প্রতিবেদন

বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের আস্থার অভাব এবং উত্তরণের উপায়

বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের সম্ভাবনা এখনও অনেক বেশি। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অনলাইন কেনাকাটার প্রবণতা বাড়ছে। সরকার ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছে, যা ই-কমার্স খাতের বিকাশে সহায়ক হবে। সরকার যদি এই খাতকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে, তাহলে এই খাত ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করবে।

তবে, এই খাতের উন্নতি কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, যেমন- গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনা। ডিজিটাল অবকাঠামোর উন্নয়ন। সরকারের সঠিক নীতিমালা এবং নিয়ন্ত্রণ। উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ এর ব্যবস্থা করা। ই-কমার্স খাত দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও, গ্রাহকদের আস্থাহীনতা এর অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা। এই আস্থাহীনতার মূল কারণগুলো এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে লিখেছেন,,,মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)

আস্থাহীনতার মূল কারণসমূহ
পণ্যের মান ও বর্ণনা নিয়ে অসঙ্গতি: অনলাইনে যে পণ্যের ছবি ও বর্ণনা দেখা যায়, হাতে পাওয়ার পর তার সঙ্গে প্রায়শই অমিল থাকে। নিম্নমানের পণ্য পাঠানো, ভুল পণ্য পাঠানো অথবা পণ্যের বৈশিষ্ট্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা একটি সাধারণ সমস্যা।

ডেলিভারি সংক্রান্ত সমস্যা: দীর্ঘসূত্রিতা, দেরিতে ডেলিভারি, ভুল ঠিকানায় ডেলিভারি, অথবা ডেলিভারির সময় গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ না করা- এগুলো গ্রাহকদের বিরক্তির কারণ। অনেক সময় ডেলিভারি এজেন্টরা পণ্য নিয়ে সঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারেন না অথবা গ্রাহকের সঙ্গে অযাচিত আচরণ করেন।

রিটার্ন ও রিফান্ড প্রক্রিয়া জটিলতা: পণ্য ফেরত দেয়া বা টাকা ফেরত পাওয়া (রিফান্ড) প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং সময় সাপেক্ষ। অনেক ক্ষেত্রে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো রিটার্ন ও রিফান্ড পলিসি স্পষ্টভাবে জানায় না অথবা তা মানতে গড়িমসি করে।

গ্রাহক সেবার অভাব: প্রয়োজনে দ্রুত গ্রাহক সেবা না পাওয়া, ফোন কল বা ইমেইলের উত্তর না দেয়া, অথবা সমস্যার সমাধান না করা আস্থাহীনতা বাড়ায়। অনেক ছোট ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সুসংগঠিত গ্রাহক সেবা ব্যবস্থা নেই।

ভুয়া রিভিউ ও রেটিং: অনেক সময় বিক্রেতারা ভুয়া রিভিউ ও রেটিং ব্যবহার করে গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করে। এতে পণ্যের মান সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হয়।

সাইবার নিরাপত্তা ও ডেটা গোপনীয়তা: গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য ও পেমেন্ট সংক্রান্ত তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকে। ডেটা লঙ্ঘনের ঘটনা বা হ্যাকিংয়ের ভয় গ্রাহকদের অনলাইনে কেনাকাটা করতে নিরুৎসাহিত করে।

ক্যাশ অন ডেলিভারির সীমাবদ্ধতা: যদিও ক্যাশ অন ডেলিভারি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জনপ্রিয়, এটি অনেক সময় বিক্রেতার জন্য পণ্য ফেরত আসার ঝুঁকি তৈরি করে। আবার, কিছু ক্ষেত্রে বিক্রেতারা ক্যাশ অন ডেলিভারির নামে অতিরিক্ত চার্জ আরোপ করে।

আইনি কাঠামোর দুর্বলতা: ই-কমার্স সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট ও কঠোর আইনি কাঠামোর অভাব এবং তার যথাযথ প্রয়োগ না থাকা আস্থাহীনতার একটি বড় কারণ। এতে প্রতারণা বা অন্যায় করলে সহজে বিচার পাওয়া কঠিন হয়।

উত্তরণের উপায় ও গ্রাহক সেবায় গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি
স্বচ্ছতা ও সততা নিশ্চিত করা
পণ্যের সঠিক বর্ণনা ও ছবি: পণ্যের বিস্তারিত, সঠিক ও বাস্তবসম্মত ছবি ও বর্ণনা ওয়েবসাইটে থাকা আবশ্যক। কোনো ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা থাকলে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত।
মূল্য ও চার্জের স্বচ্ছতা: পণ্যের মূল্য, ডেলিভারি চার্জ এবং অন্যান্য লুকানো খরচ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত। রিভিউ ও রেটিং-এর বিশ্বাসযোগ্যতা: ভুয়া রিভিউ প্রতিরোধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যাচাইকৃত ক্রেতাদের রিভিউ প্রদর্শিত হলে তা আস্থার প্রতীক হবে।

উন্নত ডেলিভারি ব্যবস্থা:
দ্রুত ও সময়ানুগ ডেলিভারি: নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পণ্য ডেলিভারি নিশ্চিত করতে হবে। ডেলিভারি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলে গ্রাহককে তাৎক্ষণিক অবহিত করা উচিত।
ট্র্যাকিং সুবিধা: গ্রাহকদের জন্য অর্ডার ট্র্যাকিং সুবিধা থাকা উচিত যাতে তারা পণ্যের অবস্থান জানতে পারে।
সত ও প্রশিক্ষিত ডেলিভারি এজেন্ট: ডেলিভারি এজেন্টদের গ্রাহকদের সঙ্গে সত ও বিনয়ী আচরণ করার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত।

সহজ রিটার্ন ও রিফান্ড প্রক্রিয়া
স্পষ্ট রিটার্ন ও রিফান্ড নীতি: সহজবোধ্য এবং স্বচ্ছ রিটার্ন ও রিফান্ড নীতি স্পষ্টভাবে ওয়েবসাইটে উল্লেখ করতে হবে।
দ্রুত প্রক্রিয়া: রিটার্ন বা রিফান্ডের অনুরোধ দ্রুত প্রক্রিয়া করা এবং নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে টাকা ফেরত দেয়া।
সহজ যোগাযোগ: রিটার্ন বা রিফান্ড সংক্রান্ত সমস্যার জন্য গ্রাহকদের সহজে যোগাযোগ করার সুযোগ থাকতে হবে।

শক্তিশালী গ্রাহক সেবা:
বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা: ফোন, ইমেইল, লাইভ চ্যাট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে গ্রাহকদের জন্য ২৪/৭ সহায়তা নিশ্চিত করা।
দ্রুত সাড়া দেয়া: গ্রাহকদের প্রশ্নের দ্রুত এবং কার্যকর উত্তর দেয়া।
প্রশিক্ষিত ও বন্ধুত্বপূর্ণ কর্মী: গ্রাহক সেবার সঙ্গে জড়িত কর্মীদের সমস্যার সমাধানে পারদর্শী ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করার প্রশিক্ষণ দেয়া।

সাইবার নিরাপত্তা ও ডেটা সুরক্ষা
উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা: ওয়েবসাইট এবং পেমেন্ট গেটওয়েতে উচ্চমানের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা (SSL সার্টিফিকেশন, PCI DSS কমপ্লায়েন্স)।
ডেটা গোপনীয়তা নীতি: গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা এবং ডেটা ব্যবহারের নীতি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা।

আইনি কাঠামো ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা:
কঠোর আইনি পদক্ষেপ: ই-কমার্স সংক্রান্ত প্রতারণা বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিশ্চিত করা।সক্রিয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা: ই-কমার্স খাতকে পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সক্রিয় এবং কার্যকর নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকা দরকার।
গ্রাহক অধিকার সুরক্ষা: গ্রাহক অধিকার সুরক্ষা আইন এবং তার প্রয়োগকে শক্তিশালী করা।

শিক্ষামূলক প্রচার: গ্রাহকদের ই-কমার্স সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়াতে প্রচারমূলক কার্যক্রম চালানো যেতে পারে, যেমন – কীভাবে নিরাপদ অনলাইন কেনাকাটা করতে হয়, কী কী বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হয় ইত্যাদি।

ক্রেতা-বিক্রেতা সেতুবন্ধন: ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করতে পারে (যেমন প্রশ্ন-উত্তর সেকশন), যা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশের ই-কমার্স সেক্টরে আস্থাহীনতা দূর করতে হলে প্রতিটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে তাদের সেবার মান উন্নত করতে হবে এবং সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে একটি সুসংগঠিত এবং কার্যকর আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে। গ্রাহকদের আস্থা অর্জিত হলে এই খাতটি দেশের অর্থনীতিতে আরও বড় অবদান রাখতে পারবে।

লেখক: মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক মৃধা (সোহেল মৃধা)- প্রতিষ্ঠাতা কিনলে ডটকম, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ই-ক্যাব

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *