প্রতিবেদন

বাংলাদেশ: নিজের ডেটা, অন্যের হাতে কেন

মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: একটি বিষয় কল্পনা করুন। আগামীকাল সকালে ঘুম থেকে ওঠে দেখলেন আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পুরো ইতিহাস কারও কাছে চলে গেছে। আপনার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার তথ্য, এমনকি আপনি রাতে কখন ঘুমান সেটিও কেউ জানে। ভয়ানক লাগছে, তাই না? দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এটি শুধু কল্পনা নয়। এটিই আমাদের বর্তমান বাস্তবতা।

আমাদের তথ্য আসলে কোথায় যাচ্ছে
বাংলাদেশে প্রতিদিন যে বিপুল পরিমাণ ডেটা তৈরি হয়, তার বেশির ভাগই চলে যাচ্ছে বিদেশি সার্ভারে। গুগল, ফেসবুক সার্ভারে, এমনকি আমাদের দেশের কিছু প্রতিষ্ঠানও বিদেশি সার্ভার ব্যবহার করছে। অথচ আমাদের দেশে বেশ কয়েকটা আধুনিক ডেটা সেন্টার রয়েছে। কিন্তু ব্যবহার হয় খুবই কম।

একটু হিসাব করে দেখুন
আমাদের দেশে প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি গিগাবাইট ডেটা তৈরি হয়। এর মধ্যে আছে আমাদের ব্যাংকিং তথ্য, মোবাইল কলের রেকর্ড, কেনাকাটার তথ্য। হাইটেক পার্কে আমাদের টিয়ার-৪ মানের ডেটা সেন্টার আছে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো সেগুলো ব্যবহার করতে চায় না। কেন চাচ্ছেনা ? কারণ বিদেশি সার্ভার ব্যবহার করলে তাদের খরচ কম, ঝামেলাও কম।

সমস্যাটি আসলে কতটা গভীর
চিন্তা করে দেখুন, আপনার সব ব্যক্তিগত তথ্য এখন অন্য দেশের প্রতিষ্ঠানের কাছে। তারা চাইলে সেগুলো ব্যবহার করতে পারে। আবার তাদের দেশের সরকার চাইলে সেই তথ্য দেখতে পারে। আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। এটি শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ও বটে। কারণ- আমাদের দেশের অর্থনৈতিক তথ্য, ব্যবসায়িক কৌশল, এমনকি সরকারি নীতির তথ্যও এই ডেটার মধ্যে লুকিয়ে আছে। কেউ যদি চায়, তাহলে আমাদের পুরো দেশের একটা ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করতে পারে। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের ডিজিটাল স্বাধীনতা।

বিশ্বের অন্য দেশগুলো কী করছে
ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম- এই দেশগুলো কিন্তু অনেক আগেই বুঝে গেছে। তারা আইন করেছে যে, তাদের দেশের মানুষের তথ্য তাদের দেশেই রাখতে হবে। এটিকে বলে ডেটা লোকালাইজেশন। মানে আপনি যদি ভারতে কোনও অ্যাপ চালু করতে চান, তাহলে ভারতীয়দের ডেটা ভারতেই রাখতে হবে। এতে তারা নিশ্চিত করেছে যে, তাদের মানুষের তথ্য তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে।

আমাদের করণীয় কী
এই সমস্যার সমাধান কিন্তু অসম্ভব নয়। তবে এর জন্য চাই সরকার, ব্যবসায়ী আর আমাদের সবার একসঙ্গে কাজ করা।
আইন করতে হবে: বাংলাদেশের মানুষের ডেটা বাংলাদেশেই রাখতে হবে, এই নিয়ম করতে হবে। ভালো খবর হচ্ছে, সরকার ইতিমধ্যে ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্টের খসড়া তৈরি করেছে। শুধু পাস করা বাকি।
ডেটা সেন্টারগুলোকে উন্নত করতে হবে: আমাদের ডেটা সেন্টারগুলোকে আরও উন্নত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা, দ্রুততা আর সেবা দিতে পারতে হবে।
প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহ দিতে হবে: যারা দেশের ভিতরে ডেটা রাখবে, তাদের কর ছাড় দিতে হবে। সুবিধা দিতে হবে।
সচেতন হতে হবে: আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। কোন অ্যাপ আমাদের কী তথ্য নিচ্ছে, সেটি কোথায় রাখছে- এসব জানতে হবে।

কেন এটি এত জরুরি
আজকের যুগে ডেটা মানে ক্ষমতা। যার কাছে বেশি ডেটা, সে তত বেশি শক্তিশালী। আমাজন, গুগল, ফেসবুক – এরা আজ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান কেন। কারণ, তাদের কাছে আছে বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের তথ্য। আমরা যদি আমাদের ডেটা অন্যদের হাতে তুলে দিয়ে রাখি, তাহলে আমরা সারাজীবন তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকব। আমরা হব শুধু ভোক্তা, কখনও উৎপাদক হতে পারব না। কিন্তু আমরা যদি আমাদের ডেটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি, তাহলে সেই ডেটা ব্যবহার করে আমরা নিজেরাই নতুন নতুন প্রযুক্তি তৈরি করতে পারব। নতুন ব্যবসা তৈরি করতে পারব। আমাদের তরুণদের কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারব।

বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল বিপ্লবের মুখে দাঁড়িয়ে। আমাদের সামনে একটি সুযোগ আছে। আমরা হয় এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে নিজেদের একটা শক্তিশালী ডিজিটাল ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারি। নয়তো অন্যদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে পারি। পছন্দটি আমাদের। সিদ্ধান্তটিও আমাদের নিতে হবে। আর সময় আছে খুবই কম। কারণ, যে দেশ আজ তার ডেটার মালিকানা হারায়, সে দেশ কাল তার স্বাধীনতাও হারিয়ে ফেলে।

লেখক: মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম:- ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি (লি.) এবং সভাপতি- বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি (বিসিএস)

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *