প্রতিবেদন

বাজেটে ডিজিটাল, ই-কমার্স এবং অনলাইন ব্যবসায় ভ্যাট ও কর প্রস্তাবনা

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): কাল সোমবার (২ জুন) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ডিজিটাল, ই-কমার্স এবং অনলাইন ব্যবসার ওপর বেশ কিছু ভ্যাট ও কর প্রস্তাবনা আসতে যাচ্ছে, যা সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে প্রভাবিত করবে। প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো এর সম্ভাব্য প্রভাব এবং ব্যবসায়ীদের উত্তরণের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো…

১. প্রস্তাবিত ভ্যাট ও কর পরিবর্তনসমূহ
অনলাইনে পণ্য বিক্রয়ের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধি: বর্তমানে অনলাইনে পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ৫% ভ্যাট প্রযোজ্য থাকলেও, প্রস্তাবিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ১৫% করার কথা বলা হচ্ছে। এটি একটি বড় ধরনের পরিবর্তন।
কমিশন ভ্যাট বৃদ্ধি: ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং বিক্রেতারা যে কমিশন আদান-প্রদান করেন, তার ওপর আরোপিত ভ্যাট ৫% থেকে বাড়িয়ে ১৫% করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রযুক্তি পণ্যের ওপর ভ্যাট: কমপিউটার, প্রিন্টার, রাউটার এবং মোবাইল ফোনের মতো প্রযুক্তি পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর চিন্তাভাবনা চলছে। বর্তমানে যেসব পণ্যের ওপর ভ্যাট আছে, তা বাড়িয়ে ১৫% করা হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের স্থানীয় মূল্য সংযোজনের ওপর নির্ভর করে ৫ ও ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়িয়ে ৭.৫ ও ১০ শতাংশ করা হতে পারে।

টার্নওভার করের সীমা বৃদ্ধি: স্বস্তির বিষয় হলো, টার্নওভারের সীমা ৩ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ কোটি টাকা করা হচ্ছে। অর্থাৎ, ৪ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হারে কর প্রযোজ্য হবে, এর বেশি হলে নিয়মিত কর্পোরেট করের আওতায় আসতে হবে।
ন্যূনতম করের বিধান যৌক্তিকীকরণ: লোকসানে থাকা ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর জন্য ন্যূনতম কর Gross Receipts-এর ০.১% করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে।
অফিস এবং গোডাউন ভাড়ায় ভ্যাট অব্যাহতি: অনলাইন পণ্য বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে অফিস এবং গোডাউন ভাড়ার ক্ষেত্রে মূসক অব্যাহতি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

অনলাইন রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক: ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে সব ব্যক্তিগত এবং কোম্পানি করদাতাদের জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়া বাধ্যতামূলক হতে চলেছে।
ইন্টারনেট সার্ভিস ট্যাক্স কমানো: ইন্টারনেট সার্ভিস ট্যাক্স ১০% থেকে কমিয়ে ৫% করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ই-কমার্স ব্যবসার জন্য কিছুটা ইতিবাচক হতে পারে।

২. প্রস্তাবিত পরিবর্তনের প্রভাব
ভোক্তাদের ওপর প্রভাব:
পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি: অনলাইনে কেনা পণ্যের ওপর ১৫% ভ্যাট প্রযোজ্য হওয়ায় পণ্যের চূড়ান্ত মূল্য বাড়বে। এর ফলে ভোক্তাদের কেনাকাটার খরচ বাড়বে এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমতে পারে।
অফলাইন কেনাকাটায় প্রবণতা বৃদ্ধি: অনলাইনে মূল্য বাড়ার কারণে কিছু ক্রেতা আবারও প্রচলিত বা অফলাইন বাজারমুখী হতে পারেন, যা ই-কমার্স খাতের প্রবৃদ্ধি কিছুটা মন্থর করতে পারে।
ডিজিটাল বিভাজন বৃদ্ধি: প্রযুক্তি পণ্যের মূল্য বাড়লে ডিজিটাল সরঞ্জামের সহজলভ্যতা কমতে পারে, যা ডিজিটাল বিভাজন বাড়াতে পারে।

ব্যবসায়ীদের ওপর প্রভাব
পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি: ভ্যাট বৃদ্ধি এবং কমিশন ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং বিক্রেতাদের পরিচালন ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। এটি তাদের লাভের মার্জিন কমিয়ে দেবে।
প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি: দেশীয় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাবে, কারণ ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে তাদের পণ্যের মূল্য আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম বা অবৈধ চ্যানেলের তুলনায় বেশি হয়ে যাবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর চাপ: ছোট ও মাঝারি ই-কমার্স উদ্যোক্তারা, যারা তুলনামূলকভাবে কম লাভ করেন, তাদের জন্য এই ভ্যাট বৃদ্ধি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হতে পারেন।

বিনিয়োগে প্রভাব: নতুন বিনিয়োগকারীরা ডিজিটাল বা ই-কমার্স খাতে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হতে পারেন, কারণ লাভের সম্ভাবনা কমে যাবে।
রাজস্ব আদায়: সরকারের লক্ষ্য রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা। তবে উচ্চ করহারের কারণে যদি অবৈধ লেনদেন বা কর ফাঁকির প্রবণতা বাড়ে, তাহলে সরকারের রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নাও হতে পারে।
কর্মসংস্থানের ওপর প্রভাব: ডিজিটাল খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হতে পারে, যদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালন ব্যয় কমানোর জন্য কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
অন্যান্যদের ওপর প্রভাব (বিশেষ করে সরবরাহ চেইন ও লজিস্টিকস): ই-কমার্স ব্যবসার প্রবৃদ্ধি মন্থর হলে ডেলিভারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে এবং অন্যান্য সাপোর্টিং সার্ভিসের ব্যবসাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

৩. ব্যবসায়ীদের এ থেকে উত্তরণের উপায়: এই পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের টিকে থাকতে এবং প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে
দক্ষ পরিচালন ব্যবস্থা গড়ে তোলা
খরচ কমানো: অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে আনা এবং অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে দক্ষতা বাড়ানো।
সাপ্লাই চেইন অপটিমাইজেশন: সরবরাহকারীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে এবং সাপ্লাই চেইনের খরচ কমিয়ে এনে পণ্যের মূল্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা।
প্রযুক্তির ব্যবহার: স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া ব্যবহার করে ম্যানুয়াল কাজ এবং ত্রুটির হার কমানো।

মূল্য নির্ধারণ কৌশল
লাভের মার্জিন বিশ্লেষণ: পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধির প্রভাব সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে লাভ মার্জিন বজায় রাখার জন্য মূল্য নির্ধারণ করা।
বান্ডেল অফার ও ডিসকাউন্ট: গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন বান্ডেল অফার, লয়্যালটি প্রোগ্রাম এবং সীমিত সময়ের ডিসকাউন্ট চালু করা। এতে গ্রাহকদের ওপর মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব কিছুটা কমানো যেতে পারে।

গ্রাহক সম্পর্ক উন্নয়ন
উন্নত গ্রাহক সেবা: প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য উচ্চমানের গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করা।
বিশ্বাস ও স্বচ্ছতা: ভ্যাটের বিষয়গুলো গ্রাহকদের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা এবং পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখা।

সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ
লবিং ও সুপারিশ: ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক সংগঠনের মাধ্যমে সরকারের কাছে করনীতি পুনর্বিবেচনার জন্য জোরালোভাবে আবেদন করা এবং বাস্তবসম্মত প্রস্তাবনা তুলে ধরা।
নীতির সপক্ষে কাজ: নীতিগত আলোচনার অংশীদার হয়ে ই-কমার্স খাতের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় অংশ নেয়া।

বৈচিত্র্য আনয়ন ও নতুন বাজার অনুসন্ধান
পণ্য ও সেবায় বৈচিত্র্য: শুধু অনলাইন পণ্য বিক্রয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে নতুন পণ্য ও সেবার ক্ষেত্র তৈরি করা।
ক্রস-বর্ডার ই-কমার্স: রপ্তানিমুখী ই-কমার্স বা ক্রস-বর্ডার ই-কমার্সের সম্ভাবনা যাচাই করা, যেখানে দেশীয় ভ্যাট প্রযোজ্য নাও হতে পারে।
ডিজিটাল রূপান্তর এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি: অনলাইন রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক হওয়ায় ব্যবসায়ীদের ডিজিটাল হিসাবরক্ষণ এবং সফটওয়্যার ব্যবহারের দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন।

এই প্রস্তাবনাগুলো এখনও চূড়ান্ত হয়নি এবং কাল সোমবার (২ জুন) বাজেট ঘোষণার সময় কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। তাই চূড়ান্ত বাজেট ঘোষণার পর ব্যবসায়ীদের দ্রুততার সঙ্গে নতুন নিয়মাবলীর সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে হবে।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *