নীতির সমন্বয় নিশ্চিত করা, যাতে এক খাতে সহায়তা দিতে গিয়ে অন্য খাতে বাধা সৃষ্টি না হয়। যুব উন্নয়ন, এসএমই উন্নয়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রস্তাবিত তহবিলগুলো ই-কমার্স খাতের উন্নয়নে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে পারে।
মনিটরিং ও ফিডব্যাক: বাজেট প্রস্তাবনাগুলোর বাস্তবায়ন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা এবং ই-কমার্স খাতের উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে সরাসরি প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় নীতি পরিবর্তন আনা।
ই-কমার্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি সম্ভাবনাময় খাত। এই খাতের প্রবৃদ্ধি এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে, বর্ধিত ভ্যাট হার পুনর্বিবেচনা এবং সরকারের অন্যান্য সহায়ক প্রস্তাবনাগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব