বাংলাদেশে ড্রোন: ড্রোন কেনা, ব্যবহার, প্রচলিত আইন, নীতিমালা ও ভবিষ্যৎ নির্দেশনা

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা): তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির এই যুগে ড্রোন শুধু একটি খেলনা বা শখের বস্তুই নয়, এটি এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই সময়ে ড্রোন যোগাযোগ, নিরাপত্তা, ডেটা সংগ্রহ এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কৃষি খাতের আধুনিকীকরণ থেকে শুরু করে নির্মাণকাজের পর্যবেক্ষণ, সাংবাদিকতা, চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় উদ্ধার কাজে ড্রোন এখন অপরিহার্য।
তবে, এই প্রযুক্তির বহুমুখী সুবিধার পাশাপাশি এর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সমাজের নিরাপত্তা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশে অনেকেই ড্রোন কেনা এবং ব্যবহারের আগে এর সম্পর্কিত আইন-কানুন সম্পর্কে অবগত নন, যার ফলস্বরূপ প্রায়ই আইনি জটিলতার সৃষ্টি হয়। এই লেখায় আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ড্রোন কেনা, ব্যবহার এর আইনি কাঠামো এবং অননুমোদিত ব্যবহারের ঝুঁকি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ড্রোন কেনা: অনুমোদিত বনাম অননুমোদিত চ্যানেল
বাংলাদেশে ড্রোন কেনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এর বিক্রয় পদ্ধতির অনিয়ম। অনেকেই শখের বশে বা সস্তা হওয়ায় ‘নন-চ্যানেল’ বা অননুমোদিত বিক্রেতাদের কাছ থেকে ড্রোন কেনেন। এই ড্রোনগুলো সাধারণত সরাসরি সরকারের অনুমতি নিয়ে আমদানি করা হয় না।
অনুমোদিত বিক্রেতা: কিছু প্রতিষ্ঠান বা বিক্রেতা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, যেমন- বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) থেকে যথাযথ অনুমতি নিয়ে ড্রোন আমদানি এবং বিক্রি করেন। এই ড্রোনগুলোর সঙ্গে সাধারণত আমদানির বৈধ কাগজপত্র থাকে, যা ভবিষ্যতে নিবন্ধন এবং অনুমতির জন্য সহায়ক।
অননুমোদিত বা নন-চ্যানেল বিক্রেতা: অনেক বিক্রেতা বৈধ অনুমতি ছাড়াই ড্রোন আমদানি করেন এবং খুচরা বাজারে বিক্রি করেন। এই ধরনের ড্রোন কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতা সরাসরি আইনি ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। কেননা, এই ড্রোনগুলোর কোনও বৈধ কাগজপত্র থাকে না, ফলে এগুলোর নিবন্ধন বা ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেক সময় বিদেশি মার্কেটপ্লেস থেকে সরাসরি ড্রোন আমদানি করলেও একই সমস্যা হয়।
অনুমোদিত চ্যানেল থেকে ড্রোন কেনার অন্যতম সুবিধা হলো বিক্রেতা আপনাকে ড্রোনের আইনি বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত করতে বাধ্য। বিপরীতে, অননুমোদিত ড্রোন কেনা মানে শুরুতেই আইনি জটিলতার মুখে পড়া। তাই ড্রোন কেনার আগে বিক্রেতার বৈধতা এবং পণ্যের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে কিনা তা যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি।
ড্রোনের আইনি কাঠামো: প্রচলিত আইন ও নীতিমালা
বাংলাদেশে ড্রোন পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে একটি আলাদা আইন না থাকলেও, এটি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৭ (বেবিচক অ্যাক্ট ২০১৭) এবং দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (প্যানেল কোড অব ১৮৬০)-এর অধীনে পরিচালিত হয়। এ ছাড়াও বেবিচক সময়োপযোগী বিভিন্ন সার্কুলার ও নীতিমালা জারি করে ড্রোনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)-এর ভূমিকা
বেবিচক বাংলাদেশে ড্রোন ব্যবহারের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তারা ড্রোন উড্ডয়নের জন্য অনুমতিপত্র প্রদান, নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা এবং ড্রোনের শ্রেণিবিভাগ (ওজন, ব্যবহার, ক্ষমতা অনুসারে) নির্ধারণ করে। তাদের জারি করা নীতিমালায় স্পষ্ট করে বলা আছে, কোন ধরনের ড্রোন কোন এলাকায় কত উচ্চতায় উড়ানো যাবে এবং কোন কোন এলাকায় এর ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
নতুন নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা
বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার ড্রোনের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার জন্য একটি নতুন ‘ড্রোন নীতিমালা ২০২৫’ প্রণয়নের কাজ করছে। এই খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, খেলনা ড্রোন ছাড়া অন্য সব ড্রোন পরিচালনার জন্য লাইসেন্স নেয়া বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এতে অপারেটরকে কমপক্ষে ১৬ বছর বয়সী হতে হবে এবং বেবিচক থেকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সার্টিফিকেট অর্জন করতে হবে।
এ ছাড়াও, প্রতিটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটের জন্য বেবিচক ছাড়াও সামরিক ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো যেমন- এয়ার ডিফেন্স অপারেশন্স সেন্টার, ডিরেক্টোরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টিলিজেন্স (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) থেকে ছাড়পত্র নিতে হবে। এই নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে ড্রোনের ব্যবহার আরও সুশৃঙ্খল হবে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে।

পেশাদার ব্যবহার ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা
ড্রোন ব্যবহারের সবচেয়ে বড় নৈতিক ও আইনি চ্যালেঞ্জ হলো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন। ড্রোন ব্যবহারকারীরা প্রায়ই মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে অনধিকার প্রবেশ করেন, যা সমাজে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে।
সাংবাদিকতা এবং মিডিয়া: সাংবাদিকরা যখন জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনও বিষয় কাভার করার জন্য ড্রোন ব্যবহার করেন, তখন তাদের অবশ্যই বেবিচক এবং স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুমতি নিতে হয়। কোনও জনসভায় বা সংবেদনশীল স্থানে ড্রোনের ব্যবহার অনেক সময় নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তার স্বার্থে ড্রোন ব্যবহার করতে পারেন, তবে এক্ষেত্রে তাদের নির্দিষ্ট আইন এবং আদালতের নির্দেশনা মেনে চলতে হয়। জনগণের ওপর নজরদারির জন্য ড্রোন ব্যবহার করা হলেও তা হতে হবে কঠোর নজরদারির আওতায় এবং দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী।
সাধারণ মানুষের প্রাইভেসি: একজন সাধারণ নাগরিকের ওপর ড্রোন ব্যবহার করে ভিডিও ধারণ করা বা নজরদারি করা তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা অধিকারের লঙ্ঘন। এর বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব।
অননুমোদিত ড্রোন চালালে কী হবে
অনুমতি ছাড়া ড্রোন উড়ালে ব্যবহারকারীকে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অনুমতি ছাড়া ড্রোন উড়ালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ড্রোনটি জব্দ করতে পারে। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, অবৈধভাবে ড্রোন ব্যবহার করলে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। এর ফলে জরিমানা, এমনকি কারাদণ্ডও হতে পারে। অননুমোদিত ড্রোন ব্যবহারের ফলে জাতীয় নিরাপত্তা, বিমান চলাচল বা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি হলে তার জন্য কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে। বিমানবন্দরের আশেপাশে ড্রোন উড়ালে তা বিমানের চলাচলের জন্য বড় বিপদ সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে চরম দুর্ঘটনা ঘটার ঝুঁকি থাকে।
ড্রোনের ব্যবহার বিধি ও সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশে ড্রোন কোথায় ব্যবহার করা যাবে এবং কোথায় ব্যবহার করা যাবে না, তা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা আছে। এই নিয়মগুলো মূলত নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা রক্ষার জন্য প্রণীত হয়েছে।
নিষিদ্ধ এলাকা: সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়, সামরিক স্থাপনা, বিমানবন্দর, জেলখানা, হাসপাতাল এবং অন্যান্য সংবেদনশীল সরকারি ভবনের আশেপাশে ড্রোন উড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
বিমানবন্দর ও এর আশেপাশের এলাকা: বিমানবন্দরের আশেপাশের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ড্রোন উড়ানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এটি বিমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
জনবহুল এলাকা: জনবহুল এলাকা, যেমন: স্টেডিয়াম, বড় বাজার, বা কোনও জনসভা চলাকালীন সময়ে ড্রোন উড়ানো সীমিত বা নিষিদ্ধ হতে পারে।
সীমান্তবর্তী এলাকা: দেশের সীমান্ত এলাকায় কোনও প্রকার ড্রোন উড়ানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
ড্রোন একটি শক্তিশালী ও কার্যকরী প্রযুক্তি। এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে সবাইকে আইন, নিয়ম এবং নৈতিকতার বিষয়ে সচেতন হতে হবে। ড্রোন কেনার সময় বৈধ বিক্রেতা থেকে কেনা এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেবিচক-এর নিয়ম মেনে চলা অত্যাবশ্যক। ড্রোন নিয়ে যেকোনও প্রশ্ন বা তথ্যের জন্য সরাসরি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করাই সবচেয়ে নিরাপদ পথ। সঠিক নিয়ম মেনে চললে আমরা ড্রোন প্রযুক্তির সুবিধাগুলো উপভোগ করতে পারব এবং একই সঙ্গে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তাও নিশ্চিত করতে পারব।
লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব