বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চ্যানেল ও নন চ্যানেল প্রযুক্তির পণ্য আমদানির প্রভাব

বাংলাদেশের প্রযুক্তি পণ্যের বাজারে বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানদের ‘চ্যানেল পণ্য’ (অনুমোদিত পরিবেশক, আমদানিকারক ও সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আসা পণ্য) এবং ‘নন-চ্যানেল পণ্য’ (অননুমোদিত, অবৈধ পথে, লাগেজ পার্টির উৎস থেকে আসা পণ্য) এর মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। এটি একটি উদ্বেগের বিষয় এবং সবাই এ বিষয়ে একমত হবেন যে- এই বৈষম্য গ্রাহক, সরকার এবং বৈধ ব্যবসায়ীদের জন্য অনেক সমস্যা তৈরি করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তি পণ্য যথাযথ উপায়ে নিয়ে আসা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? প্রযুক্তি পণ্য যথাযথ উপায়ে অর্থাৎ সরকারের নিয়ম-কানুন মেনে এবং অনুমোদিত পরিবেশকদের মাধ্যমে দেশে আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর গুরুত্ব নিয়ে লিখেছেন…মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)
পণ্যের গুণগত মান এবং বিশ্বাসযোগ্যতা
মান নিয়ন্ত্রণ: অনুমোদিত চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে আসা পণ্যগুলো সাধারণত প্রস্তুতকারকের মান নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, যা পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করে।
ওয়ারেন্টি ও বিক্রয়োত্তর সেবা: চ্যানেল পণ্যগুলোতে প্রস্তুতকারকের অফিসিয়াল ওয়ারেন্টি থাকে, যা গ্রাহককে ত্রুটিপূর্ণ পণ্যের ক্ষেত্রে মেরামত বা প্রতিস্থাপনের নিশ্চয়তা দেয়। এটি বিক্রয়োত্তর সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও অত্যন্ত জরুরি।
গ্রাহকের নিরাপত্তা ও অধিকার
প্রতারণা রোধ: যথাযথ উপায়ে চ্যানেলের মাধ্যমে পণ্য কিনলে গ্রাহক প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পান। তারা নিশ্চিত থাকেন, যে তারা আসল এবং নতুন পণ্য পাচ্ছেন।
দীর্ঘস্থায়ীত্ব ও কার্যকারিতা: চ্যানেল পণ্যগুলো সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত কার্যকারিতা বজায় রাখে।
সরকারের রাজস্ব আয়
শুল্ক ও ভ্যাট: বৈধ পথে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সরকার শুল্ক, ভ্যাট এবং অন্যান্য কর আদায় করতে পারে, যা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখে।
বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা: বৈধ আমদানি বৈদেশিক মুদ্রার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে।
বৈধ ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টি
সুস্থ প্রতিযোগিতা: বৈধ আমদানিকারক ও পরিবেশকরা তাদের অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ (যেমন- অফিস, কর্মকর্তা-কর্মচারী বেতন, কর ইত্যাদি) বহন করেন। অবৈধ পণ্য এই বৈধ ব্যবসায়ীদের জন্য অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করে, যা তাদের ব্যবসা পরিচালনায় বাধা দেয়।
বিনিয়োগ আকর্ষণ: একটি সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক বাজার বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সাহায্য করে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি: বৈধ (চ্যানেল) আমদানিকারক ও পরিবেশক এবং রিটেইলারদের বড় অপারেশনাল সেটআপ থাকে, যেখানে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়।

নন-চ্যানেলে আসা প্রযুক্তি পণ্য গ্রাহকদের কতটা ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে?
ওয়ারেন্টি এবং বিক্রয়োত্তর সেবার অভাব: নন-চ্যানেল পণ্যে সাধারণত কোনো অফিসিয়াল ওয়ারেন্টি থাকে না। পণ্য নষ্ট হলে বা কোনো সমস্যা হলে গ্রাহক প্রস্তুতকারকের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পান না। বিক্রেতা হয়তো কিছু সীমিত সময়ের ওয়ারেন্টি দিতে পারে, কিন্তু তার নির্ভরযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ।
পণ্যের গুণগত মান নিয়ে অনিশ্চয়তা: এই পণ্যগুলো সেকেন্ড-হ্যান্ড, রিফারবিশড (পুনরায় সংস্কার করা), বা নকল হতে পারে। দেখতে একই মনে হলেও, ভেতরের যন্ত্রাংশ নিম্নমানের হতে পারে, যা দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
প্রতারণার শিকার হওয়া: গ্রাহকরা জানতে পারেন না, যে তারা কোন উৎস থেকে পণ্য কিনছেন। অনেক সময় পণ্যের প্যাকেজিং বা মডেল নম্বর পরিবর্তন করে ভেতরের নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করা হয়।
নিরাপত্তা ঝুঁকি: কিছু প্রযুক্তি পণ্যে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঝুঁকি থাকতে পারে, যেমন নিম্নমানের ব্যাটারি বিস্ফোরিত হওয়া বা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট হওয়া। নন চ্যানেলে আসা পণ্যে এই ধরনের ঝুঁকি বেশি থাকে।
পুনর্বিক্রয় মূল্য কমে যাওয়া: ওয়ারেন্টিহীন বা মানহীন পণ্যের পুনর্বিক্রয় মূল্য অনেক কম হয়।
মূল্যের প্রতারণা: যদিও নন চ্যানেলে পণ্যের আমদানি খরচ কম হয়, প্রায় একই মূল্যে বিক্রি করে গ্রাহকদের অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়, কারণ গ্রাহক চ্যানেল পণ্যের সঙ্গে এর পার্থক্য ধরতে পারেন না।
সরকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন
বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারানো: শুল্ক, আমদানি শুল্ক, ভ্যাট এবং অন্যান্য কর না পাওয়ায় সরকার প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা রাজস্ব হারায়। এটি দেশের উন্নয়নমূলক কাজে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়: অবৈধ লেনদেনগুলো প্রায়শই অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহকে উৎসাহিত করে, যা দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
অর্থপাচার: অনেক সময় অবৈধ আমদানি অর্থপাচারের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বৈধ ব্যবসায়ীদের ক্ষতি: বৈধ আমদানিকারকরা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হওয়ায় তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা সরকারের জন্য নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধা দেয়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি: অবৈধ ব্যবসা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এ থেকে উত্তরণের উপায় কি?
এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার, বৈধ ব্যবসায়ী এবং গ্রাহক – সকলের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন:
সরকারের কঠোর তদারকি ও আইনি প্রয়োগ
আমদানি নিয়ন্ত্রণ: স্থলবন্দর, বিমানবন্দর এবং নৌবন্দরে অবৈধভাবে আসা প্রযুক্তি পণ্যের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কাস্টমস এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তদারকি আরও জোরদার করতে হবে।
বাজার পর্যবেক্ষণ: দেশের বাজারে নন চ্যানেলে আসা প্রযুক্তি পণ্যের সরবরাহ বন্ধ করতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
কঠোর শাস্তি: অবৈধ আমদানিকারকদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখতে হবে এবং তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
স্বচ্ছ নীতি: আমদানি নীতিকে আরও সহজবোধ্য ও কার্যকর করতে হবে যাতে বৈধ ব্যবসায়ীরা সহজে পণ্য আনতে পারেন।

গ্রাহক সচেতনতা বৃদ্ধি
প্রচারণা: সরকার এবং বৈধ ব্যবসায়ীরা যৌথভাবে প্রচারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে। যেমন: অফিসিয়াল ওয়ারেন্টি ছাড়া পণ্য কিনবেন না, অফিসিয়াল রিসেলার থেকে পণ্য কিনুন ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করা।
চেনার উপায়: গ্রাহকদের চ্যানেল (আসল) পণ্য এবং নন চ্যানেল পণ্যের মধ্যে পার্থক্য বোঝার উপায় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে (যেমন: পণ্যের প্যাকেজিং, সিরিয়াল নম্বর যাচাই, ওয়ারেন্টি কার্ড)।
মূল্য সচেতনতা: অতিরিক্ত কম মূল্যে লোভনীয় অফার দেখলে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া।
অনুমোদিত পরিবেশক, আমদানিকারক ও সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানদের ভূমিকা
প্রতিযোগিতামূলক মূল্য: বৈধ আমদানিকারকরা তাদের অপারেশনাল দক্ষতা বাড়িয়ে এবং সাপ্লাই চেইনকে আরও কার্যকর করে পণ্যের মূল্য কিছুটা কমিয়ে আনতে পারেন, যাতে নন চ্যানেল পণ্যের সঙ্গে মূল্যের পার্থক্য খুব বেশি না হয়।
উন্নত গ্রাহক সেবা: বিক্রয়োত্তর সেবার মান আরও উন্নত করে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করতে হবে।
সক্রিয় প্রচারণা: বৈধতার গুরুত্ব তুলে ধরে নিজস্ব প্রচারণা চালানো।
প্রযুক্তি ব্যবহার
QR কোড/বারকোড: পণ্যের প্যাকেজিংয়ে QR কোড বা বারকোড ব্যবহার করে গ্রাহকরা সহজেই পণ্যের উৎস এবং ওয়ারেন্টি যাচাই করতে পারে এমন ব্যবস্থা চালু করা।
ডিজিটাল নিবন্ধন: আমদানি করা প্রতিটি প্রযুক্তি পণ্যের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যা নন চ্যানেল পণ্য চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি
বিটিআরসি বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জনবল ও কারিগরি সক্ষমতা বৃদ্ধি করে তাদের তদারকি ক্ষমতা বাড়ানো।
এই সমন্বিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারলে বাংলাদেশের প্রযুক্তি পণ্যের বাজার আরও সুসংগঠিত হবে, গ্রাহকরা প্রতারণা থেকে রক্ষা পাবেন, সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে পারবে এবং বৈধ ব্যবসায়ীরা একটি সুষ্ঠু পরিবেশে ব্যবসা করতে পারবেন।
লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব